ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

শংকর লাল দাশ

ইলিশে ফিরে আসছে সুদিন

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ৪ নভেম্বর ২০১৮

ইলিশে ফিরে আসছে সুদিন

মা ইলিশ রক্ষা তথা প্রজনন নির্বিঘ্ন রাখা, জাটকা নিধন বন্ধে কড়াকড়ি, অভয়াশ্রম তৈরি, বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা জোরদার করা এবং জেলেদের সহায়তা কর্মসূচী। প্রধানত এ পাঁচটি কারণে দেশে ইলিশের উৎপাদন ক্রমে বাড়ছে। প্রতিবছরই ইলিশের উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে। আর ইলিশের উৎপাদন যত বাড়ছে, ততই এর অর্থনীতি গতিশীল হচ্ছে। জেলেসহ সংশ্লিষ্টদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হচ্ছে। কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আমিষের ঘাটতি পূরণে সহায়ক হচ্ছে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিকসহ এমন আরও সংশ্লিষ্ট নানা ক্ষেত্রে ইলিশের অবদান ক্রমে বেড়েই চলছে। সাগরের রুপালি শস্য ইলিশ একান্তই প্রকৃতিনির্ভর। প্রকৃতির মেজাজ মর্জিতে চলে ইলিশের জীবনযাপন। সাগরের গভীর পানিতে বসবাস। ডিম ছাড়ার জন্য সাগরের গভীরতা ছেড়ে উপকূলে চলে আসা। বর্ষার উতাল-পাতাল ঢেউয়ে মিঠা পানিতে ডিম ছাড়া। পূর্ণ বয়স্ক একটি ইলিশ ২০ লাখ পর্যন্ত ডিম ছাড়তে সক্ষম। ডিম ছেড়েই আবার গভীর সাগরে পাড়ি। ডিম পর্যায়ক্রমে জাটকায় পরিণত হয়। ইলিশ ঝাঁক বেঁধে চলতে অভ্যস্ত। দিনে ৬০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সক্ষম। আবহমান কাল থেকে ইলিশ বাংলাদেশ সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের সম্পদ। পৃথিবীতে যত ইলিশ আহরণ হয়ে থাকে, তার ৬০-৬৫ ভাগই আহরণ হয় বঙ্গোপসাগরসহ অভ্যন্তরীণ নদ-নদী থেকে। এক সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ১৬০টি নদ-নদীতে ইলিশের দেখা মিলত। পদ্মার ইলিশ পৌঁছে গিয়েছিল খ্যাতির শীর্ষে। যা নিয়ে আজও বাঙালী আবেগপ্রবণ। তাই ইলিশ লাভ করেছে জাতীয় মাছের মর্যাদা। এর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। কিন্তু অতি আহরণ, পরিবেশ দূষণ ও আবাসস্থলের ক্ষতির মতো প্রধানত কয়েকটি কারণে গত শতকের আশির দশকে ইলিশ উৎপাদনে ধস নামে। পরবর্তী দুই-তিন দশকে বিশেষ করে গত এক দশকে ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে। বেসরকারীভাবেও বহু উদ্যোগ যুক্ত হয়। এসব উদ্যোগের সফল বাস্তবায়নে ফিরে আসে ইলিশের ঐতিহ্য। ইলিশের উৎপাদন গত কয়েক বছরে রেকর্ড সৃষ্টি করে। ২০১৪ সালে যেখানে ইলিশের উৎপাদন ছিল সাড়ে তিন লাখ টন। পরবর্তী বছরে তা ৩ লাখ ৮৭ হাজার ২ শ’ টনে পৌঁছে। ২০১৬ সালে উৎপাদন সাড়ে চার লাখ টন ছাড়িয়ে যায়। আর গত বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে ইলিশের উৎপাদন পাঁচ লাখ টনে দাঁড়ায়। চলতি মৌসুমে উৎপাদনের পরিমাণ আরও বাড়বে, তা নিশ্চিত মনে করেন সংশ্লিষ্ট মহলগুলো। ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির এ হার পটুয়াখালী জেলার দিকে তাকালেও স্পষ্ট হয়। সাগরপাড়ের জেলা পটুয়াখালী। জেলায় মৎস্যজীবীর সংখ্যা ৫৫ হাজারের বেশি। যার অধিকাংশই ইলিশ শিকারি জেলে। আবহমানকাল থেকে পটুয়াখালী জেলা ইলিশের জন্য বিখ্যাত। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে পটুয়াখালী জেলায় ইলিশের উৎপাদন ছিল ১৫ হাজার ৪১৯ টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ হাজার ২৭৬ টনে। পরের অর্থবছরে এর পরিমাণ আরও বেড়ে ৩২ হাজার ৭৫০ টনে পৌঁছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পটুয়াখালী জেলায় ইলিশের উৎপাদন আরও বাড়ে। যার পরিমাণ হয় ৩৬ হাজার ২১৭ টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে ৪৩ হাজার ২৮৬ টনে দাঁড়ায়। চলতি বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের কেবলমাত্র জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে ধরা পড়েছে ৩২ হাজার ৮৩০ টন ইলিশ। সারাদেশেই এভাবে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। মাত্র কয়েক বছর আগেও দেশের অভ্যন্তরীণ যেসব নদী থেকে ইলিশ উধাও হয়ে গিয়েছিল, তা এরইমধ্যে ফিরে আসতে শুরু করেছে। উজানের অনেক নদীতেও এখন ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। ইলিশের ক্রমাগত উৎপাদন বৃদ্ধির নেপথ্যে সরকারী-বেসরকারী যে উদ্যোগগুলো সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রেখেছে, তার অন্যতম হচ্ছে মা-ইলিশ সংরক্ষণ কর্মসূচী। ২০০৮ সাল থেকে এ কর্মসূচী চালু হয়। শুরুতে এর মেয়াদ ছিল ১১ দিন। যা পরবর্তীতে ২২ দিন করা হয়। বাংলাদেশের জলজ ইকোসিস্টেমে সব সময় কমপক্ষে শতকরা ত্রিশ ভাগ ইলিশ ডিম বহন করে। প্রজননের ভরা মৌসুমে ডিম বহনকারী ইলিশের সংখ্যা শতকরা ৬০-৭০ ভাগ বেড়ে যায়। চন্দ্রমাস পরিবর্তন যোগ্য হলেও মৎস্য বিজ্ঞানীরা প্রধানত বাংলা আশ্বিন-কার্তিক বা ইংরেজী অক্টোবর মাসের পূর্ণিমা ঘিরে ইলিশের প্রধান বা ভর প্রজনন মৌসুম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ সময়ের প্রজননকে নিরাপদ ও নির্বিঘœ করার উদ্দেশ্যে পূর্ণিমার আগের ৪ দিন, পূর্ণিমার দিন ও পূর্ণিমার পরের ১৭ দিন অর্থাৎ মোট ২২ দিন ইলিশ আহরণের পাশাপাশি এর মজুদ, পরিবহন এবং বেচাকেনাও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং এ নিষেধাজ্ঞা সফলভাবে কার্যকরের চেষ্টা করা হয়। উপকূলসহ দেশের সাত হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকায় এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকে। মা-ইলিশ সংরক্ষণে এ কর্মসূচী বাস্তবায়নের ফলে ইলিশের উৎপাদন আশাতীত সফলতা লাভ করেছে। মৎস্য অধিদফতরের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে ১১ দিন বন্ধ থাকায় ১ দশমিক ৬৩ কোটি ইলিশ আহরণ হতে রক্ষা পেয়েছে। এতে ৪ লাখ ১৭ হাজার ৭৬৫ কেজি ডিম প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত হয়েছে। উৎপাদিত ডিমের শতকরা ৫০ ভাগ পরিস্ফুটনের হার ধরা হলেও ২ লাখ ৬১ হাজার ১০৩ কোটি রেণু উৎপাদন হয়েছে এবং এরমধ্যে শতকরা মাত্র দশভাগ বেঁচে থাকার হার ধরা হলেও ওই বছরে ২৬ হাজার ১০০ কোটি পোনা ইলিশে রূপ নিয়েছে। এভাবে প্রতিবছর ইলিশের উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়েছে। মা-ইলিশ সংরক্ষণে সরকার দরিদ্র জেলেদের প্রতিও বিশেষভাবে সুনজর দিয়েছে। নিষেধাজ্ঞাকালীন ২২ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ রাখায় সরকার জেলে পরিবারগুলোকে খাদ্য সহায়তা কর্মসূচীর আওতায় নিয়ে এসেছে। ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে জাটকা সংরক্ষণ কর্মসূচী সরকারের আরেকটি সাফল্যের উদাহরণ। প্রকৃতির নিয়মে ইলিশ স্বাদুপানি থেকে সমুদ্রের লোনাপানি আবার লোনাপানি থেকে স্বাদুপানিতে অভিপ্রয়াণ করে। ইলিশের লার্ভা নার্সারিক্ষেত্রগুলোতে ৬-১০ সপ্তাহ বিচরণের পরে জাটকা হিসেবে গভীর সমুদ্রে যাত্রা করে। আর এ সময়টাতে বিশেষ করে শতকরা ৬০-৭০ ভাগ জাটকা জেলেদের শিকারে পরিণত হয়। তাই সরকার ১ নবেম্বর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত মোট ৮ মাস জাটকা নিধন বন্ধ ঘোষণা করেছে। যা যথাসম্ভব কার্যকর করাও হচ্ছে। জাটকা নিধনে জেলেদের নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে সরকার প্রতিটি জেলে পরিবারকে খাদ্য সহায়তা হিসেবে প্রতি মাসে ৪০ কেজি হারে চাল প্রদান করছে। এরফলেও ইলিশ খাতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। নার্সারিক্ষেত্রগুলোকে অভয়াশ্রম ঘোষণা ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির আরেকটি বড় মাপের সফলতা। বর্তমানে দেশের উপকূলীয় এলাকায় পাঁচটি অভয়াশ্রম রয়েছে এবং আরও একটি অভয়াশ্রম ঘোষণার প্রস্তাব পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে। জাটকা হিসেবে গভীর সাগরে পাড়ি দেয়ার আগ পর্যন্ত খাদ্য গ্রহণ ও বেড়ে ওঠার জন্য নার্সারিক্ষেত্রগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সবধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এতে করে অবাধে ইলিশ বেড়ে উঠতে পারছে। ইলিশের বাণিজ্যিক আহরণক্ষেত্র অনেকটা সীমিতকরণ করা হয়েছে। সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের ব্যবস্থাপনা, সংরক্ষণ ও উন্নয়নে নীতিমালা গ্রহণ করা হয়েছে। সাড়ে চার সেন্টিমিটার বা তার কম ফাঁসের জাল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একইভাবে মনোফিলামেন্ট ফাঁসজাল বা কারেন্ট জাল, চরঘেরা জাল, বেড়জাল ও বেহুন্দিজাল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইলিশ শিকারি জেলেদের জীবনমান উন্নয়নেও নেয়া হয়েছে নানামুখী উদ্যোগ। প্রকৃত জেলেদের একটি ডাটাবেজের আওতায় নিয়ে আসার উদ্যোগ এরইমধ্যে অনেকখানি বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়েছে। প্রত্যেক জেলেকে দেয়া হয়েছে পরিচয়পত্র। মাছ ধরার বিরতিকালীন সময়ে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। মাছ ধরারত অবস্থায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা অন্য কোন কারণে মৃত্যু হলে ওই জেলের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা হারে আর্থিক সহায়তা দেয়ার কর্মসূচী চালু করা হয়েছে। যন্ত্রচালিত প্রতিটি নৌকা এবং ট্রলারকে নিবন্ধনের আওতায় নেয়া হচ্ছে। ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে নেয়া হয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা কার্যক্রম। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির অর্থ সহায়তায় মৎস্য অধিদফতর এবং ওয়ার্ল্ডফিস যৌথভাবে পাঁচ বছর মেয়াদী ‘ইকোফিস-বিডি’ নামের প্রকল্প গ্রহণ করেছে। প্রকল্পের আওতায় বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার মাধ্যমে ইলিশের মজুদ, প্রজননকালীন সময়ে মা-ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞার প্রভাব, ইলিশের অভিপ্রয়াণের ধরন নির্ণয়, মাছ ধরার পরিমাণ মনিটরিং ও অর্থনৈতিক জরিপসহ উল্লেখযোগ্য কয়েকটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে এবং লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় কয়েকটি বেসরকারী সংস্থার মাধ্যমে উপকূলীয় নয়টি জেলার দরিদ্র জেলেদের আর্থ-সামাজিক মানোন্নয়নেও কাজ করা হচ্ছে। এসব উদ্যোগের কারণেও ইলিশ খাতে ইতিবাচক প্রভাব লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে ইলিশ আহরণে সরাসরি পাঁচ লাখ জেলে জড়িত রয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্নভাবে পরোক্ষ জড়িয়ে আছে আরও ২৫ লাখ মানুষ। বর্তমানে জিডিপিতে ইলিশের অবদান এক ভাগ হলেও এর পরিমাণ ক্রমে বাড়ছে। বাড়ছে অর্থের প্রবাহ। বেড়ে চলছে কর্মসংস্থান। যা নিঃসন্দেহে দেশের গোটা অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করে তুলছে।
×