ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আমতলীপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিক দেশসেরা

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ২৭ অক্টোবর ২০১৮

আমতলীপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিক দেশসেরা

জুলিয়া নাসরিন আর আমতলীপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিক এখন একে অপরের অবিচ্ছেদ্য হয়ে গেছে। স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে ক্লিনিকটি দেশ সেরা। স্বাস্থ্যকর্মী জুলিয়ার অনন্য সুখ্যাতির অর্জন। কর্মের মধ্য দিয়ে মানুষ তাকে কতটা উচ্চ শিখরে নিয়ে যেতে পারে তার বাস্তবতা জুলিয়া নাসরিন। পটুয়াখালীর কলাপাড়ার অজপাড়াগাঁয়ের এই কমিউনিটি ক্লিনিকটি এখন দেশের বাইরের দাতা সংস্থা পরিদর্শন করেন। দেখেন জুলিয়া নাসরিনের সাফল্য, কর্মপন্থা। আর দশটা ভবনের মতো কোনমতে দাঁড়িয়ে আছে ভবনটি। কিন্তু নিরাপদ মাতৃ স্বাস্থ্যের বিশেষ অবদানে ক্লিনিকটি এখন দেশের সবার কাছে পরিচিত। জুলিয়া নিজেও খ্যাতির শিখরে রয়েছেন। শেকড়ের প্রসূতি মায়েদের স্বাভাবিক নিরাপদ প্রসব সেবায় শতভাগ সফলতার মধ্য দিয়ে প্রসূতি সেবাও শিখরে নিয়ে গেছেন। শুধু তাই নয়, সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার উদ্যোগ গ্রামীণ প্রসূতি সেবাকে এক অনন্য উচ্চতায় তুলেছেন জুলিয়া। প্রমাণ করেছেন, ‘শেখ হাসিনার অবদান কমিউনিটি ক্লিনিকে বিশ্বমানের সেবাদান।’ জুলিয়ার স্বীকৃতি পৌঁছে গেছে সরকারের উন্নয়নের সাফল্যগাথায়। একজন মাঠ কর্মী শুধু ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর একাগ্রতায় গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রসূতির নিরাপদ প্রসবসেবা কীভাবে পেয়েছেন, তা না জানলে কিংবা চোখে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। জুলিয়া এখন প্রসূতির নির্ভরতার প্রতীকে পরিণত করেছেন। তার হাতের স্পর্শে স্বস্তি পান গর্ভবতী মায়েরা। যেন মাতৃ স্বাস্থ্য সেবার বাতিঘর জুলিয়া নাসরিন। ইস্পাত কঠিন মনোবল, আর দৃঢ়তা নিয়ে শুরু করেন জুলিয়া। ২০০৪ সাল। তখন ধুলাসারে কর্মরত ছিলেন। নিরাপদ মাতৃৃসেবা পৌঁছে দেয়ার যাত্রা করেন। নিভু নিভু চলছিল। থেমে থাকেননি। গ্রামীণ, চরাঞ্চলখ্যাত সাগরমোহনা রাবনাবাদ পাড়ের জেলে, হাইলা-কামলা শ্রেণীর মানুষকে পরামর্শসহ স্বাস্থ্যসেবার মানসিকতায় গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। দশটি বছর লেগে থেকেছেন। অসচেতন, তারপরে অতিদরিদ্র মানুষের বসতি। তাদের ক্লিনিকমুখী করার কাজটি ছিল খুব দুরূহ। জুলিয়া দমে থাকেননি এবং মনোবলও হারায়নি। ২০১৩ সাল, ৬ মার্চ। ফের নতুন যাত্রা। জুলিয়ার নতুন কর্মস্থল জীর্ণদশার আমতলীপাড়ার কমিউনিটি ক্লিনিকে। জানান, ভগ্নদশার একতলা ভবনটি ছিল পরিত্যক্ত। লতাপাতায় ঢেকে ছিল। পরিষ্কার করার সময় ১৪টি সাপ মারতে হয়েছে। ওই ভবনে কাজ শুরু করেন। যেন কর্মজীবনের উজানের নাও বাওয়া। মাঝিও নিজে। এক হাতে বৈঠা, অপর হাতে পাল তোলার কাজ। অদম্য ব্রত নিয়ে এখানে শুরু করেন প্রসূতি মায়েদের এগিয়ে নেয়ার কাজ। তাদের অনাগত সন্তানের পৃথিবীতে আগমন যাত্রা নিরাপদ করতে গর্ভবতী মায়েদের একটি সামাজিক ক্যালেন্ডার করেন। যেখানে চিহ্নিত করলেন চেকআপ পিরিয়ড। কোন্ মায়ের, কোন্ সময় কী চেকআপ করা দরকার তা চিহ্নিত করেন। এমনকি যাদের এক মাসের মধ্যে প্রসব হবে সেই সব প্রসূতির নামসহ ওই পয়েন্টে করলেন লাল টিপের চিহ্ন। স্বকীয় কর্মপন্থায় পথ চলা। ক্লিনিক ভবনটি উপজেলা পরিষদসহ এমএনএইচ প্রোগ্রামের সহায়তার কিছুটা সংস্কার করালেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে গর্ভবতী মায়েদের সঙ্গে পরামর্শ করে তাদের কাছে জুলিয়া নিজেকে গর্ভকালীন নিরাপদ সেবী এবং আস্থার প্রতীকে পরিণত হয়ে ওঠেন। একেক করে ক্লিনিকে এসে প্রসূতিরা নিরাপদ প্রসব করতে শুরু করলেন। শঙ্কা নিয়ে ক্লিনিকে যাওয়া দম্পতিরা সুস্থ নবজাতক নিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরতে শুরু করে। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি জুলিয়াকে। ফি মাসে ২০-২৫ প্রসূতি নিরাপদে স্বাভাবিক প্রসব করে চলেছেন। গরিব দম্পতিরা মাত্র ওষুধের টাকা ব্যয় করছেন। তাও এক-দেড় থেকে সর্বোচ্চ দুই হাজার। আর জুলিয়াকে মিষ্টিমুখ করানো। জুলিয়ার স্বস্তি রাত-দিন শেষে ওদের সঙ্গে একটু হাসিমুখের অংশগ্রহণ। সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছতে যেন নেশায় ধরে জুলিয়াকে। জুলিয়ার হাতের স্পর্শে প্রসূতিরা স্বস্তির পরশ খুঁজে পায়। ভরসা পায় জুলিয়াকে কাছে দেখে। আর মানবতার এই কর্মের স্বীকৃতিরও স্পর্শ মেলে জুলিয়ার। ২০১৪ সাল। স্বাস্থ্য বিভাগ পটুয়াখালী জেলার নিরাপদ স্বাভাবিক প্রসবে প্রথম স্থানের স্বীকৃতি দেয়। ২০১৬ সালে বরিশাল বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন। আর গোটা বাংলাদেশে দ্বিতীয় স্থান। যেন সাফল্যের আরেক পালক তাকে স্পর্শ করে। উৎসাহের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। প্রেরণা পায় এই অদম্য স্বাস্থ্য কর্মী। ২০১৭ সালে ধরা দেয় ঈর্ষণীয় সাফল্যের স্বীকৃতি। দেশসেরা। এক বছরে ৩৫৬ প্রসূতির স্বাভাবিক প্রসব করান কমিউনিটি ক্লিনিকে। আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রেস্টসহ সনদ গ্রহণ করেন জুলিয়া নাসরিন। এখন এ নামটি স্বাস্থ্য বিভাগের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার মুখে মুখে। কোন সভায় অন্যদের উৎসাহ দিতে এ নামটি মুখে তুলতে ভোলেন না উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা। জুলিয়া জানান, তিনি কর্মকে নির্দিষ্ট ছকে রাখেননি। এক কথায়, মুখস্থ বলতে পারেন তার কর্ম এলাকায় কোন গর্ভবতী মায়ের বর্তমান হাল-হকিকত। কবে কার সন্তান প্রসব হবে। জুলিয়া তার দুই বিশ^স্ত হাতে এ পর্যন্ত ১২৪২ প্রসূতিকে স্বাভাবিক প্রসব করিয়েছেন। আর সব নবজাতক এখন সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে রয়েছে। বললেন এমনও আছে ভাই, ‘আমি না থাকলে প্রসূতিরা অপেক্ষা করেন। কষ্ট করেন, গর্ভকালীন ব্যথা (বেদনা) নিয়ে অপেক্ষা করেন। এখন আমতলী কমিউনিটি ক্লিনিকটি যেমন স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে একটি উদাহরণ হয়ে আছে। তেমনি জুলিয়া নাসরিন নামটিও জ¦লজ¦ল করছে। ক্লিনিক এলাকার গর্ভবতী কিংবা ১৪ সাল থেকে ১৭ সাল পর্যন্ত স্বাভাবিক প্রসবের মাধ্যমে জন্ম দেয়া শিশুর পরিবারের কাছে তিনি সবচেয়ে নিরাপদ সেবিকা। পেয়েছেন একাধিক সংবর্ধনা এই স্বাস্থ্যকর্মী। একজন স্বাস্থ্যকর্মী তার কর্মকে নিয়ে গেছেন সাধারণ মানুষের দুয়ারে। স্থানীয়দের দাবি, কলাপাড়া হাসপাতালে গিয়ে তাদের একজনের স্বাভাবিক প্রসবেও অন্তত পাঁচ হাজার টাকা খরচ হতো। আর সিজার করলে অন্তত ২০-২৫ হাজার টাকা ব্যয় হতো। সেখানে তারা সময় ও অর্থ ব্যয় থেকেও রক্ষা পেয়েছেন। এলাকার চেয়ারম্যান এবিএম হুমায়ুন কবির জানান, রাত-দিন নেই। জুলিয়া নাসরিন আমাদের এলাকার গর্ভবতী মায়েদের কাছে একটি নির্ভরতার প্রতীক হয়েছেন। যে কোন প্রসূতির যখন সমস্যা মনে হয় তখন জুলিয়া নাসরিন তাদের কাছে ভরসার নাম। সে আমাদের এলাকার মায়েদের সম্পদ। -মেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া থেকে
×