ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

প্রবাসীর জন্য ভালবাসা

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৭ অক্টোবর ২০১৮

প্রবাসীর জন্য ভালবাসা

বিদেশে বাংলাদেশের কোন ভ্রমণকারীর জন্য সবচেয়ে করুণ দৃশ্য হলো মধ্যপ্রাচ্যের কোন বিমানবন্দরে কোন প্রবাসী কর্মীর সঙ্গে দৃষ্টিবিনিময় বা পরিচয় হওয়া। এদের বেশিরভাগই পরিচ্ছন্ন কাজে নিয়োজিত। বাংলাদেশের নাগরিক মনে হলেও এরা ভ্রমণকারীর দিকে যে দৃষ্টিতে তাকায় তার মধ্যে বড় একটা অপ্রকাশিত আকুতি আছে। আমার বিশ্বাস নীতিনির্ধারণে নিয়োজিত বাংলাদেশের ভ্রমণকারীদের কেউ এই অভিজ্ঞতার বাইরে নন, তারা তা দেখেছেন কিন্তু উপায় চিন্তা করেছেন সামান্যই। এসব কর্মীকে আমরা ইঙ্গিত করি ‘অদক্ষ’ বলে! অদক্ষ হলে সে ওই চাকরিটা করে কিভাবে! সে অবশ্যই দক্ষ কিন্তু প্রশ্নটা অন্যখানে। আমরা আদৌ এদের নিয়ে ভাবি কি-না। আর ভেবে থাকলে তার প্রতিফলন কোথায়? বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রায় এক কোটি প্রবাসী এক হাজার ৪৯৮ কোটি (১৪.৯৮ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের চেয়ে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এক হাজার ২৭৭ কোটি (১২.৭৭ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। এর মানে হলো, এই বৈদেশিক আয় বাড়ার সুযোগ বাংলাদেশের আছে; কিন্তু যে পদক্ষেপগুলো নিলে তা নিশ্চিত হবে আমরা তা নিচ্ছি কী-না। তার চেয়ে বড় কথা এই যে, শত সহস্র তথাকথিত ‘অদক্ষ’ শ্রমশক্তি বিদেশে গিয়ে মান অপমান ভুলে প্রখর সূর্যালোকে তপ্ত মরুভূমির আগুন সহ্য করে আয়ের টাকা দেশে পাঠাচ্ছেন তাদের জন্য আমরা কতখানি মানবিক? আমরা এদের জন্য এখনও মানবিক হতে পারিনি। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যে কাজে যুক্ত হবার আদ্যোপান্ত একজন শ্রমজীবীর মুখ থেকে যদি শোনা যায় দেখা যাবে পদে পদে কীরকম অমানবিকতার চিহ্ন। সেই দালাল চক্র থেকে শুরু হয়ে, পাসপোর্ট অধিকার পেয়ে, টাকা জমা দিয়ে মাসের পর মাস বসে থেকে, মেডিক্যালের নামে প্রহসনের রিপোর্ট জমা দিয়ে শেষ পর্যন্ত যখন মা-বাবা-ভাই-বোন ও পরিজন ছেড়ে যায় ততদিনে গড়ে দুই বছর সময় লাগে এরকম গবেষণা প্রতিবেদন অজস্র আছে। যাবার দিন বিমানবন্দরে যে হয়রানি, তুই-তুকারি আর ধমক তা সম্বল করেই চোখের পানি মুছতে মুছতে বিমানে ওঠে। গত চল্লিশ বছরে আমরা কি তার সামান্য পরিবর্তন আনতে পেরেছি? বিদেশের মাটিতে পা রেখেই শুরু হয় আর এক বালুভূমির উত্তপ্ত জীবন। এক ঘরে গাদা দিয়ে বসবাস, দিনরাত কঠিন কায়িক পরিশ্রম আর হিসাব করে করে, খেয়ে না খেয়ে টাকা জমানো। একটা ফোন করে মায়ের সঙ্গে কথা বলতেও টাকার হিসাব তাকে করে নিতে হয়, সঙ্গে সব কথা বলা শেষ না করতে পারার বেদনাও। এদের বড় অপরাধ এরা ‘অশিক্ষিত’। তাই ‘শ্রমের মর্যাদা’ বলে রচনা বইয়ে আমরা যা পড়ে থাকি তার কোন কিছু এদের জন্য প্রযোজ্য নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কম লেখাপড়া জানলে সে ‘অশিক্ষিত’ বা ‘অদক্ষ’ তা প্রমাণ হয় না। আমি নিজে যাচাই করে দেখেছি মধ্যপ্রাচ্যে অনেক বিমানবন্দরে এয়ারলাইন্সের সহায়ক কর্মী ভারতীয় বা ফিলিপিন্স বা শ্রীলঙ্কান, যাদের স্কুল-কলেজের তেমন লেখাপড়া নেই কিন্তু শুধু ইংরেজীতে কথা বলা জানে বলে তারা স্যুট-টাই পরে এই চাকরিটা করছে। তারা লেখাপড়া করেছে বিশেষ কারিগরি স্কুলে যেখানে কেবল আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের উপযোগী বিশেষ কারিকুলাম অনুসরণ করা হয়। আমাদের কারিগরি শিক্ষা বলে একটা বিশেষ ব্যবস্থা আছে যার কারিকুলাম আর মূল্যায়নপত্র মিলিয়ে দেখলে বুঝা যাবে এই শিক্ষাদানের পরিকল্পনা কত অবাস্তব। তাদের আগারগাঁও অফিস থেকে সংগ্রহ করা একটা লম্বা লিস্ট আমার কাছে আছে যা দেখলে বঙ্গ দেশের কোন সন্তান এরকম কারিগরি স্কুল দিতে একবিন্দু আগ্রহী হবে না। ফলে যা চলছে তা কার্যকরী এমন কথা বলা যাবে না। চিন্তা করা দরকার আমাদের রাজমিস্ত্রি কাজের যোগালি হিসেবে যেসব কর্মী আমরা পাঠাই তাদের কি আমরা প্রশিক্ষণ দেই নাকি দরকার হয় না? দরকার হয় না, কারণ বাংলাদেশের এসব মানুষ কাজ করে তাদের কমনসেন্স দিয়ে। অথচ সংগঠিত প্রশিক্ষণ পেলে এরা কী-না করতে পারত? ইংরেজী শিক্ষা বা কথন শিক্ষা কী এমন জটিল যে আমরা এদের তা দিতে পারি না? আরব দেশের জন্য কি আমরা তাদের আরবী শিক্ষা দিতে পারি না? যেটা দেয়া হয় খোঁজ-খবর নিয়ে জেনেছি তার সঙ্গে বাস্তব আরবী ভাষা বা উচ্চারণের কোন মিল নেই। উল্টো ভুল আরবী বলার কারণে মরুভূমির চাকরিদাতা মনিবের মারধরও খেতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী আমরা প্রতি বছর যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করি তার সিংহভাগ আসে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকেই। আমাদের জিডিপির ১২ শতাংশ অবদান এই প্রবাসীদের। বিশ্ব ব্যাংকের অনুমিত হিসাবে স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে বিশ্ব রেমিটেন্স বৃদ্ধি পেয়েছে ৮.৫ ভাগ যার ফলে মোট রেমিটেন্স আয় দাঁড়িয়েছে ২০১৬ সালের ৪২৯ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪৬৬ বিলিয়ন ডলারে। এর মধ্যে বাংলাদেশের আয় ৩.২১ ভাগ। চিন্তা করা দরকার এর কতখানি বছরভিত্তিক আমরা বাড়াতে পারি। অনেকে বলেন, অশিক্ষা ও কুসংস্কারের এই দেশে উন্নত ও মানসম্পন্ন শিক্ষা বিস্তার সময়সাপেক্ষ। এই মত কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা অনেক সময় নষ্ট করেছি ভুলের চোরাবালিতে। না বুঝে অনেক অযোগ্য যুক্তি তৈরি করে বিশ্ববাজারে নিজেদের পিছিয়ে রেখেছি। ২০১৭ সালের বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত রেমিটেন্স আয় করে ৬৯ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকেই ভারত রেমিটেন্স নেয় ১০ বিলিয়ন ডলার (যা আমাদের রেমিটেন্স আয়ের ৬৭ ভাগ)। নাইজিরিয়ার বার্ষিক রেমিটেন্স আয় ২২ বিলিয়ন ডলার, ফিলিপিন্সের আয় ৩৩ বিলিয়ন ডলার। তাহলে আমাদের আয় এত কম কেন? জনসংখ্যার অনুপাতে আমরা তো কম নই! আমাদের মূল সমস্যা পরিকল্পনার আর ভালবাসার। সাধারণ মানুষের প্রতি আমাদের ভালবাসা কেবলই রাজনৈতিক। এটা যদি মানবিক হতো, তাহলে আমাদের চিন্তা হতো অন্যরকম। আমরা সুযোগ সন্ধান করি না, একই সুযোগের বারবার ব্যবহার করি, ফলে উন্নয়নের নতুন ও উদ্ভাবনী চিন্তা আমাদের কাছে ধারেও ঘেঁষতে পারে না। বর্তমান সরকারের উন্নয়ন দর্শনে ডিজিটাল বাংলাদেশের চিন্তা আমাদের বৈদেশিক কর্ম-সংস্থানের জন্য বড় সুযোগ। কিন্তু আমাদের পরিকল্পনায় এখনও ঠাঁই পায়নি তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিশ্ববাজারে শ্রমশক্তি প্রবেশের। কিন্তু এমন নয় যে, জ্ঞান সমাজে শ্রম শক্তির প্রয়োজন অপেক্ষাকৃত কম। আমরা দেশে বসে সফটওয়্যার তৈরি করে বিদেশে রফতানি করব; কিন্তু নানারকম প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে পারিনি। বিদেশে অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে শ্রমশক্তি নিয়োগের সুযোগ আছে ও বাংলাদেশের সেসব সুযোগ নেবার অবকাশ আছে। অথবা যদি উল্টো করেও চিন্তা করি, যে পরিমাণ রেমিটেন্স আমরা খেটে-খুটে আনি তা কেন ধরে রাখতে পারছি না? এখানেও আমাদের দুর্বল পরিকল্পনা। কারণ, জাতি হিসেবে আমরা এই ভেবে লজ্জা পাই না যে, আমরা কষ্টার্জিত টাকা বিনিয়োগ করে কারখানা করি আর সেখানে কাজ করে বিদেশের লোক। অথচ আমাদের জিডিপির ১২ শতাংশ আনে এই দেশের শ্রমশক্তি, যারা প্রবাসে থাকেন আর যাদের বেশিরভাগ দরিদ্র্যসীমার নিচের লোক। তাদের টাকায় এই দেশ চলে, আমরা বাহাদুরী করি; কিন্তু আমাদের সম্মানের কোন প্রশ্ন নেই, ভালবাসা নেই, এমনকি ওই যে প্রবাসী বছর ঘুরে দেশে আসে বিমানবন্দরে তার জন্য কতই না অপমানের বিপত্তি করে রেখেছি। আমাদের দরকার কারিগরি শিক্ষার প্রতি মনোযোগী হওয়া। দেশের সব লোককে আমরা বিএ, এমএ পাস করাতে ব্যস্ত কিন্তু ভাবছি না কাজের সুযোগটা কোথায়! সামান্য কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করে আর একটু ভাষা শিখিয়ে কাজের উপযোগী করা মোটেই জটিল নয়। এর সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির সংযোগ ঘটিয়ে বিদেশে কাজের সুযোগ বের করে দেই আর দেশে থাকার পরিবেশ দেই তাহলে আমাদের ঠেকাবে কে! এই কার্যকর কারিগরি জ্ঞান দেশে এবং বিদেশে আমাদের কর্মযোগ ঘটাতে আর আয় বাড়াতে অনেক বড় ভূমিকা রাখবে। নিঃসঙ্গ প্রবাসীর চোখের পানি মুছাতে আর মানুষের প্রতি ভালবাসা প্রকাশে মানবিক হতে আমাদের কোন বাধা থাকবে না। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×