ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রকৌশলী প্রাঞ্জল আচার্য্য

শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথি

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথি

‘স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণ, কৃষ্ণ সর্বাশ্রয় পরম ঈশ্বর কৃষ্ণ, সর্ব শাস্ত্রে কয়।’ (চৈঃচঃ আঃ ২/১০৬) আজ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথি জন্মাষ্টমী। ‘জন্মাষ্টমী’ শব্দটি শুনলে মনে হতে পারে অষ্টমী তিথিতে ভগবানের জন্ম হয়েছে। কিন্তু তা নয়, ভগবান কখনও জন্মগ্রহণ করেন না। তিনি জন্ম রহিত। তিনি বিশেষ প্রয়োজনে আবির্ভূত হন। শ্রীমদ্ভাগবতে (১০/৩/৮) বলা হয়েছে, ‘সকলের হৃদয়ে বিরাজমান ভগবান শ্রীবিষ্ণু পূর্বদিকে উদিত পূর্ণ চন্দ্রের মতো গভীর অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতে সচ্চিদানন্দ স্বরূপিনী দেবকী মাতার হৃদয়ে আবির্ভূত হলেন।’ অন্য সব শিশু যেভাবে মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয় সেভাবে নয়। যেভাবে পূর্বদিকে পূর্ণ চন্দ্র উদিত হয় ঠিক সেভাবেই দেবকী মাতা মনের দ্বারা সর্বাত্মা শ্রীবিষ্ণুকে ধারণ করলেন (ভা. ১০/২/১৮)। পূর্বদিকের সঙ্গে চন্দ্রের সংযোগ শুধুই মানুষের ভ্রম, বাস্তবে চন্দ্রের সঙ্গে পূর্বদিকের সরাসরি কোন সংযোগ নেই। তেমনই দেবকী মাতার শ্রীকৃষ্ণকে গর্ভে ধারণ। আর সেই গর্ভ থেকেই শ্রীকৃষ্ণের প্রকাশ। আবার সূর্যাস্তের পর সূর্যকে দেখা না গেলেও সূর্য কিন্তু ঠিকই থাকে। তা কোন কোন দেশ, স্থান বা কোন কোন মানুষের কাছে অদৃশ্য। তাই বলে সূর্য কিন্তু বিনাশ হয়ে যায় না। ঠিক তেমনই ভগবানের আবির্ভাব বা তিরোভাব লোকচক্ষের প্রতীতি মাত্র। অনেক সময় দেখা যায় কিছু মানুষ সগর্বে বলে আমি ভগবান মানি না। তারা মানবেইবা কি করে? কারণ, তাদের ভগবানকে জানার বা মানার বুদ্ধিমত্তার অভাব। গীতায় ভগবান বলেছেন- ‘অবজানন্তি মাং মূঢ়া মানুষিং তনুমাশ্রিতম্। পরম ভাবমজানন্তো মম ভূতমহেশ্বরম্।।’ (গীতা ৯/১১) অর্থাৎ ‘আমি যখন মনুষ্যরূপে অবতীর্ণ হই তখন মূর্খেরা আমাকে অবজ্ঞা করে। তারা আমার পরমভাব সম্বন্ধে অবগত নয় এবং তারা আমাকে সর্বভূতের মহেশ্বর বলে জানে না।’ ব্রহ্ম সংহিতায় ব্রহ্মাজী ঘোষণা করেছেন- ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দ বিগ্রহঃ। অনাদিরাদির্গোবিন্দঃ সর্বকারণকারণম্। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণই পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং, অনাদিরাদি পুরুষ। অনন্ত কোটি বিশ্বব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি, পালন ও ধ্বংস যার ইচ্ছাতেই হয়। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন- ‘যদা যদা হি ধর্মস্য, গ্লানির্ভবতি ভারত অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।’ (গীতা ৪/৭) ‘যখনই ধর্মের অধঃপতন হয় এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয় তখন আমি নিজেকে প্রকাশ করে অবতীর্ণ হই।’ তিনি হচ্ছেন স্বরাট। তাঁর ইচ্ছা ও প্রয়োজনে তিনি যে কোন জায়গায়, যে কোন অবস্থায় যে কোন রূপে অবতরণ করতে পারেন; কিন্তু সেই ঘটনা বিরল। কারণ, তিনি ব্রহ্মার একদিনে অর্থাৎ প্রতি ৮৬০ কোটি বছরে সপ্তম মনুর অষ্টবিংশতি চতুর্যুগে দ্বাপরের শেষে স্বরূপে আবির্ভূত হন। চৈতন্যচরিতামৃতে ভগবানের অবতার সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘সৃষ্টি হেতু যেই মূর্তি প্রপঞ্চে অবতরে সেই ঈশ্বর মূর্তি অবতার নাম ধরে।’ (চৈঃচঃ মধ্য ২০/২৬৩) কখনও কখনও তিনি তাঁর সন্তান অথবা ভৃত্যরূপে তাঁর প্রতিনিধিকে প্রেরণ করেন অথবা কখনও তিনি ছদ্মবেশে অবতরণ করেন। বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে- ‘কৃষ্ণাষ্টম্যাং ভবেদযত্র কলৈকা রোহিনী নৃপ জয়ন্তী নামসা হেয় উপোষ্যা সাপ্রযত্মতঃ।’ শ্রাবণ বা ভাদ্র মাসের যে কৃষ্ণপক্ষের তিথিতে রোহিণী নক্ষত্র সংযুক্ত হয় সেই বিশেষ তিথিই শ্রীকৃষ্ণ জয়ন্তী। কারণ, স্বয়ং ভগবান এই তিথিতেই আবির্ভূত হয়েছেন বলে তিথিটি সব পাপহারিণী হিসেবে প্রসিদ্ধ। তাই এ তিথিতে মানব মাত্রই উপবাস ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ অচর্না করবেন এটা শাস্ত্রেরও বিধান। উপাখ্যানে বর্ণিত আছে- বিশিষ্ট মুনি মহারাজ দিলীপকে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব লীলার কথা বলেছিলেন। দ্বাপর যুগে কংসের অত্যাচারে উৎপীড়িত হয়ে ধরিত্রীদেবী দেবাদিদেব মহাদেব ও দেবী দুর্গার কাছে উপস্থিত হয়ে কংসের অত্যাচারের কথা জানালেন। সকল কথা শুনে মহাদেব ও দুর্গাদেবী দুঃখিত ও ক্রুদ্ধ হয়ে ব্রহ্মাজীকে এর প্রতিকার করার জন্য বললেন। কারণ, এক সময় কংস মহাদেবের আরাধনা করে মহাদেবকে সন্তুষ্ট করলে মহাদেব এই বর দেন যে, ভাগিনের হস্ত ছাড়া কংসের নিধন নেই। তাই ব্রহ্মাজী সকল দেবতাকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষীর সমুদ্রে ভগবান নারায়ণের কাছে গিয়ে ভক্তিভরে স্তব করতে লাগলেন। এতে ভগবান বিষ্ণু সন্তুষ্ট হলেন এবং এর কারণ জানতে চাইলে ব্রহ্মা সকল দেবতাকে সঙ্গে নিয়ে প্রার্থনা করলেন- হে করুণা সিন্ধু আপনি অন্তর্যামী, সবই জানেন। আপনি ইচ্ছা করা মাত্রই কংসকে বধ করতে পারেন। কিন্তু আপনি লীলাময়। লীলার মাধ্যমে জগতকে শিক্ষা দেয়ার জন্য আপনি লীলা করেন। আর তাই অত্যাচারী কংসকে নিধন করার জন্য তার বোন দেবকী মাতার সন্তানরূপে আপনাকে লীলা করার জন্য আমাদের সকলের বিনীত প্রার্থনা। এতে সকল দেবতা ও ব্রহ্মাজীর প্রার্থনায় ভগবান নারায়ণ সম্মতি দান করেন-‘তথাস্তু’। তখন মহাদেব মহামায়া দুর্গা দেবীকে মর্ত্যলীলায় নারায়ণের সঙ্গে অংশগ্রহণ করার জন্য আহ্বান করেন। মর্ত্যলীলা করার জন্য তখন ভগবান নারায়ণ এবং মহামায়া দুর্গা মর্ত্যে আবির্ভূত হলেন। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের রোহিণী নক্ষত্র সংযুক্ত অষ্টমী তিথির মধ্যরাতে প্রবল ঝড়-বৃষ্টির সময় মথুরায় অত্যাচারী কংসের কারাগারে ভগবান নারায়ণ স্বয়ং শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারীরূপে, সচ্চিদানন্দ স্বরূপিনী দেবকী মাতার হৃদয়ে আবির্ভূত হলেন। মাতা দেবকী ও বসুদেব দেখলেন স্বর্ণোজ্জ্বল পীত বসন পরিহিত, গলে পদ্ম ফুলের মালা, বক্ষে শ্রীবৎস চিহ্ন ও কৌস্তবমণি শোভিত, মাথায় বৈদুর্যমণি খচিত মুকুট, গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম ও নানা রতœ-মণিখচিত দিব্য অলংকারাদি দ্বারা অঙ্গ বিভুষিত। ঐ শিশুর অসাধারণ রূপ দর্শন করে বসুদেব ও দেবকী বিস্ময়ে অভিভূত হলেন এবং প্রার্থনা করলেন –‘হে প্রভু আমরা তোমাকে পুত্ররূপে পেতে চেয়েছিলাম, আমাদের মনোভিলাস পূর্ণ কর।’ তৎক্ষণাৎ তিনি একটি সদ্যোজাত শিশুর রূপ ধারণ করলেন। আর গোকুলে মহামায়া দুর্গাদেবী যশোদার গৃহে আবির্ভূত হলেন। মহামায়ার মায়ায় কংসের কারাগারের কারারক্ষীগণ নিদ্রাচ্ছন্ন হলেন। তখন বসুদেবের প্রতি দৈববাণী হলো, তিনি যেন তাঁর নবজাত পুত্রকে গোকুলে যশোদার কোলে দিয়ে আসেন এবং যশোদার নবজাত কন্যাকে দেবকীর কাছে নিয়ে আসেন। তখন প্রবল ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত উপেক্ষা করে বসুদেব ভীষণ খরস্রোতা যমুনা নদীতে শৃগাল রূপ ধারণকৃত মহামায়ার পিছনে হেঁটে পার হয়ে গোকুলে গেলেন। সেই সময় বসুদেব গোকুলে মহামায়ার আবেশে নিদ্রাভিভূত রাজঅন্তঃপুরে শ্রীকৃষ্ণকে রেখে আসেন এবং সদ্যোজাত যশোদার কন্যাকে নিয়ে এসে মথুরায় কংসের কারাগারে দেবকীর কোলে দিয়ে দেন, আর সঙ্গে সঙ্গেই কারারক্ষীগণ জেগে ওঠে এবং সদ্যোজাত শিশু কন্যার কথা কংসকে জানায়। কংস তখনই সেই শিশুকন্যাকে পাথরে আছড়ে মারার নির্দেশ দেন। যখন নবজাত কন্যাকে পাথরে আছড়ে মারতে উদ্যত হলো তখন শিশুকন্যা আকাশে দুর্গামূর্তি ধারণ করে কংসকে বললেন- ‘তোমাকে বধি যে, গোকুলে বাড়িছে সে।’ এই কথা বলেই মহামায়া দুর্গাদেবী তাঁর মর্ত্যলীলা শেষ করে মহাদেবের কাছে ফিরে যান। পরে শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে বিভিন্ন লীলা বিলাস করে যথাসময়ে মথুরায় কংসকে বধ করেন এবং ধরিত্রী মাকে শাস্তি প্রদান করেন। শ্রীমদ্ভাগবতে আছে- ‘এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ/ কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ং।’ দেখা যাচ্ছে সমস্ত বৈদিকশাস্ত্র, বেদ, উপনিষদ, পুরাণ ও মহাভারতে হাজার বছর আগেই শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর ভগবান বলে স্বীকার করা হয়েছে। যে নর-নারী এই শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমী ব্রত করেন তারা অতুল ঐশ্বর্য লাভ করে অন্তে বৈকুণ্ঠে গমন করেন। লেখক : ভক্তিশাস্ত্রী, মায়াপুর ইনস্টিটিউট অব হায়ার এডুকেশন, ইসকন ঢাকা
×