ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার ছাদে অক্সিজেন ফ্যাক্টরি

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 ঢাকার ছাদে অক্সিজেন ফ্যাক্টরি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মিতুল-মিন্তি দম্পতি তাদের বাসার ছাদে গড়ে তুলেছেন মনোরম একটি বাগান। ফল, ফুল, ঔষধি, সবজি, মসলা সবই আছে সেখানে। ছোট এ পরিসরে এক শ’রও বেশি গাছ লাগিয়েছেন তারা। ইট-পাথরের এ শহরে ভোর হলে পাখির কিচিরমিচিরে ভরে ওঠে তাদের বাড়ি। স্নিগ্ধ রুচির এ দম্পতি তাদের ছাদ বাগানের নাম দিয়েছেন ‘অক্সিজেন ফ্যাক্টরি’। রাজধানীর কল্যাণপুরের মিতুল-মিন্তির মতো এই শহরে অনেকেই এখন বাড়ির আঙিনা, ছাদ বা বারান্দায় একটু সবুজের ছোঁয়া রাখার দিকে ঝুঁকছেন। রাজধানী ঢাকার প্রায় প্রতিটি এলাকার বাড়ির বারান্দা বা ছাদ থেকে গাছপালার উঁকিঝুঁকি দেখা যায়। কেউ শখের বসে কেউবা পরিবেশ রক্ষায় সচেতনভাবেই বাসস্থানে গাছগাছালি রাখছেন। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এ সময়ের একটি বড় সমস্যা। বলা হচ্ছে, উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে যেসব দেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের ঝুঁকি বেশি, বাংলাদেশ তার সামনের সারিতে রয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ন ও বন উজাড় করা। ইট-পাথরের রাজধানী ঢাকায় সুউচ্চ ভবনের ঠাস বুনটে বড় গাছের দেখা পাওয়া বিরল ঘটনা। অথচ ঢাকার তাপমাত্রা যে হারে বাড়ছে তাতে লাগাম টানতে বেশি করে গাছ লাগানোর ওপর জোর দিচ্ছেন পরিবেশবিদরা। অপরিকল্পিত আবাসন এবং রাস্তাঘাট নির্মাণের ফলে কমে যাচ্ছে উন্মুক্ত স্থান, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমছে গাছপালা। এতে এ মহানগরীর তাপমাত্রা দিন দিন অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। বিশুদ্ধ অক্সিজেনের যোগান কমছে। ঢাকায় উন্মুক্ত স্থানের যথেষ্ট অভাব বলে খালি জায়গায় গাছ লাগানোর সুযোগ কম। এ অবস্থায় ভবনের ছাদে বাগান করে ঢাকার পরিবেশ পাল্টে দেয়া সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। মিতুল-মিন্তি দম্পতি তাদের বাসার ছাদে সব রকমের গাছই লাগিয়েছেন। তাদের এই ‘অক্সিজেন ফ্যাক্টরি’র ঔষধির মধ্যে আছে থানকুনি, তুলসী, তিন রকমের পুদিনা, এলোভেরাসহ অনেক কিছু। ফলের মধ্যে রয়েছে দুই রকমের আম, তিন রকমের পেয়ারা, মালবেরি, ড্রাগন ফ্রুট, থাই জামরুল, মালটা, লেবুসহ অনেক ধরনের ফলগাছ। মসলার মধ্যে রয়েছে অরিগানো, দারুচিনি, কারিপাতা, তেজপাতা, চুই এবং পোলাওপাতা। সবজির মধ্যে আছে ফুলকপি, চেরি টমেটো, স্কোয়াস, চায়না ক্যাবেজ, চায়না সুপারলিফ, চায়না লেটুস, বিভিন্ন ধরনের শাক, গাজরসহ অনেক সবজি। এ রকম বাগান করার কারণ তুলে ধরে মিন্তি বলেন,আমরা মানসিক চাপ থেকে ক্ত বা বিনোদনের জন্য অন্য কোথাও যাওয়ার প্রয়োজনই মনে করি না। বাসার ছাদের এই বাগান স্ট্রেস অনেকাংশে কমিয়ে দেয়। এছাড়া, এখান থেকে অক্সিজেন তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, আশার কথা হচ্ছে, আমাদের দেখাদেখি আশেপাশের বাড়িতেও বাগান হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে মেরুপ্রান্তের বরফগুলো দ্রুত গলছে বলে বারবারই সতর্ক করে আসছেন বিজ্ঞানীরা। যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া বিষয়ক দফতর, মার্কিন মহাকাশ সংস্থা এবং যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক ও এ্যাটমোসফেরিক এ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১৭ সাল ছিল এ যাবতকালের উষ্ণতম বছরগুলোর একটি। কয়েক বছর ধরে রাজধানীতে বাড়ির ছাদে বাগান তৈরিতে উৎসাহ তৈরি হয়েছে ব্যাপক আকারে। সুন্দর গৃহকোণ এবং বিশুদ্ধ অক্সিজেনপ্রাপ্তি তথা পরিবেশ রক্ষার উদ্দেশে অনেকেই এমন বাগান তৈরি করছেন। যাদের ছাদের সুবিধা নেই, তারা বাসার বারান্দায় টবে গাছ লাগাচ্ছেন। কৃষি অধিদফতর বলছে, ঢাকায় বর্তমানে প্রায় ৬ হাজার বাগান রয়েছে বিভিন্ন ভবনে। প্রতিদিনই সেই সংখ্যা বাড়ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন ঘোষণা দিয়েছেন, যারা বাড়ির ছাদে বা আঙিনায় বাগান গড়ে তুলবেন তাদের বাড়ির হোল্ডিং ট্যাক্স ১০ শতাংশ মওকুফ করা হবে। নগরবাসীর এমন বাগান তৈরিতে নানা তথ্য দিয়ে সহায়তা করছে কিছু অনলাইনভিত্তিক সংগঠন। এরমধ্যে রয়েছে ‘এসো বাগান করি’ এবং ‘সবুজ বাগান সোসাইটি’। এসব গ্রুপের সঙ্গে প্রতিনিয়ত মানুষ যুক্ত হচ্ছে বাগান করার আগ্রহ নিয়ে। এসব গ্রুপের সদস্যরা একে অপরকে গাছের পরিচর্যা থেকে শুরু করে বাগান করার বিষয়ে সবরকম সাহায্য করে থাকেন। পরিবেশবাদীদের সংগঠন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সভাপতি আবু নাসের খান বলেন, ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ঢাকা শহর ধীরে ধীরে হট চেম্বারে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু একটু উদ্যোগী হলেই আমরা ইটের বস্তি ঢাকাকে বাগানে পরিণত করতে পারি। ক্রমাগত বৃক্ষ নিধনের ফলে ঢাকা মহানগরী আশঙ্কাজনক হারে বৃক্ষশূন্য হয়ে আসছে। ফলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ঢাকার তাপমাত্রা বাড়ছে, জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া, ছাদে বাগান থাকলে পরিবারের একটি বিনোদনের জায়গাও গড়ে ওঠে; সবার মধ্যে মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়। বাচ্চাদের গাছপালা ও পশুপাখির প্রতিও ভালবাসা বাড়ে। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে নগরবাসীকে কারিগরি সহযোগিতার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেমন, ছাদে বাগান করলে দেয়াল ড্যাম্প হতে পারে। সেক্ষেত্রে কী করলে তা এড়ানো যায়, তার পরামর্শ দিয়ে নগরবাসীকে সহায়তা সরকারীভাবেই করা যেতে পারে। এছাড়া, হোল্ডিং ট্যাক্স কমানোর মতো নানারকম সুযোগ-সুবিধা এ কাজে আরও উৎসাহ বাড়াতে পারে। শিক্ষা ভবন সংলগ্ন রাস্তার দুপাশে রয়েছে কয়েকটি নার্সারি। সেখানকার চারা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গাছের সঙ্গে মানুষের আত্মীয়তা বেড়েছে। প্রতিদিন প্রচুর চারাগাছ বিক্রি হয়। এর মধ্যে ফুল এবং ফল গাছের চাহিদা বেশি। এই এলাকার চারা বিক্রেতা নাসিম বলেন, নানারকমের মানুষ আসে। কেউ বাসা সাজানোর জন্য ফুল গাছ নেয় আবার কেউ চাষ করার জন্য ফল গাছ। এই সিজনের আগে আম গাছের চারা বিক্রি করলাম অনেক। ফলের মধ্যে পেয়ারা আর লেবু গাছের চাহিদা বেশি। অনেকে আবার সারও খোঁজেন। এর পাশাপাশি নানা রঙের টবও চান অনেকে।
×