ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জন্মগত অন্ধত্ব

প্রকাশিত: ০৪:১৪, ৩১ আগস্ট ২০১৮

জন্মগত অন্ধত্ব

বাংলাদেশে মা ও শিশুর অপুষ্টির বিষয়টি সুবিদিত। তাই বলে একেবারে অন্ধত্বের ঝুঁকি নিয়ে সাড়ে ১২ ভাগ শিশুর জন্মগ্রহণের বিষয়টি রীতিমতো উদ্বেগজনক বৈকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষ অন্ধত্ববরণ করছে, যার মধ্যে ৪৮ হাজার শিশু-কিশোর। প্রতি হাজারে শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ শিশু জন্মগত অন্ধত্বের শিকার। আর এসব শিশুর ২০ শতাংশের বসবাস গ্রামাঞ্চলে, জন্মের পর যাদের চক্ষু চিকিৎসক দেখানোর কোন সুযোগ থাকে না। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞসহ জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ভাষ্যে জানা যায়, শিশুদের অন্ধত্বের প্রধান কারণ মাতৃগর্ভের অপুষ্টি। ২৪, ২৮ বা ৩০ সপ্তাহের মধ্যে যেসব অপরিণত শিশু জন্মগ্রহণ করে তাদের চোখের গঠনসহ রক্তনালী পরিপূর্ণ হয় না। সেজন্য সবার আগে চাই গর্ভবর্তী মায়েদের পুষ্টিকর সুষম খাবার নিশ্চিত করা। মায়ের দুধে শিশুর জন্মগত অধিকার। জন্মের পরপরই নবজাতককে মায়ের দুধ পান করানো হলে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। অপুষ্টিতে আক্রান্তের সম্ভাবনা দূরীভূত হয়। অন্যদিকে মায়ের শরীর-স্বাস্থ্যও ভাল থাকে। তবে মা ও শিশুস্বাস্থ্যের অপুষ্টির বিষয়টি এখনও রয়ে গেছে। প্রসূতি মৃত্যুর হারও কমেনি। অন্যদিকে ৫ বছর বয়সী অর্ধেক শিশু ভোগে অপুষ্টিতে। দেশে প্রতিদিন প্রায় ১৬ নারী মারা যান সন্তান প্রসব করতে গিয়ে। এই হিসাবে প্রতিবছর ৫ থেকে ৭ হাজার নারীর মৃত্যু ঘটে, যাকে বলে প্রসূতিমৃত্যু। বাংলাদেশ বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়নে অনেকটা অগ্রসর হলেও অনেকাংশে পিছিয়ে আছে এদিক থেকে; যা হতে পারে এসডিজি বা টেকসই উন্নয়নে প্রতিবন্ধক। সমাজে প্রচলিত নারীর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, বাল্যবিয়ে, কুসংস্কার ও অজ্ঞানতা, ক্ষুধা ও অপুষ্টি, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অপ্রাপ্তি, সর্বোপরি সন্তান প্রসবে অপর্যাপ্ত সুযোগ ও অকারণে সিজার প্রধানত প্রসূতি নারী এবং শিশুর অকালমৃত্যুর অন্যতম কারণ। দেশে সরকারীভাবে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয়ও খুব কম; জিডিপির শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ মাত্র। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বাজেট বরাদ্দে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির ৫ শতাংশ হওয়া বাঞ্ছনীয়। মা ও শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষায় এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যায় জাতিসংঘ নির্দেশিত মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি) অর্জনের কারণে বাংলাদেশ সারাবিশ্বে প্রশংসিত হলেও অদ্যাবধি কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। এর অন্যতম হলো পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাব তথা পুষ্টি সমস্যা। জাতীয় পুষ্টি কর্মপরিকল্পনা (২০১৬-২০২৫)-এর চূড়ান্ত খসড়ায় যে তথ্য উঠে এসেছে তা হলোÑ দেশের ১৮ শতাংশ গর্ভবতী মা অপুষ্টির শিকার। আর প্রধানত অপুষ্টির কারণে ২৩ শতাংশ শিশু জন্ম নিচ্ছে প্রয়োজনের চেয়ে কম ওজন নিয়ে। আরও যা উদ্বেগজনক তা হলো, শহরের বস্তি ও গ্রামাঞ্চলের মাসহ শিশু পরিচর্যাকারীর ৭৩ শতাংশই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে না। এসবের পেছনে আর্থিক দৈন্য, বাল্যবিয়েসহ নানা কুসংস্কারও বিদ্যমান। সন্তান প্রসবে অকারণে সিজারসহ হাতুড়ে চিকিৎসক তথা দাইয়ের হস্তক্ষেপও কোন অংশে কম দায়ী নয়। ফলে প্রসূতি মৃত্যুর হার বেড়েছে। ২০৩০ সাল নাগাদ এসডিজি অর্জন করতে হলে এসব দূর করতে হবে পর্যায়ক্রমে। প্রধানত অপুষ্টির কারণে শিশুও পর্যাপ্ত মাতৃদুগ্ধ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। সেক্ষেত্রে মা ও শিশুর পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে থেকে যাবে শিশুর জন্মগত অন্ধত্বের সমস্যাও। বর্তমান সরকারের অনেক সমুজ্জ্বল সাফল্যের অন্যতম একটি দেশব্যাপী ১৩ হাজারের বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোয় প্রশিক্ষিত ধাত্রীসহ সেবার মান বাড়ানো গেলে নারীর অপুষ্টিজনিত সমস্যাসহ প্রসবজনিত জটিলতা ও মাতৃমৃত্যুসহ শিশুমৃত্যুর হার আরও কমে আসবে নিঃসন্দেহে।
×