ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বোরহান বিশ্বাস

অভিমত ॥ ধর্মের কল...

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ২৯ আগস্ট ২০১৮

অভিমত ॥ ধর্মের কল...

খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার কিছুদিন পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ব্রিটিশ আইনজীবী লর্ড কার্লাইলকে তাদের নেত্রীর আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ করার ঘোষণা দেন। এই ‘নিয়োগ’ যে লন্ডনে নির্বাসিত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আগ্রহে ও নির্দেশেই- সে কথা পরে গোপন থাকেনি। আইনজীবী হিসেবে নিয়োগ করা হলেও লর্ড কার্লাইল যে, বাংলাদেশের আদালতে হাজির হয়ে খালেদা জিয়ার পক্ষে লড়তে পারবেন নাÑ বিএনপির তা জানা ছিল। এর আগে জামায়াতে ইসলামী যখন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া তাদের নেতাদের হয়ে সওয়াল করার জন্য লন্ডনের সুপরিচিত ব্যারিস্টার টোবি ক্যাডম্যানকে নিয়োগ করেছিল। তখন তাকেও বাংলাদেশে এসে সওয়াল করার অনুমতি দেয়া হয়নি। এমনকি তিনি ঢাকায় আসার জন্য ভিসাও পাননি। তারেক রহমান কারাগারে অন্তরীণ তার মা খালেদা জিয়ার পক্ষে দেশের মাটিতে, দেশীয় আইনজীবীদের দিয়ে মামলা লড়ার সুযোগ পেয়েছেন। বছরের পর বছর তা চলেছেও। মামলায় শেষ পর্যন্ত সাজা হয়ে যাওয়ায় মার জন্য অগত্যা তিনি লন্ডনস্থ আইনজীবীর দ্বারস্থ হন। তারেক রহমানের নিশ্চয়ই মনে থাকার কথাÑ বাবা-মা, ভাই-ভাবি সবাইকে হারিয়ে কি কষ্ট সহিষ্ণু দিনগুলোই না পার করেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যারা! কারাগারে আটক মাকে মুক্ত করতে তারেক রহমানের যেমন চেষ্টার কমতি নেই, তেমনি একটা সময় বঙ্গবন্ধু কন্যারাও পিতৃহত্যার বিচার চেয়ে দিগি¦দিক পাগলের মতো ছুটে বেরিয়েছেন। দুই বোন মিলে বিশ্ব মানবতার কাছে ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকা-ের বিচারের দাবি তুলে ধরেছেন। সেই ন্যায্য দাবি ক্রমশ ডালপালা ছড়িয়েছে দেশ-দেশান্তরে। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টে ঘটে যাওয়া অমানবিক ঘটনায় শোকের দিনে কোন মানবিকতায় জন্মদিন পালন করতেন খালেদা জিয়া? মিথ্যা জন্মদিন পালন করা থেকে তারেক রহমান কি তার মাকে বিরত থাকতে বলেছিলেন? নাকি, ক্ষমতার দম্ভে তাকে আরও উস্কে দিয়েছিলেন। প্রতিবছর জন্মদিনের কেকের ওজন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মায়ের কৃতকর্মের বোঝাটিও যে ভারি হচ্ছিল, সেটি কি তারেক রহমান তার মাকে বোঝাতে পেরেছিলেন? তারেক রহমান তার মায়ের জন্য আন্তর্জাতিক মানের আইনজীবী লর্ড কার্লাইলকে হয়ত খুঁজে পেয়েছেন। তার বিশ্বাস, খালেদা জিয়ার হয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে লর্ড কার্লাইল মুখ খুললে তা অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য হবে। কারণ, এই বিখ্যাত আইনজীবীর কথার একটা আলাদা ওজন আছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে শহীদ হওয়ার পর প্রায় একই ঘটনা ঘটেছিল শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার জীবনে। তারাও লন্ডনে খুঁজে নিয়েছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে লড়াই করা প্রখ্যাত ব্রিটিশ আইনজীবী স্যার থমাস উইলিয়ামসকে। শুধু মামলা পরিচালনার জন্যই নয়, বঙ্গবন্ধুর একজন অনুরাগী হিসেবে থমাস উইলিয়ামস ‘ইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ’এর সভাপতি হওয়ার প্রস্তাবও সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন। ব্রিটিশ আইনজীবী লর্ড কার্লাইল যখন দিল্লীর বিমানবন্দর থেকে ফিরতি ফ্লাইটে আবার লন্ডন ফিরে যেতে বাধ্য হন তখন ফিরে আসে সেই স্মৃতিÑ বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর ১৯৮১ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে লন্ডনে গঠিত তদন্ত কমিশনের সদস্য জেফ্রি থমাস এবং মি. অর্বে রোজ বাংলাদেশ সফরের জন্য লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে ভিসার আবেদন করেন। ১৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় কমিশনের সদস্যরা ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিমানযোগে ঢাকা যাওয়ার জন্য ভিসা পাওয়া প্রয়োজন বলে সেদিন সকালে পাঠানো জরুরী বার্তার জবাবে বাংলাদেশ হাইকমিশন জবাব দিয়েছিল, ভিসাসহ পাসপোর্টগুলো বিকেলে ফেরত দেয়া হবে। বিকেলে হাইকমিশনে গিয়ে পাসপোর্টগুলো ফেরত পাওয়া সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে যায়, কনসুলার বিভাগ বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরও বেশ কিছুদিন তারা ভিসা পাওয়ার লক্ষ্যে লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনের তৎকালীন হাইকমিশনার আমিনুর রহমান সামছউদ দোহার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু কোন ফল হয়নি তাতে। এমনকি তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়ার নির্দেশে এআরএস দোহা অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে ভিসা নামঞ্জুর সম্পর্কে কোন চিঠি কিংবা কোন রকমের ব্যাখ্যাও দেননি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকা-ে জিয়াউর রহমান জড়িত থাকা সম্পর্কে তথ্য চাপা দিতেই তদন্ত কমিশনের সদস্যদের ভিসা মঞ্জুর করা হয়নি। থমাস উইলিয়ামস ও লর্ড কার্লাইল দুজনই লন্ডনের অধিবাসী এবং আইনজীবী। কিন্তু তাদের মধ্যে পার্থক্য হলোÑ থমাস উইলিয়ামস শুধু আইন পেশার লোক হিসেবেই নন বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তার নিবিড় একটি সম্পর্ক ছিল। যে কারণে তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিষয়ে লন্ডনে তদন্ত কমিশন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অন্যদিকে, লর্ড কার্লাইলের সঙ্গে জিয়া পরিবারের তেমন কোন পূর্ব যোগাযোগ ছিল না। শুধু আন্তর্জাতিক মানের একজন আইনজীবী হিসেবেই তারেক রহমান তার মায়ের জন্য তাকে নিয়োগ দেন। এই লর্ড কার্লাইল যুক্তরাজ্য লর্ড সভার একজন সদস্য। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলে জামায়াতের লবিস্ট হিসেবে বিচার কার্যক্রম নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রথম প্রশ্ন তোলেন তিনি। একাধিক বিবৃতি দেয়ার পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি ঠেকাতে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠিও লেখেন। বাংলাদেশের সুপ্রীমকোর্ট ২০১৬ সালের ৮ মার্চ জামায়াত নেতা মীর কাশিম আলীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মৃত্যুদ-ের রায় বহাল রাখার পর লর্ড কার্লাইল বাংলাদেশ সরকারের কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন। এতে তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং ওই আদালতের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার সুপারিশ করেন। ’৭১-এর চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষেই যে অবস্থান নিয়েছিলেন লর্ড কার্লাইল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যা হোক, ভিসার জটিলতায় খালেদা জিয়ার এই ব্রিটিশ আইনজীবীকে ভারতে ঢুকতে দেয়নি সে দেশের সরকার। এ বিষয়ে কিছুদিন আগে মুখ খুলেছেন তিনি। নিউইয়র্কের টাইম টিভিতে প্রচারিত সাক্ষাতকারে দিল্লীতে সংবাদ সম্মেলন বাতিল, বাংলাদেশের আইনের শাসন পরিস্থিতিসহ নানা ইস্যুতে কথা বলেন তিনি। কার্লাইল বলেন, ঘটনার দিন সন্ধ্যায় যখন দিল্লী পৌঁছি তখন মোবাইল অন করার পর ম্যাসেজ পাই, তাতে লেখা আমার ভিসা বাতিল করা হয়েছে। এটি ভারত করেছে বাংলাদেশ সরকারের চাপেই। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বর্তমান সরকারের সুসম্পর্ক বিদ্যমান সুদীর্ঘকালের। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনে ভারতের অবদান দুদেশই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। এই মিত্র দেশের মাটিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কার্লাইল সাহেব সংবাদ সম্মেলন করে সবাইকে জানাবেন, আর ভারত সেটি হতে দেবে এমনটি ভাবা ঠিক হয়নি লর্ড কার্লাইলের। নিউইয়র্কের টাইম টিভির ওই সাক্ষাতকারে তিনি আরও বলেন, সংবাদ সম্মেলনটি আমি ঢাকাতেও করতে পারতাম। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার আমাকে ভিসা দেয়নি। কোন কারণ ছাড়াই ঢাকা যেতে বাধা দেয়া হয়েছে। পুনশ্চ: বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর লন্ডনে গঠিত তদন্ত কমিশনের সদস্যরাও বাংলাদেশ সফরের জন্য লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে ভিসার আবেদন করে কোন সাড়া পাননি। ইটটি মারলে পাটকেলটি তো খেতেই হয়। এটিই ইতিহাসের বিচার- ধর্মের কল এভাবেই বাতাসে নড়ে। লেখক : সাংবাদিক
×