ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রাম-বাংলার চিরায়ত উৎসব ভাদর কাটানি

প্রকাশিত: ০৭:৪৩, ২৫ আগস্ট ২০১৮

গ্রাম-বাংলার চিরায়ত  উৎসব ভাদর  কাটানি

আবহমান গ্রাম-বাংলার চিরায়ত উৎসবের মতো স্বামীর মঙ্গল কামনায় পহেলা ভাদ্র হতে উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগের আট জেলায় শুরু হয়েছে ভাদর কাটানি উৎসব। আধুনিক যুগে ভাদর কাটানির পক্ষে নিরপেক্ষ কোন যুক্তিতর্ক থাকলেও ভাদর কাটানি উৎসব থেমে নেই। দলে দলে নববধূরা শ্বশুরবাড়ি থেকে নাইওর হিসেবে বাপেরবাড়ি চলে এসেছে। তাই বাড়িতে বাড়িতে ভাদর কাটানি উৎসব চলছে। কমপক্ষে ভাদ্র মাসের প্রথম ৩ থেকে ৭ দিন বাপের বাড়িতে অবস্থান করবেন নববধূরা। তবে এবার উৎসবটা ভিন্নতা এনেছে। ভাদর কাটানি থেকে ঈদ উৎসব। এবার ভাদর কাটানির সঙ্গে ঈদ উৎসব এক সঙ্গে যোগ হওয়ায় দুটো উৎসবই যেন নববধূদের মহা আনন্দ নিয়ে এসেছে। এই এলাকার রীতি অনুযায়ী ভাদ্র মাসের প্রথম ৩-৭ দিন স্বামী নববধূর মুখ দর্শন করলে চোখ অন্ধ হয়ে যায়, স্বামীর অকল্যাণ হয়। তবে এর কোন প্রমাণিত ঘটনা না থাকলেও যুগ যুগ ধরে এই এলাকার মানুষ এসব আচার-অনুষ্ঠান পালন করে আসছেন। তাই নববধূরা ভাদ্র মাস শুরুর দু-এক দিন আগেই স্বামীর মঙ্গলের জন্য বাপেরবাড়ি চলে যান। এই প্রথাটি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে শুধু নববধূদের ক্ষেত্রে। কেউ কেউ আবার বিয়ের এক হতে ৪ বছরের নারীকেও এই প্রথায় রেখেছে। নববধূকে সাময়িকভাবে কিছু কালের জন্য স্বামীগৃহ হতে পিতৃগৃহে নেয়াকে নাইওর নেয়া বলে। এরূপ স্থলে সেই কন্যাকে বলা হয় নাইওরি, আর যাত্রাকে বলা হয় নাইওর।একটি বালিকা বধূর স্বামীগৃহে অবস্থানকালে পিতৃগৃহে গমনের উন্মুখতা এটি । আদিকাল থেকে এ অঞ্চলে এ রীতি পালন করে আসছেন পূর্ব পুরুষেরা। সেই রীতি অনুযায়ী মেয়েরা সাধারণত এ সময় বাবার বাড়িতে থাকেন। প্রত্যেক নববধূ বাপেরবাড়ি থেকে স্বামীর জন্য মঙ্গল কামনা করেন। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার তিস্তাপাড়ের বধু জেসমনি আরা জানালেন স্বামীর মঙ্গলের জন্য আমি বাবার বাড়ি ঢাকায় চলে এসেছি। এ সময় স্বামীর মুখ দর্শন করলে নাকি স্বামীর অকল্যাণ হয়। এ বিশ্বাস নিয়ে আমরা এ রীতি পালন করে আসছি। জেসমিনের বিয়ের বেশ কয় বছর হয়েছে। আছে দুই কন্যা সন্তান। তার পরেও এই উৎসব সে রীতিমতো পালন করে থাকে। জেসমনি জানায়, এবার ভাদর কাটানি থেকে কোরবানির ঈদ পেয়েছি। তাই বাপের বাড়িতেই এবার ঈদটা করব। ভাদর কাটানীর বিষয়ে নীলফামারী সরকারী মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ এটিএম গোলাম মোস্তফা বলেন, ধর্মীয়ভাবে ভাদর কাটানি করতে হবে এমন রীতি বা বিধান নেই। এটা নিছক পূর্ব পুরুষদের প্রচলিত প্রথা। যার ধারাবাহিকতায় এ অঞ্চলে এ অনুষ্ঠানটি প্রতি বছর সকল ধর্মাবলম্বী অভিভাবকরা পালন করে থাকেন। ভাদর কাটানি নিয়ে নানা মানুষের নানা মতো রয়েছে। এ উৎসব পালনে এসব এলাকায় বাপের বাড়িতে সাজসাজ রব পড়ে, থাকে অনেক আয়োজন। নববধূরা যে কয়দিন বাপোর বাড়িতে থাকবে- ততদিন সামর্থ্য অনুযায়ী উন্নতমানের খাবার খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। কবে থেকে কিভাবে এ প্রথার শুরু হয়েছে তার সঠিক তথ্য নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না। নীলফামারীর মশিউর রহমান ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সারোয়ার মানিক জানান, ভাদর কাটানি মুসলিম সম্প্রদায়ের কোন ধর্মীয় বিষয় না হলেও এ অঞ্চলে প্রথাটি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এক সময় হিন্দু সম্প্রদায় এ উৎসবকে জাঁকজমকভাবে পালন করত। তাদের এ রেওয়াজ ক্রমান্বয়ে এ অঞ্চলের মানুুষকে প্রভাবিত করে। একপর্যায়ে উৎসবটি এ অঞ্চলে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে দঁাঁড়ায়। ভাদর কাটানি হলো বাঙালী সমাজের অতি প্রাচীন একটি প্রথা। এটি লোকাচার হলেও ভাদর কাটানি উৎসব সমাজ ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। যা নববিবাহিত প্রত্যেকের জীবনে মাত্র একবারই আসে। তিনি বলেন দীর্ঘ দিন ধরে দেখে ও শুনে আসছি উত্তরাঞ্চলের সর্ব উত্তরের পঞ্চগড় হতে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম রংপুর, গাইবান্ধা ও জয়পুরহাট জেলা এবং ভারতের পশ্চিম ও দক্ষিণ দিনাজপুর মালদহ এবং মুর্শিদাবাদের কোন কোন অংশে এই প্রথা চালু আছে। এ ছাড়াও জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি জেলার অনেক এলাকার বাঙালী সমাজেও এই প্রথা চালু রয়েছে। বিভিন্ন জনের মতে ভাদর কাটানি এলাকা ঐতিহ্য, আবার অনেকে বলছেন কুসংস্কার। তবে যে যাই বলুক না কেন এরই মধ্যে বাড়িতে বাড়িতে মেয়ে বরণ উৎসব শেষ হয়েছে। এবারের ভাদর কাটানি উৎসবটি ভিন্ন আমেজে এসেছে। নববধূরা পবিত্র কোরবানির ঈদ স্বামীর ঘরে পালন করে এবার বাপের বাড়িতে এসেছে নাইওরে ভাদর কাটানিতে। ভাদর কাটানি এক ধরনের লোকাচার হলেও এটি এখন এ এলাকায় হয়ে উঠেছে সামাজিক রেওয়াজ এবং উৎসবে। পাশাপাশি পুরো ভাদ্র মাসই বিয়ের অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে। বিশেষত এলাকাগুলোর হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এটি বেশি প্রচলিত। ভাদর কাটানীর এ প্রবণতাটি শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে প্রচলন বেশি। অবশ্য সমাজে ভাদর কাটানির একটি ইতিবাচক দিকও আছে। বিয়ে দেয়ার পর মেয়ে বাপের বাড়িতে বেশি দিন থাকার সুযোগ পায় না। যাতে তারা পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সময় কাটাতে পারে। এতে করে পরিবারগুলোতে উৎসবমুখর পরিবেশেরও সৃষ্টি হয়। অনেকের মতে, বাপ-দাদার আমল থেকে যে রেওয়াজ চালু আছে তা কি হঠাৎ করেই অমান্য করা যায়। তাই উত্তরের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা ও জয়পুরহাট এই ৯ জেলায় ভাদর কাটানির রেওয়াজের পাশাপাশি আরও একটি প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। এসব জেলায় খবর নিয়ে দেখা গেছে প্রতিবছর ভাদ্র মাস শুরু হওয়ার আগে শ্রাবণে বিয়েরও ধুম পড়ে যায়। যা অনেকটা প্রতিযোগিতার মতোই। এরপর পুরো ভাদ্র মাসই বিয়ে বন্ধ থাকে। -তাহমিন হক ববী, নীলফামারী থেকে
×