ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দুবলহাটি রাজবাড়ি

দু’শ’ বছরের প্রাচীন, যত্নে হতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৮ জুলাই ২০১৮

দু’শ’ বছরের প্রাচীন, যত্নে হতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র

বিশ্বজিৎ মনি॥ সৃষ্টি আর ধ্বংসের লীলাখেলায় এগিয়ে চলছে পৃথিবী। কেউ সৃষ্টিতে, আবার কেউ ধ্বংসের খেলায় মত্ত। আবার কারোর দায়িত্বহীনতায় কালের গহ্বরে সমাহিত হচ্ছে ঐতিহাসিক সোনালি অতীত। বর্তমান যেমন গুরুত্ববহ সোনালি অতীতও তেমনি অনুপ্রেরণা জোগায়। আমরা বাঙালী, আমাদের রয়েছে ঐতিহাসিক অতীত। বাংলার বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন। এসব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহ আমাদের সত্ত্বাতে আলোড়ন জাগায়। তেমনি আলোড়ন জাগানো ঐতিহাসিক অতীত বহুল স্থান নওগাঁর দুবলহাটি রাজবাড়ি। এ রাজবাড়িটি নওগাঁ শহর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, অযতেœ ও অবহেলায় ২০০ বছরের পুরনো এ রাজবাড়িটি কালের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। ১৭৯৩ সালে রাজা কৃষ্ণনাথ লর্ড কর্নওয়ালিসের কাছ থেকে ১৪ লাখ ৪ শ’ ৯৫ টাকা দিয়ে পত্তন নিয়ে এ রাজ্য পরিচালনা শুরু করেন। রাজা কৃষ্ণনাথ নিঃসন্তান হওয়ায় তার পরবর্তীতে ১৮৫৩ সালে রাজত্বভার গ্রহণ করেন, তার নাতি রাজা হরনাথ রায়। রাজা হরনাথের আমলে দুবলহাটির রাজ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। তিনি দুবলহাটি রাজ প্রাসাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি, নাট্যশালা নির্মাণ ও প্রজা সাধারণের সুপেয় পানীয় জলের কষ্ট দূরীকরণের জন্য রাজ প্রাসাদের পার্শ্ববর্তী এলাকায় অনেক পুকুর খনন করেন। ১৮৬৪ সালে রাজ পরিবারের উদ্যোগে একটি স্কুল স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে স্কুলটির নামকরণ করা হয় রাজা হরনাথ উচ্চ বিদ্যালয়। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তি হওয়ার পর রাজা হরনাথ রায় ভারতে চলে যান। কালের সাক্ষী হয়ে রয়ে যায় সুবিশাল রাজপ্রাসাদ। রাজবাড়ির মূল ফটকে রোমান স্টাইলের স্তম্ভগুলো আজও রাজাদের রুচির পরিচয় বহন করে। রাজবাড়িতে সবমিলিয়ে ৭টি আঙ্গিনা এবং প্রায় ৩শ’টি ঘর ছিল। প্রাসাদের ভেতরে ভবনগুলো কোনটি তিনতলা কোনটি চারতলা ছিল। প্রাসাদে ছিল রাজরাজেশ্বরী মন্দির। যেখানে সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালানো হতো প্রতি সন্ধ্যায়। শোনা যেত শঙ্খের ধ্বনি। যা কালের বিবর্তনে আজ জনমানবহীন শ্মশানে পরিণত হয়েছে। রাজবাড়িতে এখনও সান বাঁধানো একটি কুয়ার অস্তিত্ব রয়েছে। রাজবাড়ির সামনে গোবিন্দ পুকুর, যার পাশে ছিল এলাকায় প্রচলিত ‘গান বাড়ি’ নামক ভবন, যেখানে গান বাজনাসহ বিভিন্ন মনোরঞ্জনের কাজ চলত। নওগাঁর সাবেক এমপি মরহুম আব্দুল জলিল কর্তৃক এ ভবনের উন্নয়ন সাধন করে এটিকে হাসপাতাল তৈরির চেষ্টা করলেও এ কার্যক্রম পরিণতি পায়নি শেষ পর্যন্ত। গান বাড়ির অনতি দূরে ছিল কালিমন্দির। যেটি এখন আগাছায় পরিপূর্ণ। কালিমন্দির থেকে সামান্য দূরে রয়েছে রাজার ‘বাগানবাড়ি’। বাগানবাড়িতে এখন দুটি পরিবার বসতি স্থাপন করেছে। এক সময় অনেক জৌলুস ছিল তৎকালীন রাজাদের। তা বর্তমানেও রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখে বোঝা যায় অনায়াসেই। রাজ্যের বিস্তারে এলাকায় ব্যাপক প্রভাব ছিল এ রাজ পরিবারের। হরনাথ রায় চৌধুরী রাজা খেতাব পেয়েছিলেন। এর আগের পূর্ব পুরুষরা মোগলদের দেয়া জমিদার খেতাবে ভূষিত ছিলেন। রাজ পরিবারের গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে অন্তর্ভুক্ত ২২ কাহন কৈ মাছ দিয়ে রাজস্ব প্রদানের স্বীকৃতি রয়েছে। বর্তমানে রাজবাড়ির গেটের পাশে ছিন্নমূল বাবুর পরিবারের আবাস। রাজবাড়ির দোতলায় তিন-চার বছর ধরে দখল করে কবুতর পালন কাজ করছেন স্থানীয় যুবক আলম। জমিদারির বিলুপ্তির পর সরকার রাজবাড়িকে সরকারী সম্পদ হিসেবে প্রতœতত্ত্ব বিভাগের অধীনে নেয়। প্রতœতত্ত্ব বিভাগ দায়িত্বভার গ্রহণ করলেও অদ্যাবধি এর সুরক্ষা বা সংস্কারের কোন প্রকার উদ্যোগ নেয়নি। স্থানীয় প্রভাবশালীদের কবলে পড়ে দিনে দিনে রাজবাড়ির মূল্যবান সম্পদ চুরি ও লুটপাট হয়ে যায়। মূল্যবান দরজা, জানালা, শাল কাঠের তীর লুট করে নিয়ে যাওয়ার পর এখন দালানের ইট খুলে নিয়ে এলাকায় অনেকেরই বাড়ি তৈরি হবার কথাও প্রচলিত রয়েছে। অবহেলা অযতেœ ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা দুবলহাটি রাজবাড়িতে এখন সকাল-সন্ধ্যা সব সময়ই চলে অসামাজিক কার্যকলাপ। অবাধে বসছে মদ, জুয়া, গাঁজার আড্ডা। এ রাজবাড়ি হয়ে উঠেছে উন্মুক্ত অসামাজিক কার্যকলাপের কেন্দ্রবিন্দু। কেউ দেখার নেই। কারোর যেন মাথা ব্যথাও নেই। যার ফলশ্রুতিতে বর্তমানে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে দাঁড়িয়ে দুবলহাটি রাজবাড়িটি। এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটির সংস্কার করা হলে এই রাজবাড়িকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। রাজবাড়িটি অতি শীঘ্রই সংস্কার প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এই ঐতিহাসিক নিদর্শন, বাংলার গৌরব, উজ্জ্বল ইতিহাসের সাক্ষী ঐতিহাসিক দুবলহাটি রাজবাড়ি সংস্কারে এগিয়ে আসা জরুরী বলে সচেতন মহলের অভিমত।
×