ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

মলয় বিকাশ দেবনাথ

অনন্য ফেরদৌসী মজুমদার

প্রকাশিত: ০৭:৩০, ১২ জুলাই ২০১৮

অনন্য ফেরদৌসী মজুমদার

‘পিড়ি ফিইক্কা মারমু কইলাম, অক্ষণ তুমি আমার বাড়ি থেকে বিদায় হও।’ অমর কথাসাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সারের কালজয়ী উপন্যাস সংশপ্তক নাটকের হুরমতি চরিত্রের সংলাপ। সাড়া জাগানো এই নাটকে হুরমতি চরিত্রটি করেছিলেন বিখ্যাত নাট্যজন, গুণী শিল্পী ফেরদৌসী মজুমদার। কৈশোরে এই নাটকটি বিটিভিতে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। প্রতি শুক্রবারে নাটকটি দেখানো হতো। পুরো সপ্তাহ অধীর আগ্রহে বসে থাকতাম কখন আসবে সেই সন্ধিক্ষণ। সারাদেশে নাটকটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। হুরমতি চরিত্রের বহুমাত্রিকতা, যেমন মালুকে দিয়েছিলেন মাতৃ ভালবাসা। কোমলমতি হুরমতিকে পরক্ষণেই সম্মুখীন হতে হতো তৎকালীন দুষ্টুচক্রের দলের সামনে। কখনও রমজানের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবার কঠিন লড়াই। যে পর্বে হুরমতিকে পয়সা দিয়ে কপালে ছ্যাঁকা দেয়া হয়েছিল তখন আমিও চিৎকার করে কেঁদে ফেলেছিলাম। সেই কান্না মিনিট বিশেক স্থায়ী ছিল। বাড়ির সকলে আমাকে বোঝাতে লাগল এটা অভিনয় সত্যি না। এই নানা মাত্রিকতা ফেরদৌসী মজুমদার যথাযথ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে কেড়েছিলেন দর্শকপ্রিয়তা। জনপ্রিয় শিল্পী ফেরদৌসী মজুমদার গত মাসের ১৮ জুন ৭৬ বছর বয়সে পা রাখলেন। তার বাবা খান বাহাদুর আব্দুল হালিম চৌধুরী ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। ৮ ভাই ও ৬ বোনের মধ্যে ভাইদের মধ্যে সবার বড় ছিলেন অধ্যাপক কবির চৌধুরী ও ২য় ছিলেন শহীদ মুনীর চৌধুরী। মুনীর চৌধুরীর অনুপ্রেরণায় তার অভিনয় জগত শুরু। একদিন বিকেলে তিনি জানালায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখন মুনীর চৌধুরী এসে বললেন, ‘অভিনয় করবি?’ অবাক হয়ে উত্তর দিলেন আমি তো অভিনয় জানি না আর তা ছাড়া বাবা মেরেই ফেলবে। তৎকালীন একেবারে এক রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হিসেবেই ছিল তার বেড়ে ওঠা। নাচ, গান, অভিনয় করবে এ বাড়ির মেয়ে এটা কল্পনাতীত ব্যাপার ছিল। যা হোক বাবাকে ফাঁকি দিয়ে ভাইয়ের সাহস ও অনুপ্রেরণায় তিনি অভিনয় করতে রাজি হলেন। এটাই ছিল তার জীবনে প্রথম মঞ্চে দাঁড়ানো। শওকত ওসমানের ‘ডাক্তার আব্দুল্লাহর কারখানা’ নামক নাটকে তিনি একটি রোবটের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন যা প্রদর্শিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল যা এখন জহুরুল হক হল নামে পরিচিত। শহীদ মুনীর চৌধুরী সেদিন খুব খুশি হয়েছিলেন। তিনিই নাটক লিখতেন এবং পরিবারের সব ভাই-বোনদের নাটক শোনাতেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে কাটিয়েছেন। শিল্পাঙ্গনে নিজেকে সম্পৃক্ত করার জন্য পরিবারের সঙ্গে যুদ্ধ আবার বিয়েটাও হয়েছে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। তথাকথিত রক্ষণশীল মুসলীম পরিবারের মেয়ে বিয়ে করবেন রামেন্দু মজুমদারকে তা আবার ১৯৭০ সালে। এ যেন চিন্তার বাইরে। তার বাবা ছিলেন সন্তানের ক্ষেত্রে একেবারেই কোমল। মেয়ের কষ্ট হবে বলে সে বিয়েতে তিনি মত দিয়েছিলেন। বড় ভাই কবির চৌধুরীর বাড়িতেই তাদের বিয়ে হয় ১৯৭০ সালে ১৩ জুন। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে থিয়েটারের দল গঠিত হলে তিনি তাতে যোগ দেন। তিনি অভিনয়ের ব্যাপারে এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘আমরা টেলিভিশনের কাজও করেছি এক মাসের মহড়া করে। এখন সবাই এটা হাস্যকর ভাববে।’ আজ নাটক যে অবস্থায় এসেছে এই মহড়ার অভাব সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। খুব অল্প বাজেট সংক্ষিপ্ত সময় শিল্পটাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কলাকুশলীদের দুর্বলতা বলব না বরং নাটক তৈরির ব্যবস্থাটাই আজ এর জন্য দায়ী। আমাদের সৌভাগ্য যে ফেরদৌসী মজুমদারের মতো গুণী শিল্পী আজও আমাদের মাঝে বর্তমান। আকুল আবেদন এই শিল্পকে বাঁচাতে কিছু ইতিবাচক নির্দেশনা আপনার লেখনীতে উঠে আসুক। পরবর্তী প্রজন্ম সেটাকে সামনে রেখে নির্মাণে উৎসাহী হবে। ব্যক্তি জীবনে তিনি লেখেন। নিজের জীবন নিয়ে আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘মনে পড়ে’। গত ৬ জুলাই শুক্রবার জার্নিম্যান থেকে প্রকাশিত ‘যা ইচ্ছা তাই’ বইটির প্রকাশনা উৎসব হয়েছে। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন লেখকের প্রত্যক্ষ শিক্ষক জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন গুণী নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার। ফেরদৌসী মজুমদার বলেছেন ‘আমি যা লিখি, জীবন থেকে লিখি। অতি সত্য কথা উচ্চারণ করি।’ এই বাণী আমাদের অনুপ্রেরণা যোগাবে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছেন, এই বইয়ের ৭৯ নম্বর পৃষ্ঠায় ফেরদৌসী লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিসর্জন’ আনিস স্যার কী ভাল পড়াতেন। ‘বাংলা মঞ্চের শক্তিশালী অভিনেত্রী যখন বলেছেন আমি ভাল পড়াই, সেটা সত্যিই গর্বের’। তিনি দুটি সিনেমা এবং প্রায় তিন শ’ নাটকে অভিনয় করেছেন। তার অভিনীত নাটকগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কোকিলারা, এখনও ক্রীতদাস, বরফগলা নদী, জীবিত ও মৃত, বাঁচা, নিভৃত যতনে, অকুল দরিয়া, যোগাযোগ, চোখের বালি, শংখনীল কারাগার, এখনো দুঃসময়, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। আবদুল্লাহ আল মামুন তাকে নিয়ে ৮৬ মিনিটের একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন যার নাম ‘জীবন ও অভিনয়’। নাট্যজগতে তার এই অসামান্য অবদান আমাদের পাথেয় হয়ে থাকবে। জয়তু ফেরদৌসী মজুমদার।
×