ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চৌধুরী শাহজাহান

জেগে থাকার কাব্য

প্রকাশিত: ০৭:৪৪, ১ জুন ২০১৮

জেগে থাকার কাব্য

শাহীন মাহমুদ একজন স্বাপ্নিক মানুষ। তিনি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসেন। আমাদের এই অসুস্থ ও রুগ্ন সমাজকে বদল করার জন্যে স্বপ্ন তাকে তাড়া করে বেড়ায়। এ স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে তিনি হাতিয়ার হিসেবে অবলম্বন করেন কবিতাকে। তিনি মনে করেন কবিতার শক্তি অসীম। কবিতাই পারে একটি সমাজকে আমূল বদলে দিতে। সম্প্রতি বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে শাহীন মাহমুদের কাব্যগ্রন্থ ‘হৃদ্যা আমিও জেগে আছি’। এটি তাঁর চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ। নব্বই দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় তিনি লেখালেখি শুরু করেন গল্প ও উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে। ১৯৯৪ সালে কথাসাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে জানান দেন প্রথম গ্রন্থ ‘অন্তগূঢ় দিশা’ উপন্যাসের মাধ্যমে। এ পর্যন্ত তাঁর আটটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তিনি সমকালের চিত্রকে রূপায়িত করেন কবিতায়। সাহিত্য অন্তপ্রাণ শাহীন মাহমুদ বর্তমানে কবিতার দিকে মনোনিবেশ করেছেন সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের প্রায় পত্রিকায় তিনি নিয়মিত কবিতা লিখে চলেছেন। এ মুহূর্তে কবিতাই তাঁর একমাত্র আরাধ্য বস্তু। শাহীন মাহমুদের ‘হৃদ্যা আমিও জেগে আছি’ কাব্যগ্রন্থে মোট চল্লিশটি কবিতা সংকলিত হয়েছে। প্রেম, প্রকৃতি, রাজনীতির পাশাপাশি সমকাল নিয়ে ভাবনার প্রকাশ দেখি আলোচ্য গ্রন্থে। ‘এক রাজনৈতিক কবি লিখলেন কবিতা’য় তিনি বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার বিষয়টিকে ধিক্কার জানিয়েছেন। ৭ মার্চের ভাষণ ‘জনকের যুদ্ধ রণকৌশল আজ এক অনন্য দলিল’। ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষের হত্যাকারীদের তিনি অভিশাপ দিয়েছেন এই কবিতায়। সমকালীন বিভিন্ন ঘটনা তার কবিতায় ওঠে আসে অনায়াসে। ‘মংডু রোডে’ কবিতায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার ও নির্য়াতনের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে চমৎকারভাবে। শহরের রাস্তায় রোহিঙ্গা নারীর রক্তাক্ত উলঙ্গ শরীর, ধর্ষিত নারীর দেহ, নিজ গৃহে পরবাসী রোহিঙ্গা জাতি, ঘাতকের নৃশংসতা, দাউ দাউ আগুন, ভুলুণ্ঠিত মানবতা প্রভৃতি চিত্র পাঠকের হৃদয়কে সমব্যাথী করে তোলে। যেমন- মংডু শহরের রাস্তার মোড়ে মোড়ে জমছে গলাকাটা লাশের সারি পড়ে আছে রোহিঙ্গা যুবতীর রক্তাক্ত উলঙ্গ শরীর ফকিরা বাজারে জ্বলছে দাউ দাউ আগুন কুয়াছং পাড়ায় জ্বলছে বকুল বালার গোয়াল ঘর চারদিকে শুধু আগুন আর করুণ চিৎকার। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় জীবনের এক অবিস্বরনীয় ঘটনা। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর পাকিস্তানী শাসকদের চাপিয়ে দেয়া অযুক্তিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এদেশের দামাল ছেলেরা প্রথম প্রতিবাদী হয়ে ওঠে মাতৃভাষার দাবিতে। আন্দোলন ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে আদায় করে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার যা পরবর্তীকালে ইউনেসকো কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা পায়। শাহীন মাহমুদের ‘একুশের কথামালা’ কবিতায় সেই ভাবনারই প্রকাশ ঘটে কবিতার পঙ্ক্তির পর পঙ্ক্তিতে। পৃথিবীতে আমরা ভাসিয়েছি রক্ত নদী/মায়ের ভাষার জন্য বুলেটের সামনে পেতেছি বুক।/ আর যারা আমাদের নির্মমভাবে মারল;/ তারা মানুষ নয়!/ মানুষ নামের অন্য কিছু।—— একুশ এলে শুধু মনে পড়ে আমার দুঃখিনী বর্ণমালা;/মায়ের পুরনো কাপড়ের আঁচলের সোঁদা গন্ধ তুমি,/ পলাশ শিমুল দেখে ভিেেজ যায় চোখ,/ বেড়ে যায় শোক-বুকে জ্বলে আগুন...ফিরে ফিরে আসে আমার একুশ; আমার সেই দুঃখের ফাগুন। কাব্যগ্রন্থটির নাম কবিতা ‘হৃদ্যা আমিও জেগে আছি’ কবিতাটিসহ আরো বেশ কিছু কবিতা যেমন- বৃষ্টি, কবির জন্য এলিজি, অপেক্ষার একশত প্রহর, রোদ্দুরে ভিজে যাওয়া প্রেম, দুতিয়ার চাঁন, শীত সঙ্গম স্থানে, একটি লাল গোলাপ, ব্যারাকের আস্তিন ছিঁড়ে, বর্ষাকাল, তোমার দু’ঠোট কাঁপছিল পাঠক হৃদয়কে দোলা দেবে। কবিতা গ্রন্থটির বহুল প্রসার কামনা করছি।
×