ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সর্বত্র প্রযুক্তির প্রসার

আধুনিকতার ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ কৃষি চিত্র

প্রকাশিত: ০৪:৫৪, ১২ মে ২০১৮

আধুনিকতার ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ কৃষি চিত্র

আগেকার দিনে কৃষকের বাড়ি মানেই ছিল- ‘গোলা ভরা ধান আর গোয়াল ভরা গরু’। গোলা ভরা ধান তুলতেই প্রয়োজন হতো গোয়াল ভরা গরুর। কাকডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গরু দিয়ে হালচাষ করতে হতো। গরুর গোবর ব্যবহার করা হতো জৈব সার হিসাবে। ধান কাটার পর তা মাড়াই দিতেও প্রয়োজন পড়তো গরুর। এরপর উৎপাদিত ধান কূলোর সাহায্যে বাতাসে উড়িয়ে পরিষ্কার করতে হতো। চাল উৎপাদন করতে ধান ভানতে হতো ঢেঁকিতে। এছাড়া জমিতে পানি সেচ দেয়া হতো কাঠের তৈরি দোন দিয়ে। হাতে ছিটাতে হতো সার ও কীটনাশক। নিরানির সাহায্যে করতে হতো আগাছা দমন। কিছুদিন আগেও এমনই ছিল আবহমান গ্রাম-বাংলার সনাতন কৃষিচিত্র। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার আর প্রযুক্তির উৎকর্ষে গ্রামীণ কৃষি- বৈচিত্র্য আজ অনেকটাই বদলে গেছে। এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। কৃষকের বাড়িতে এখনও গোলা ভরা ধান উঠছে ঠিকই, বেড়েছে উৎপাদনও। কিন্তু বদলে গেছে সেই চিরচেনা দৃশ্যপট। কৃষিকাজে এখন আর খুব একটা সনাতন পদ্ধতি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। সবকিছু করা যায় যন্ত্রপাতির সাহায্যে। ইতিমধ্যে হালের বলদের স্থান দখল করে নিয়েছে কলের লাঙ্গলÑ ‘ট্রাক্টর’ (পাওয়ার টিলার)। আগে যেখানে এক হাল (এক জোড়া) গরু দিয়ে সারাদিনে চাষ করা যেতো মাত্র তিন থেকে চার কাঠা (দশ শতকে এক কাঠা) জমি, এখন ট্রাক্টরের সাহায্যে তা করা যায় মাত্র এক ঘণ্টায়। বীজ বপনের যন্ত্র হিসেবে বাজারে এসেছে ‘সিডার’। ধানের চারা লাগতে এসেছে ‘রাইস ট্রান্সপ্লান্টার’। তেমনি কৃষকের পানি সেচ প্রক্রিয়াকেও খুব সহজ করে দিয়েছে ডিজেল চালিত ‘শ্যালো ইঞ্জিন’ বা বিদ্যুতচালিত ‘মটর’। শ্যালো ইঞ্জিন বা মটরের সাহায্যে এক ঘণ্টার পানিতে সয়লাব করে দেয়া যায় বিস্তীর্ণ আবাদী জমি। ধান কাটতেও সনাতন পদ্ধতির প্রয়োজন পড়বে না আর। এরই মধ্যে কৃষকের নাগালের মধ্যে এসেছে ‘পাওয়ার রিপার’ ও ‘কম্বাইন্ড হারভেস্টার’। এতে নিমিষেই কাটা হয়ে যাচ্ছে জমির ধান। যন্ত্রচালিত মাড়াই কল বা ‘পাওয়ার থ্রেসার’ দিয়ে ধান মাড়াইও হয়ে যাচ্ছে মুহূর্তের মধ্যেই। ‘উইডার’ এর সাহায্যে সহজেই দমন করা যাচ্ছে আগাছা। এদিকে গ্রামীণ নারীদের ঢেঁকিতে ধান ভানার দৃশ্যও আজ আর নেই। ঢেঁকি অনেক আগেই জাদুঘরে চলে গেছে। গহীন গ্রামেও পৌঁছে গেছে একাধিক চালকল। যন্ত্রচালিত চালকলে অল্প সময়েই ধান থেকে উৎপাদিত হচ্ছে বস্তার পর বস্তা চাল। অটো রাইসমিলও বসে গেছে সব জেলাতেই। এছাড়াও আমদানি হয়েছে সিড গ্রেডিং মেশিন, গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ যন্ত্র, ড্রায়ারসহ আরও অনেক কৃষি-যন্ত্রপাতি। তাছাড়া বিভিন্ন ফসলের হাইব্রিড জাত এবং নানা রকমের রাসায়নিক প্রযুক্তি তো দিন দিন আসছেই। কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সরকারী উদ্যোগে গৃহীত ‘খামার যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প’ এর আওতায় ভর্তুকির মাধ্যমে কৃষকদের মাঝে নানা ধরনের কৃষিযন্ত্র বিতরণ করা হচ্ছে। এমনই একটি যন্ত্র ‘কম্বাইন্ড হারভেস্টার’। সাম্প্রতিককালে এ যন্ত্রটি কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কারণ অতি আধুনিক এ যন্ত্রটির বদৌলতে কৃষিকাজ আরও সহজ হয়ে গেছে। এ যন্ত্র থাকলে কৃষককে আর ধান কাটতে হয় না, দিতে হয় না মাড়াই, এমনকি কুলো দিয়ে বাতাসের সাহায্যে আর ধান পরিষ্কার করতে হয় না বাড়ির কিষাণিকেও। ডিজেলচালিত ‘কম্বাইন্ড হারভেস্টার’ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই করতে পারে এসব কাজ। অর্থাৎ ধান কাটা, মাড়াই এবং পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে বস্তায় ভরা পর্যন্ত সব কাজই হয়ে যায় কেবল এ একটি যন্ত্রের সাহায্যেই। কৃষকরা জানান, এ যন্ত্রের সাহায্যে মাত্র এক ঘন্টায় পাঁচ থেকে সাত কাঠা জমির ধান কাটা-মাড়াই-পরিষ্কার ও বস্তাজাত করা যায়। এভাবেই একের পর এক কৃষিযন্ত্রের আমদানি ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায় বদলে যাচ্ছে আবহমান গ্রাম বাংলার কৃষি-বৈচিত্র্য। কৃষির এই আধুনিকায়নকে কৃষকরাও দেখছেন ইতিবাচকভাবে। খালিয়াজুরি উপজেলার বলরামপুর গ্রামের কৃষক শেকুল মিয়া জানান, ‘কৃষিকাজ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সহজ। আগে অন্তত দুই হাল (দুই জোড়া) গরু আর লাঙ্গল-জোয়াল না থাকলে কৃষি কাজের কথা চিন্তা করা যেত না। এখন কেবল পুঁজি থাকলেই হয়। চাষাবাদের জন্য ট্রাক্টর ভাড়া পাওয়া যায়। ধান কাটা-মাড়াইয়ের জন্য পাওয়া যায় মেশিন। স্বপন সরকার নামে একই গ্রামের আরেক কৃষক বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছেÑ আগে সবকিছু করা হতো কায়িক শ্রমে। এতে পরিশ্রম বেশি হতো। সময়ও বেশি লাগতো। এখন যন্ত্রপাতির কারণে আগের মতো শ্রম দিতে হয় না। কম সময়ে এবং অল্প পরিশ্রমেই বেশি কাজ করা যায়। অবশ্য কৃষি ব্যবস্থা দিন দিন যন্ত্রনির্ভর হয়ে যাবার কারণে কিছু নেতিবাচক প্রভাবও যে পড়ছে নাÑ তা নয়। হারিয়ে যাচ্ছে কৃষির লোকায়ত জ্ঞান। কমে যাচ্ছে গবাদিপশুর সংখ্যা ও চাহিদা। বিকল্প পেশা খুঁজতে হচ্ছে কৃষির সঙ্গে জড়িত শ্রমিক-মজুরদের। এরপরও সময়ের চাহিদা হিসাবে আধুনিক প্রযুক্তিকেই বেছে নিচ্ছেন কৃষকেরা। ফলে অতীত হয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ কৃষির অনেক চিরচেনা দৃশ্যপট। এ প্রসঙ্গে মাঠ পর্যায়ে কর্মরত কলমাকান্দা উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আধুনিক যন্ত্রপাতির বদৌলতে সনাতন কৃষিচিত্রের আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এতে শস্যের উৎপাদন যেমন বেড়েছে- তেমনি অনেকাংশে উৎপাদন খরচও কমেছে। এ পরিবর্তন আমাদের খাদ্য চাহিদা ও নিরাপত্তার দিক দিয়ে অত্যন্ত ইতিবাচক। তিনি বলেন, কিছু কিছু এলাকায় কৃষিশ্রমিকের সঙ্কট দিন দিনই প্রকট হয়ে উঠছে। যান্ত্রিকীকরণ হলে এ সঙ্কট মোকাবেলা করাও সক্ষম হবে। -সঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা থেকে
×