ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

প্রযুক্তি সেবার উন্নয়নে ‘বুদ্ধিচর্চা’র সুযোগ বাড়াতে হবে

প্রকাশিত: ০৬:৩৫, ৬ মে ২০১৮

প্রযুক্তি সেবার উন্নয়নে ‘বুদ্ধিচর্চা’র সুযোগ বাড়াতে হবে

বাংলাদেশের প্রায় সকল প্রান্তে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক পৌঁছেছে। ফোনে কথা বলার সমান সুবিধা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের গতি সবখানে সমানভাবে পৌঁছেছে একথা অবশ্য জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। এসব নিয়ে অনেক নালিশ হয়েছে কিন্তু খুব একটা উপকার হয়নি। এরপরও মন্দের ভাল হিসেবে মোবাইল ফোনে আমাদের উপযোগী কাজের জন্যে বুদ্ধির সর্বোচ্চ ব্যবহার আমরা কেমন করে করতে পারি এই নিয়ে ভাবা দরকার। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যেসব কাজ করা যায় সে সবের অনেক কিছু আমাদের অজানা। কথা বলা বা ভয়েসের ব্যবহার ছাড়া আরও যেসব কাজ হয় (বিশেষ করে স্মার্ট ফোন দিয়ে) সেগুলো ডেটা বা ইন্টারনেট গতির সঙ্গে সম্পর্কিত। কোন কোন ক্ষেত্রে এ রকম কিছু কাজ ইন্টারনেট ছাড়াও ব্যবহার করা যায়। এর জন্যে আজকাল প্রায় ফোনেই নানা রকমের ফিচার (‘এ্যাপ’ বা ‘এ্যাপ্লিকেশন’ নামে যেগুলো পরিচিত) যুক্ত করা থাকে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে যে কেউ এ্যাপ ডাউনলোড করে নিতে পারে। এটা নির্ভর করে যিনি যা চাইছেন বা যা দরকার সে রকম চাহিদা অনুযায়ী। যেমন কোন শিক্ষার্থী চাইলো তার একটি বৈজ্ঞানিক ক্যালকুলেটর দরকার। সে কিন্তু এটা না কিনেও তার ফোনেই ডাউনলোড করে নিতে পারে ও লেখাপড়ার প্রয়োজনের সময় তা ব্যবহার করতে পারে। নানা পর্যায়ের শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত এ রকম হাজারটা এ্যাপ তৈরি করাই আছে। বেশিরভাগই ফ্রি বা কোন কোন ক্ষেত্রে নামমাত্র মূল্যে কিনে নিতে হয়। স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা, বিজ্ঞান, মানচিত্র, গাড়িঘোড়ার সময়সূচী, বিমান যাত্রা বা পথের খবর, জরুরী খবর এমনকী বিশ্বের নামকরা নিউজ এজেন্সিগুলোরও এ্যাপ আছেÑ যে সবের মাধ্যমে আপনি আপনার প্রয়োজনীয় তথ্য যে কোন মুহূর্তে হালনাগাদ পেতে পারেন। ফলে মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট আপনার কাছে তথ্য হাজির করে দিতে পারছে আপনার যখন দরকার তখনই। তাই আমাদের ভাবা দরকার কখন কী দরকার আর কেমন করে সহজে আমরা সেসব নিজেরাই তৈরি করে হাজির করতে পারি। এই এ্যাপগুলো তৈরি করে সাধারণত তরুণ সমাজ, যাদের এগুলো তৈরি করে নেবার সহজ পাঠ শেখা আছে। এর জন্য বিশাল মেধা-ক্ষমতার অধিকারী হতে হবে এমন কথা নেই। যারা এসব বলে আমাদের দেশের তরুণদের ভয় দেখান তাদের একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে, সে হলো প্রযুক্তি ব্যবহারে একটা ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ বা প্রযুক্তি বৈষম্য বজায় রাখা যাতে তাদের তথাকথিত ব্র্যান্ডিং ব্যবসার সুযোগ আরও বাড়ে আর যাতে আমাদের মেধা অপচয় হয়Ñ অন্য কাজে যেখানে বুদ্ধির উৎপাদনশীল ক্ষমতা লোপ পায়। যেমন মাদক বা রাত জেগে ফেসবুক করা বা চ্যাট করা। পয়সা কামাই করতে আমাদের মোবাইল ফোনগুলো এমন কিছু কাজ করে থাকে যার কারণে প্রায়ই আদালতের মাধ্যমে এগুলো থামাতে হয়। কারণ পুঁজির দাপটে এরা অনেক সময় সরকারের কথাও শুনতে চায় না। তাই আমাদের এটা ভাবা দরকার আমরা সচেতনভাবে আমাদের বুদ্ধির চর্চা করি, ওদের ফাঁদে পা না হয় নাই দিলাম। দুনিয়াজুড়ে হাজার উদাহরণ আছে কেমন করে তারুণ্যের শক্তি প্রযুক্তি জগতের ট্রেন পুঁজির বিকাশের মন্দ উদ্দেশে যতবার আঁকাবাঁকা পথে যাবার চেষ্টা করেছে তখনই তাকে সোজা রাখতে বাধ্য করেছে। মাইক্রোসফটের দাপটে এক সময় এমন হয়েছে যে, আর কোন অপারেটিং সিস্টেম বা এ্যাপলের ম্যাকিন্টোশ দিয়ে সহজ কাজগুলো করা জটিল হয়ে পড়েছিল, তখন নানা দেশে তরুণ প্রযুক্তিবিদরা মিলে নানা রকম অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করে উইন্ডোজকে সোজাপথে এনে আর সকলের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করতে বাধ্য করেছে বা যেমন ধরুন, একটা ব্লাডপ্রেসার মেশিন কিনতে যদি আপনার আনুমানিক তিন হাজার টাকা দরকার হয় কেউ একজন এ্যাপ বানিয়ে ফ্রি করে তা মোবাইল ফোনে চালু করে দিলো, আপনি ঘরে বসে এখন নিজের প্রেসারটা চেক করে নিতে পারছেন। অর্থাৎ আপনার নিজের চাহিদা মেটাতে আপনি নিজেই এ সেবা নিতে পারেন, আর আপনার আশপাশের তরুণদের সঙ্গে সেসব নিয়ে গল্প করতে পারেন যাতে তার চোখে মুখে একটা স্বপ্ন তৈরি হয় আর সে অনুভব করে যে সে যথেষ্ট বুদ্ধিমান ও যোগ্যতা রাখে এ রকম কিছু উদ্ভাবন করতে। যদি তার কিছু ঘাটতি থাকে সেটা সে নিজেই শিখে নিতে পারে আর এ জন্যে তাকে ভাবতে হবে; চিন্তা করে তার বাড়ির, আশপাশের বা সমাজের একটা সমস্যা নিয়ে ভেবে নিজেই তার সমাধানের বুদ্ধি বের করে নিতে পারে। এই বুদ্ধি বের করার কাজটাই হলো ‘গবেষণা’ তা যত ভারিই শোনাক না কেন এই কাজ আমাদের দেশের তরুণ সমাজের জন্যে কোন বিষয়ই না! ধরুন বাংলাদেশের সব গ্রামের একজন তরুণ বা তরুণী তার নিজের গ্রামের সব তথ্য দিয়ে একটা এ্যাপ বানিয়ে ফেলেছে, সেখানে আছে সব মানুষের বাড়িঘরের তথ্য বিবরণ, পুকুরের আর গাছপালার তথ্য বিবরণ, আছে সব মানুষের হিসাব, কতজন পুরুষ, কতজন নারী, কতজন শিশু বা নবজাতক, গর্ভবতী মা আর বয়োবৃদ্ধদের হিসাব, স্কুল কলেজের তথ্য আর সবার পেশার বিবরণ। সবগুলো গ্রাম নিয়ে যদি কেউ কাজ করতে চায়; কি এক সবুজ বাংলাদেশ মোবাইল ফোনের এ্যাপ হয়ে দুনিয়ার সকলের কাছে চলে যাবে কেউ ভাবতে পারেন? আর প্রতি গ্রামে যদি একজনও এই কাজে ‘গবেষণা’ করে তা হলে বাংলাদেশে আনুমানিক গ্রাম গবেষক হবে প্রায় আশি হাজার! শুধু এদের সঙ্গে প্রযুক্তি বুদ্ধির একটা সম্পর্ক গড়ে দিতে হবে এই যা! আমাদের দুর্ভাবনায় ফেলেছে আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগের অভাব। আমরা যদি সরকারকে সঙ্গে নিয়ে খুব কষে একটা চাপ দিতে পারতাম তা হলে যাদের টাকা আছে কিন্তু কর দেয় না, আর সেসব টাকা দিয়ে বিলাসিতা করে, দেশে মাদক আর ধুম ধাড়াক্কা হিন্দি সিনেমা আমদানি করে এনে তরুণদের ক্ষতি করে ও বুদ্ধি কমাবার চেষ্টা করে নিজেরা আরও বেশি টাকা কামাই করে, তাদের কাছ থেকে করের টাকা আদায় করে এ রকম বুদ্ধিচর্চার গবেষণা কেন্দ্র তৈরি করে নিতাম। মোবাইল ফোনের কোম্পানিগুলো হাজার কোটি টাকা কামাই করে তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে অথচ আমাদের দেশে একটা গবেষণা কেন্দ্র করে না। আমাদের ছেলেমেয়েদের একটা গবেষণা বৃত্তি পর্যন্ত দেয় না। সরকার এখনও সেই শত পাতার জটিল ‘প্রজেক্ট’ করার চিন্তা থেকে বের হতে পারছে না সেটাও বুদ্ধির অভাবেই। আর তার ফাঁক গলিয়ে এমন সব বুদ্ধি চিন্তার অনুদান বিতরণ হয়ে যাচ্ছে সেসবের অনেকগুলোর টিকিটিরও সন্ধান আর পাওয়া যায় না। সবাই মিলে, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির হালনাগাদ পণ্ডিতসমাজ, যারা এসব বোঝেন, সবাই মিলে সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে আর বুদ্ধি দিতে হবে যেন এটা উপলব্ধি করে যেÑ তারুণ্যের শক্তি শুধু গায়ের জোরে না, বুদ্ধির জোরেও আর সেখানে আমাদের উদ্যোগের অনেক ঘাটতি। সবাই মিলে সরকারকে বোঝালে বুঝবে না? অবশ্যই বুঝবে। লেখক : পরিচালক আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্যে তথ্য-প্রযুক্তি প্রকল্প
×