ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চির নূতনেরে দিল ডাক, পঁচিশে বৈশাখ

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ৪ মে ২০১৮

চির নূতনেরে দিল ডাক, পঁচিশে বৈশাখ

স্রষ্টা মাত্রেরই সংশয়, সৃষ্টি বাঁচবে তো! নশ্বর জীবদেহ বিলীন হয়ে যাবে। মুছে যাবে বেঁচে থাকার যাবতীয় বাহ্যিক অহংকার। সাধারণ মানুষের এই পরিণতি। এই নিয়ে কারোর অভিযোগ থাকে না কিছু, কিন্তু সৃজনশীল মানুষের ভিন্নতর এক অন্বেষণ থাকে, থাকে অমরত্বের আত্মগত এক স্পৃহা। আমি বা আমার নাম রূপের লয় হোক, ক্ষতি নেই! কিন্তু আমার সৃষ্টি যেন নিশ্চিহ্ন না হয়ে যায়। মহাকালের অবসম্ভাব্য পরিবর্তনে তাঁর সার্বজনীন সৃষ্টি যেন সবকিছুই নিঃশেষে না বিদায় করে দেয়! অনন্ত মানব স্মৃতিতে যেন চিরলগ্ন থাকতে পারে। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের মত বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মহান স্রষ্টারও সংশয় ছিল -আজি হতে শতবর্ষ পরে, কোন সে পাঠক? যিনি তন্ময় হয়ে থাকবেন কবির সৃষ্টিতে। সোচ্চার কোন দাবী নয় কবিসুলভ স্মিত এক প্রার্থনা নিজেরি সৃষ্টির কাছে, তবুও মনে রেখ - ‘যখন পরবে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে... তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে।’ কিন্তু আমার সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক বিস্ময়ে যেন এই উক্তি- ‘তুমি কেমন করে গান করো, হে গুণী!’ ক্ষণকাল থেকে চিরকালের উত্তরণের গুণ যেন আমার থাকে। এই আমার সাধনা, বিচারক আমি নই, বিচারক সেই মহাকাল! শতাব্দীর পর নতুন শতাব্দীতে শিল্প,সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতিটি বিভাগকে সঞ্জীবিত করে বিশাল গগনে রবিপ্রভা দীপ্যমান, রবিপ্রভা আজও মূর্তিমান, তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল! বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ শে বৈশাখ। তিনি কর্মকান্ডে রাজত্ব করেছেন বঙ্গীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর তিন দশক আর বঙ্গীয় চতুর্দশ শতাব্দীর পাঁচ দশকব্যাপী। প্রথম তিরিশ বছর তো প্রস্তুতিকাল গেছে- বাকি পঞ্চাশ বছরেই রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। সেই হিসেবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চতুর্দশ শতাব্দীর কবি ও লেখক। সুদীর্ঘকাল পূর্বে বুদ্ধদেব বসু তাঁর এক ইংরেজী রচনায় রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন ‘Phenomenon’ অর্থাৎ ‘নৈসর্গিক আবির্ভাব’। বাঙালি জীবন ও সংস্কৃতির বর্তমান অবক্ষয়ের কালে এই পর্যবেক্ষণলব্ধ আবিষ্কার যে কী গভীর সত্য তা পূর্বের চেয়ে অনেক বেশী স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাঙালির সমাজ বিবর্তনের আগ্রহী ছাত্রমাত্রই জানেন যে, শুধু এই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ী ও প্রিন্সের ছোট নাতিটির কাছে বঙ্গদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঋণ কতখানি বিশাল। ঋণ পরিশোধের বালখিল্য ইচ্ছা পোষণ মূঢ়তা তো নিঃসন্দেহে অধিকন্তু তা বুঝিয়ে দেয় যে, ঋণের চরিত্র ও ব্যাপ্তি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পর্যন্ত আমাদের নেই। ধারণা থাকলে এই বিচার বুদ্ধি ও সিদ্ধান্ত মনে জাগতে বাধ্য যে, তাঁর প্রতিতুল্য কোনো ব্যক্তি মনীষা বাঙালিদের মধ্যে অদ্যাবধি জন্মাননি। কিন্তু সাহিত্য সাধনা রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিস্বরূপের একটি প্রকাশ মাধ্যম শুধু, এই প্রয়াশ বিস্তৃত তথ্য সচেতনভাবে মনের ভেতরে সংশোধন করে না নিলে তাঁর বিষয়ে নানা ধরনের ভ্রান্তি দেখা দেবেই। সৃজনশীল কল্পনা-মনীষার সঙ্গে, ইতিহাস চেতনা, ভাষাতত্ত্ব, সমাজবুদ্ধি, দেশহিতৈষণা ও সমকালীন বিশ্বরাজনীতিজ্ঞান মিলে যে রবীন্দ্রনাথকে নৈসর্গিক আবির্ভাব হিসেবেই আমাদের উপহার দিয়েছিলেন তাঁকে আদ্যোপান্ত চিনে নেয়া তাই জরুরী কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু এ ঘটনাও সত্যি যে, রবীন্দ্রনাথ অন্যান্য ক্ষেত্রে না হলেও সাহিত্যে অন্তত সারা জীবন কটু সমালোচনা ও বিরুদ্ধতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাঁকে আক্রমণ ও আঘাতের ক্ষেত্র হিসাবে বাণী শিল্প রচনাকে নির্বাচন করার অন্যতম কারণ, আমার ধারণা এই হতে পারে যে, জীবনব্যাপী তাঁর সাধনা যত দিকেই নিয়োজিত থাকুক না কেন, তাঁর প্রধান কর্ম ছিল ভাষা শিল্পের চৌহদ্দিতে কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, চিঠিপত্র। তাঁর অন্যান্য কর্মপ্রয়াস নিয়ে কেউ যে ব্যঙ্গপ্রাণ সমালোচনা মুখর হননি তার সম্ভাব্য কারণ - ব্যবসা করা, কি ব্যাঙ্ক পত্তন, শান্তি নিকেতন কিংবা শ্রী নিকেতন প্রতিষ্ঠার মতো কর্মোদ্যোগে যে কতদূর পরিশ্রম সাধ্য এবং পরিকল্পনা মেধা দাবী করে তা সকলেই বুঝতেন। কিন্তু সাহিত্য নির্মাণ, যার ফলে রবীন্দ্রনাথ কালীক গ-ী অতিক্রম করে বিশ্বের সম্পত্তি-যা তাঁর প্রতিভার মহত্তম পরিচয় সেখানেই কত বিভিন্ন ধরনের আলোচনার মুখোমুখি তাঁকে হতে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখতে শুরু করেছিলেন খুব ছোট বয়সে, প্রকাশিত হয়েছিল কিশোর বয়সেই। তিনি স্কুল পালানো ছাত্র ছিলেন। তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুজনদের মনে উৎকণ্ঠারও অবধি ছিল না, তা সত্ত্বেও তাঁর সাহিত্য প্রচেষ্টায় কেউ বাদ সাধেনি। পারিবারিক এই রুচিবোধ সহ্যশক্তি ও ঔদার্য লক্ষ্য করার মতো। রবীন্দ্রনাথের প্রথম গুণগ্রাহীতার দল তাঁদের বৃহৎ ঠাকুর পরিবারের সদস্য ম-লী। তার কিছু পরিচয় তিনি ধরে রেখেছেন তাঁর ‘জীবন স্মৃতি’তে। তাঁর রচিত ব্রহ্মসঙ্গীতের রসগ্রাহী ছিলেন তাঁর পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথম ভারতীয় আইসিএস মেজো ভাই সত্যেন্দ্রনাথের স্নেহদৃষ্টির ছবি আমরা জানি, কিন্তু কিশোর কবির কবি প্রতিভার গুণগ্রাহীতার কোন পরিচয় তিনি তাঁর আচরণে ফেলে রেখে যাননি। কিন্তু দাদা জ্যোতিন্দ্রনাথ ও নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর প্রশ্রয় ও মনোযোগ সমস্ত শূন্যতা ভরাট করেছিল। জ্যেষ্ঠদের মধ্যে বড়ো ভাই কবি, দার্শনিক-অঙ্কবিদ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দিদি স্বর্ণকুমারী দেবী, সেকালের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক, ছোট ভাইটির প্রতি যে শ্রদ্ধাপূর্ণ স্নেহদৃষ্টি রেখেছিলেন তার পরিচয় ‘ভারতী’ পত্রিকার উদ্ভব ও পরিণতির কাহিনীতে পাওয়া যাবে। এঁনারা ছাড়া পরবর্তীকালে ঠাকুরবাড়ীর কনিষ্ঠ প্রজন্মের বিভিন্ন দল তো ছিলই, যেমন- ভাইঝি ইন্দিরা, ভাগ্নী সরলা, বিভিন্ন ভ্রাতার সন্ততি সুধীন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পৌত্র দিনেন্দ্রনাথ, পিতৃব্য গিরিন্দ্রনাথের পৌত্র গগনেন্দ্র নাথ, অবনীন্দ্র নাথ প্রমুখ নানা গুণীজন। তাঁর দ্বিতীয় গুণগ্রাহী ছিলেন ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুবৃত্ত, যাঁরা প্রায় তাঁর সমবয়সী ছিলেন। এর মধ্যে পড়েন অক্ষয় চন্দ্র, লোকেন পালিত, প্রিয়নাথ সেন, শ্রীশ চন্দ্র মজুমদার, মোহিতান্ত্র সেন, আশুতোষ চৌধুরী এঁনারা সকলেই ব্যক্তি মানুষ ও জায়মান শিল্পী উভয়েরই প্রেমে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলেন। ক্রমে যাঁরা রবীন্দ্রনাথের সমাজের স্থায়ী ভিত্তি তৈরি করেন জীবনব্যাপী রবীন্দ্রচর্চার মাধ্যমে, তাঁরা এসেছেন অনেক পরে। যেমন অজিত কুমার চক্রবর্তী, বিজয় লাল চট্টোপাধ্যায়, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, প্রবোধ চন্দ্র সেন, বুদ্ধদেব বসু, সোমেন্দ্র নাথ বসু প্রমুখ। জীবনব্যাপী রবীন্দ্রচর্চা নয়, কিন্তু অসামান্য ধীশক্তির বলে রবীন্দ্রনাথকে অন্য মাত্রায় চিনে নেবার সুযোগ যাঁরা করে দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে ধূর্জটীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নীহার রঞ্জন রায় এবং আবু সায়ীদ আইয়ুব অগ্রগণ্য। বর্তমানে বিদ্বৎসমাজে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখি তো একাডেমিক ডিসিপ্লিনের অন্তর্গত হয়ে গেছে, তাই রবীন্দ্রচর্চা আজ এতখানিই গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান সাধনা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। স্বদেশের মানুষ তার এক উজ্জ্বল মনীষা ও সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্য প্রতিভাকে যেভাবে গ্রহণ করেছে তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের তীব্র বেদনাবোধ আমৃত্যু সঙ্গী ছিল। তাঁর ছোটখাটো মানসিক দুর্বলতা যেমন - প্রশংসায় খুশি হওয়া, নিন্দায় কষ্ট পাওয়া, কারো বেয়াদবিতে অসন্তুষ্ট হওয়া ইত্যাদি কিছু কিছু থাকলেও এটুকু বোঝার মতো প্রখর কান্ডজ্ঞান তাঁর ছিল যে, বঙ্গদেশে তো অবশ্যই, এমনকি আধুনিক ভারতবর্ষে তাঁর সমতুল্য কবি আর কেউ নেই। নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় তিনি কতটুকু খুশি হয়েছিলেন তা স্পষ্ট নয়, কিন্তু পশ্চিমের দেওয়া মনিহার গলার ফাঁস হিসাবে নিজেকে জাহির করবে কিনা তা নিয়ে তাঁর সংশয় ছিল। তার পরেও পুরস্কারপ্রাপ্ত কবির প্রতি সম্মাননা প্রকাশে দেশবাসীর ঔদাসীন্য তাঁকে আরো কষ্ট দিয়েছিল। তাঁর প্রতি, তার সাহিত্য সাধনার ও দেশব্রতের প্রতি জনগণের নিরঙ্কুশ মনোযোগ তিনি দাবি করতেন। আমরা জানি যে, কবিগুরুর ভক্তবৃন্দের মতোই তাঁর বিরোধী পক্ষও দলে কম ভারি ছিল না। এহেন কৃতঘ্নতায় তিনি কতখানি রুষ্ট হতেন বলা মুশকিল, কারণ ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ তাঁর বিবেচনায় হয়তো বা অশালীন ও গর্হিত আচরণ বলে গণ্য হত, কিন্তু তাঁর নিজের তৈরি শান্তিনিকেতনের মানুষজনও তাঁর মূল্য বোঝে না। বস্তুতপক্ষে, রবীন্দ্র-আলোচনার শতাব্দীব্যাপী ইতিহাস বিচার করলে আমরা তিনটি পৃথক ধারার দেখা পেতে পারি বলে আমার ব্যক্তিগত অভিমত। প্রথমটি হলো, তাঁকে ভালবেসে মমতার সঙ্গে বিচার বিশ্লেষণ ও যাচাইয়ের চেষ্টা। দ্বিতীয়টি হলো, নিরপেক্ষ ও অসম্পর্কিত অবস্থান নিয়ে তাঁর সমস্ত কিছু পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করা। তৃতীয়টি হলো, স্বেচ্ছায় নিরূপিত পূর্ব নির্ধারিত বিরোধী অবস্থান নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধতা করা এবং তাঁর যাবতীয় সুকীর্তিরও অপব্যাখ্যা অন্বেষণ। রবীন্দ্রনাথ, অন্তর্জগতে রূপায়ন, ভাবের আক্ষরিক রূপদান বস্তুতন্ত্রহীনতার প্রবর্তন। বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথ এই বস্তুতন্ত্রহীনতার প্রবর্তক। বিশ্বসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বড়ো মাপেরই এক নৈসর্গিক ঘটনা। তাঁর সমস্ত জীবনের সাধনা, তাঁর জীবনবোধের বিশ্লেষণ করলে একথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমস্ত মণপ্রাণ ছিল বিশ্বশান্তির জন্য সমর্পিত। কবি সকল মানব প্রেমিকদের প্রতি উদ্দাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানালেন, ‘যাত্রা কর, যাত্রা কর, যাত্রীদল এসেছে আদেশ ’! নির্দ্বিধায় বলবো, আমরা শুধু মনেই রাখিনি কাল থেকে কালান্তরে শ্রুত হবে রবির কল্লোল রবীন্দ্রময় আমাদের এই জীবন। তাই কবি বেঁচে আছেন আমাদের হৃদয়ে পূর্ণ শান্তিতে, পূর্ণ আনন্দে, পূর্ণ সৌন্দর্যের এই বাংলাদেশে। আজ ২৫শে বৈশাখ উদার হৃদয়ের বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৭তম জন্মজয়ন্তীতে অকৃত্তিম শ্রদ্ধা।
×