ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দিরাজুর রহমান খান

গল্প -ঝরে যাওয়া ফুল

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ৪ মে ২০১৮

গল্প -ঝরে যাওয়া ফুল

আবদুল আজিজ নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। আবদুল আজিজের গ্রামের বাড়ি ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানাধীন বর্ধনপাড়া গ্রাম। তার পিতার নাম আবদুল হাকিম। অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর একজন সুবেদার মেজর। আবদুল হাকিম সাহেবের সংসারে আছে তার স্ত্রী আর দুটি মেয়ে। আর আবদুল আজিজ একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তান। ড. হাকিম সাহেবের বড় মেয়েটির বিয়ে দিয়েছেন পার্শ্ববর্তী আগলা গ্রামে। আর ছোট মেয়েটি দোহার নবাবগঞ্জ কলেজে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীতে পড়ে। যদিও আবদুল হাকিমের পরিবারটি আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য যথেষ্ট না থাকলেও পরিবারটি ছিল বেশ প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক। বর্ধনপাড়া এলাকাটিতে বেশ কয়েক ঘর সনাতনধর্মী হিন্দুলোকের বসবাস। ভারত বিভক্তির আগে এখানে হিন্দু অধ্যুষিত লোকের সংখ্যাই ছিল বেশি। হাকি সাহেব বেশ দীর্ঘদেহী সুগঠিত শরীরের অধিকারী সুপুরুষব্যক্তি। আর্মিতে যোগদানের পূর্বে বর্ধনপাড়া কমলা সার্কাসের সঙ্গে কমবেশি জড়িত ছিলেন। গানও তিনি খুব সুন্দর গাইতে পারতেন। একেবারে শিল্পীর হুবহু কপি। ষাট ও সত্তরের দশকে আকাশ বাণী কলকাতা কেন্দ্রে প্রতি রবিবার বিকেল তিনটের সময় আধুনিক গানের অনুরোধর আসর হতো। নামকরা সব শিল্পীদের গান হতো। সেই থেকে তিনি গানের পোকা। সামরিক বাহিনীতে চাকরি করে সে সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন বার্ষিক অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ করে অনেক পুরস্কারও পেয়েছেন। বিশেষ করে দেশাত্ববোধক গান গেয়ে। তবে তার সবচেয়ে বেশি ভাল লাগত হেমন্ত, ড. মান্নাদে শ্যামল মিত্র, ভুপেন হাজারিকা, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের গান। তার সবচেয়ে বহুল গাওয়া আর ভালো লাগার গানটি ছিল সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সেই গানটি ‘কতনা হাজার ফুল ফোটে ভুবনেতে তার ছিক ফুল দিয়ে গাঁথা হয় মালা বাকি ফুল ঝরে যায় অনাদরে।’ সেই গানটি গেয়ে হাকিম সাহেব শ্রোতাদের অকুণ্ঠ হাততালি পেয়েছেন। পেয়েছেন অনেক মেডেল। বাবার সার্থক উত্তরসূরি হিসাবে আবদুল আজিজও দোহার নবাবগঞ্জ ডিগ্রী কলেজে সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে বাবার মতোই শ্রোতাদের নিকট থেকে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল। তার বাবার সঙ্গে ঢাকার দয়াগঞ্জ নিবাসী বিখ্যাত পল্লিগীতি শিল্পী ইন্দ্রমোহন রাজবংশীর বেশ জানাশোনা ছিল। সেও অজিজের গান শুনে সন্তুষ্ট। হয়ে ভবিষ্যতে তাকে সঙ্গীত চর্চা অব্যাহত রাখার তাগিদ দিতেন। হাকিম সাহেব তার বড় মেয়ে জুলেখাকে তাদের গাঁয়ের পার্শ্ববতী গ্রাম বাড়ুয়াখালি কাজী বাড়ির ছেলে কাজী গিয়াসউদ্দিনের সঙ্গে বিয়ে দেন। বিয়ের পর সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু গিয়াসউদ্দিন হঠাৎ আদম ব্যাপারীর ব্যবসা করতে গিয়ে অনেকটা পথে বসে যায়। ইদানীং সে সমস্ত বংশাভিজাত্যের মাথা খেয়ে শ্বশুর বাড়িতে ঘৃণ্য যৌতুকের জন্য ধর্ণা দিতে শুরু করেছে। তার ভাষ্য হলো সে ঢাকার ইসলামপুরস্থ নবাববাড়ির গেট সংলগ্ন খুচরো কাপড়ের মার্কেটে একটি দোকান পজিশন নিয়েছে। তাতে প্রায় আট লাখ টাকা লাগবে। তার কাছে নগদ চার লাখ টাকা ক্যাশ আছে। বাকিটা শ্বশুর আব্বাজান দিলেই হবে। অগত্যা উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে আজকাল প্রায় সে তার স্ত্রী জুলেখার সাথে দুর্ব্যবহার করা শুরু করেছে। জুলেখা কেন তার বাবার কাছে থেকে তাকে টাকাটা এনে দিচ্ছে না। অগত্যা মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে আবদুল হাকিম কৈলালের দিকে তার পৈতৃক সূত্রে পাওয়া কিছু আবাদি ধানি জমি বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু করেছে। কিন্তু জামাতা গিয়াসউদ্দিন সামনে রোজার ঈদ সমাসন্ন বিধায় জমির বাজার মূল্য কম হোক কিংবা বেশি হোক বিক্রির প্রক্রিয়া আরো দ্রুততর করার জন্য বারংবার তাগাদা দিয়ে আসছে। কারণ রোজার ঈদে বছরের সিংহ ভাগ বেচাকেনা হয়ে থাকে। আবদুল হাকিম সাহেব তার একমাত্র পুত্র আবদুল আজিজকে তার পার্শ্ববর্তী গ্রাম মহব্বতপুরের মুন্সীবাড়ির মেয়ে রাবেয়ার সঙ্গে বিয়ে দেন। রাবেয়ার পিতা নূরল আলম মুন্সী ছিলেন বংশগতভাবে খুব রক্ষণশীল ও গোঁড়া মুসলিম পরিবারের লোক। রাবেয়া ছিল ঠিক তার উল্টোটি, অসাম্প্রদায়িক ও উদার প্রগতিশীল মানুষ। রাবেয়া ছিল মেধাবী ছাত্রী। শুধু মেধাবীই নয় শিল্পকলার প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই ছিল তার সদর্প পদচারণা। কি গানে, কি কবিতা আবৃত্তি, কি বিতর্কে কোন ক্ষেত্রে সে নেই? সংস্কৃৃতির প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সে সর্বত্রগামিনী। হাকিম সাহেব জীবনাচারণের সঙ্গে রাবেয়ার মাঝে এত গুণগত সাযুজ্যতা পেয়ে যারপরনাই সন্তুষ্ট হলো সে তার পুত্রের জন্য এ রকম একটি মেয়েই বুঝি এতদিন খুঁজছিলেন। আজিজের সৌভাগ্য বোধহয় সৃষ্টিকর্তা নিজের হাতেই লিখে রেখেছেন। একেবারে রাজযোটক বলা যায়। রাবেয়া তার শ্বশুরবাড়ির সবাইকে তার বহুগুণ পটিয়সী বিনম্রাচরণে সবাইকে একান্তে কাছে টেনে নিয়েছিল। তার সরল মায়াবী নির্বিরোধী অনিন্দস্নিগন্ধ মুখখানি দেখে সবাই তাকে ভালবাসে। আজিজ ঢাকার ডেমড়া মাতুয়াইলে মোটামুটি কম ভাড়ার মধ্যে একটি পছন্দসই তিন রুমের বাসা ভাড়া নেয়। এখানে বাসাভাড়া কম বিধায় সে যাত্রাবাড়ীতে বাড়িভাড়া নেইনি। তবে বৌকে পুনঃ পুনঃ এই মর্মে আশ্বাস দিয়ে আসছে যে রিপোর্টারে পদোন্নতি পেলে যাত্রাবাড়ীতে সে আরও ভাল বাসাভাড়া নিবে। আজিজ তার স্ত্রী রাবেয়াকে দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অর্থনীতি বিভাগে স্নাতক সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। রাবেয়া বিয়ের আগে দোহার নবাবগঞ্জ কলেজ থেকে মানবিক শাখায় বেশ ভালভাবেই উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে। স¦ামীর আন্তরিক সহযোগিতায় সে কেবল একাডেমিক শিক্ষাদীক্ষাই চালিয়ে গেল না একই সঙ্গে দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ক্যাম্পাসের ভিতরেই অস্থায়ীভাবে অবস্থিত বুলবুল ললিত কলা একাডেমি দনিয়া শাখায় নজরুল সঙ্গীতে ও লোকগীতি শাখায় ভর্তি হয়েছে। আজকাল ফোক সঙ্গীতের খুব কদর চলছে। কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্যের মতো ফোক সঙ্গীতের দল নিয়ে সেও একদিন বাংলাদেশের জেলায় জেলায় সঙ্গীত পরিবেশন করবে। দনিয়া কলেজের অর্থনীতি বিভাগের সিনিয়র অধ্যাপক সায়েরা বেগম শিউলি আপা তার গান শুনে খুব মুগ্ধ হয়েছেন। ম্যাডাম তাকে বলেছেন সে যেন অব্যাহতভাবে সঙ্গীত চর্চা চালিয়ে যায়। বাফার কোর্স শেষ হলে সে তাকে টেলিভিশনে অডিশনের ব্যবস্থা করে দিবেন। শ্বশুরের বন্ধু ইন্দ্রমোহন রাজবংশী তাকে নিয়ে কনসার্ট করবে। তারও একদিন সঙ্গীতের একক এলবাম বের হবে। সেও একদিন মমতাজ হবে। আজিজের গুণবতী স্ত্রী রাবেয়ার নানা প্রতিশ্রুতিশীল উন্নয়নের পাশাপাশি আজিজেরও উন্নয়নের সূচকটি সমান্তাল ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ইত্তেফাকে রিপোর্টার হিসেবে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের স¦াধীনতা চেতনাবিরোধী কয়েকটি দলের সম্মিলিত জোট আহূত হরতাল অবরোধের নামে জ্বালাপোড়াও মানুষ হত্যা ও পেট্রোল বোমার মাধ্যমে অগ্নিসন্ত্রাসী ধ্বংসাত্মক কর্মকা- বিরোধী জনমত গঠন করে তার রিপোর্টগুলো সর্বমহলে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছে। অনেক নিটক আত্মীয় ও স¦জনদের প্রচ্ছন্ন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সে সত্য প্রকাশে বিন্দুমাত্র দ্বিধানি¦ত হয়নি। নিঃসংকোচে নির্ভীক বীরের মতো সরেজমিনে অকুস্থলে গিয়ে সে সত্যানুসন্ধানী রিপোর্ট করত। যে রিপোর্ট নিঃসংকোচে সকলের নিকট গৃহীত হতো। আজিজ বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা কর্তৃক শ্রেষ্ঠ রিপোর্টারের পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছে। পুরস্কার পাওয়ার পর কবিগুরুর কবিতা আবৃত্তি করে বলেছিল ‘ দ্বার বন্ধ করে ভ্রমটা রুখি। সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুঁকি ’ চাকরির ক্ষেত্রে আজিজের পদোন্নতি হয়েছিল। সে সিনিয়র রিপোর্টারের পদে সমাসীন হয়েছিল। রাবেয়াকে আনন্দে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘রাবু আমার স¦প্নের ফুলগুলো পাপড়ি মেলতে শুরু করেছে। এবার তোমাকে আমি বড় বাসায় নিয়ে যাব’। আজিজ তার পুরস্কারের ক্রেজটি তার বাবার হাতে তুলে দিলে তার বাবা তাকে প্রত্যুত্তরে বলল, ‘বাবা আজিজ তুই আর তোর কাজের স¦ীকৃতি পেয়েছিস। স¦ীকৃতি হলো মানুষের পথচলার পথে আরও এগিয়ে যাওয়ার পাথেও। আমার আশীর্বাদ ও দোয়া তোর সঙ্গে রইবে। বাংলাদেশের মানুষও তার পাশে থাকবে। ইত্তেফাক পত্রিকার প্রধান সম্পাদক সাহেব আজিজের পীঠ চাপড়ে বলেছিলেন, ‘ ইয়াংম্যান এগিয়ে যাও। আমি জানি তুমি পারবে। ’ ‘চিত্ত যার ভয়শূন্য উচ্চ যারশির’ ‘তুমি নিশ্চয় পারবে’? স্ত্রীর অন্তঃসলীলা ফল্গুধারার মতো স¦প্ন প্রসারিনী ভালোবাসা বাবা মায়ের শাশ্বত দোয়া আশীর্বাদ আর সর্বজনীন ভালোবাসায় নিষিক্ত আজিজ আর রাবেয়া খুব বেশিদিন আর কুসুমাস্তীর্ণ, পথে হাঁটতে পারল না। এত নিরবচ্ছিন্ন সুখ তাদের ভাগ্যে সইল না। পথক্রমশ বন্ধুর হয়ে আসছে। একদিন ছুটির দিন সে মিরপুর চৌদ্দ ন¤¦রে অবস্থিত তার ছোট বোনের বাসায় গেল। আজকেই ছোটবোনের স¦ামী কাজি গিয়াসউদ্দিনের হাতে তাকে চার লাখ টাকা পৌঁছে দিতে হবে। নইলে তার দোকান হবে না। আজিজের মা তাকে মেয়ের সুখের দিকে তাকিয়ে অতি তাড়াতাড়ি টাকাটা জামাইয়ের হাতে পৌঁছে দিতে বলেছে। আজিজ বোনের বাসায় খাওয়া দাওয়া করে সামান্য বিশ্রামের পর বোনের বাসা থেকে বিদায় নিয়ে মাতুয়াইলের উদ্দেশে যাত্রা করে। আজিজের বোন সেদিন আজিজকে বলেছিল, ‘ভাইযান আইজকা থাইকা যান। কাইলকা যাইয়েন, দেশের অবস্থা ভালো না’। প্রত্যুত্তরে আজিজ বলেছিল ‘নারে বইন কাইলকা আমার দিনের বেলায় ডিউটি আছে। তাছাড়া তোর ভাবি বাসায় একা, একা থাকে। আজিজ পথে মিরপুর তের ন¤¦র জামদানি মার্কেট থেকে রাবেয়ার জন্য একটি লাল পেড়ে সবুজ শাড়ি কিনল। কাল ২৫ জানুয়ারি ২০১৫ সাল। তাদের বিবাহ বার্ষিকী। রাবেয়া তার কাছে বায়না ধরেছে তাদের কলেজে নবীনবরণ অনুষ্ঠানে এই শাড়িটি পড়ে সে সঙ্গীত পরিবেশন করবে। কলেজের সব ছাত্রীরাই সেদিন অনুষ্ঠানে লালসবুজের শাড়ি পরবে। শাড়িটি কিনেই সে রাবেয়াকে মোবাইল ফোনে বলে রাবু তোমার শাড়ি কিনেছি। তুমি ঠিক যেমনটি চেয়েছিলে, কিন্তু একটা শর্ত আছে। তোমার সায়েরা ম্যামকে বলে তোমাদের কলেজ অডিটোরিয়ামে আমার প্রবেশের অনুমতির ব্যবস্থা করে দিতে। যেন তোমার পরিবেশিত সঙ্গীত সরেজমিনে উপস্থিত থেকে আমি উপভোগ করতে পারি। জানো তো? আমি একজন সত্যানুসন্ধানী সাংবাদিক। প্রমাণ ছাড়া কোন রিপোর্ট করি না। রাবেয়া বেশ পুলকিত কণ্ঠে বলল, ‘আচ্ছা সাংবাদিক সাহেব তাই হবে। তবে আমারও একটা শর্ত অনুষ্ঠানটির সচিত্র খবর যেন পেপারে বেরোয়। তাতে অবশ্যই তোমার বৌয়ের ছবি থাকবে। আজিজ যথারীতি এগারো ন¤¦রের বাসস্ট্যান্ড থেকে শিকড় পরিবহনের বড় বাসে করে গুলিস্তান এলো। গুলিস্তান এসে শিকড় বাস ছেড়ে দিয়ে ফ্লোরা পরিবহনের একটি ছোট বাসে চেপে বসে। বাসটি সরাসরি ডেমরাঘাট অবধি যাবে। রাত সাড়ে নয়টার দিকে বাসটি ভাঙ্গাপ্রেস ছাড়িয়ে খুব দ্রুত গতিতে মাতুয়াইল কাঠের ফুলের নিকটবর্তী হতে আবদুল আজিজের সুখের সংসারে বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো অশনিপাত ঘটল। নিমেশে সাজানো পুলের বাগান জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেল। একটি আগুনের ছোট কুন্ডলী রস্তার বাম পাশ থেকে ছুটে এসে জানালা ভেদ করে বাসের ভিতর সশব্দে আছড়ে পড়ল। কাঁচের বোতলে পেট্রোল ভর্তি বোমাটি নিমিষে বাসটিকে জ্বালিয়ে দিল। ভয়ার্ত চিৎকারে বাসের যাত্রীরা যে যার মতো বাস থেকে সবার আগে নামার জন্য জীবনমরণ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হলো। কেউ বা আগুনে ঝলসে পুড়ে গাড়ির মধ্যেই রয়ে গেল। আবার কেউ বা জীবন্মৃত কোনরকম বাস থেকে কেবল প্রাণটি হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। রাবেয়ার স¦প্ন ছিল। দনিয়া কলেজে নবীনবরণ উৎসবে সে সঙ্গীত পরিবেশন করবে। অবশ্যই তার বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে আজিজের কেনা লালসবুজের শাড়িটি পড়বে। তার সঙ্গীত পরিবেশনের ছবি দৈনিক ইত্তেফাকের পাক্ষিক তরুণ সংখ্যায় সচিত্র প্রকাশিত হবে। অবশ্যই পত্রিকায় উঠবে। কারণ তার প্রিয়তম স্বামী আজিজ তাকে কথা দিয়েছে। কিন্তু নিয়তির কী নির্মম পরিহাস তার বিবাহ বার্ষিকীর সেই বিশেষ দিনটিতে অর্থাৎ ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি কয়েকটি প্রথম শ্রেণীর জাতীয় পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বড় হেডলাইনে খবর বেরুল; ‘যাত্রাবাড়ীর ভাঙাপ্রেসের অদূরে পেট্রোল বোমায় ফ্লোরা পরিবহনের বাসে অগ্নিসংযোগ বেশ কয়েকজন যাত্রী গুরুতর আহত।’ ঢাকা মেডেিকল কলেজের বার্ন ইউনিটের সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে আজিজকে মুমূর্ষূ অবস্থায় ভর্তি করানো হয়েছে। আজিজের শরীরের পঞ্চাশভাগ আগুনে পুড়ে গেছে। মৃত্যুশয্যায় সে তার বাবাকে বাষ্পরুদ্ধ স্থলিত কণ্ঠে খুব কষ্ট করে বলেছিল, বাবা আমি আর বাঁচুম না তুমি আল্লাহ্র দরবারে আমার জন্য দোয়া কইর! কোন স¦প্নই আমার পূরণ হইলো না। বাবা ‘কত না হাজার ফুল ফোটে ভুবনেতে গানটি আমারে শেষ বারের মতো একবার শোনাইয়া দাও। সুবেদার মেজর আবদুল হাকিম অশ্রুসিক্ত বদনে নিজের মুখটি নিচু করে ছেলের মুখের সামনে নিয়ে এসে তার কপালে স্নেহচু¤¦ন এঁকে দিলেন। তারপর পুত্রের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আবদুল আজিজ রাবেয়ার হাতটি খুব শক্ত করে ধরে বেদনাবিচূর্ণ মর্মছেড়া সুরে রাবয়োর উদ্দেশে তার শেষ কথাটি উচ্চারণ করল; ‘রাবু আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। আমার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করো। আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। ঝড়ে যাওযা ফুল কি কখনও মালায় রাখতে হয়। সঙ্গীতের উত্তম সমাঝদার সুবেদার মেজর আব্দুল হাকিম তার একমাত্র পুত্রের মৃত্যুর পর আর কোনোদিন কোনো গানের জলসায় যায়নি। আর কোনো গানও গাননি।
×