ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আরএম দেবনাথ

জুলাই-জুন অর্থবছর পরিবর্তনের কি হলো?

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ৪ মে ২০১৮

জুলাই-জুন অর্থবছর পরিবর্তনের কি হলো?

২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট আসছে। আসছে যে বোঝা যায় অর্থমন্ত্রীর নানা বক্তব্যে। আবার কিছু বোঝা যায় ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের’ (এনবিআর) চেয়ারম্যানের বক্তব্যেও। সবচেয়ে বেশি বোঝা যায় রাস্তাঘাট দেখে। সারা শহরে এখন খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। এটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, নিত্য বছরের ঘটনা। মার্চ-এপ্রিল মাস আসলেই রাস্তা কাটাকাটি শুরু হয়। বোঝা যায় একটা অর্থবছর শেষ হতে যাচ্ছে। টাকা খরচ করতে হবে। বাজেট পেরিয়ে গেলে টাকা পাওয়া যাবে না। অতএব উন্নয়নের কাজে দ্রুতগতি নেমে আসে। হোক বর্ষা, হোক প্রচ- বৃষ্টি, ঘটুক জলাবদ্ধতা, এতে কিছু যায় আসে না। বাজেট শেষ হচ্ছে, নতুন বাজেট আসছে। মাঝখানে শুনেছিলাম এই সমস্যার সমাধান হবে। অর্থবছর পরিবর্তন হবে। জুলাই-জুন অর্থবছর থাকবে না। নতুনভাবে অর্থবছর হিসাব করা হবে, যাতে বর্ষাকালে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি না হয়। শত হোক সরকারের অর্থবছর জুলাই-জুন হলেও ব্যাংকগুলোর অর্থবছর এখনও জানুয়ারি-ডিসেম্বর। ব্যাংকিং খাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতির প্রাণ বলা যায়। উন্নয়নের বিশাল টাকা আসে ব্যাংকিং খাত থেকে। এই ব্যাংকিং খাতের বছর গণনা যদি জানুয়ারি থেকে হতে পারে তাহলে সরকারের অর্থবছর জুলাই-জুন থাকবে কেন? কারা করেছিল এই অর্থবছর? কবে থেকে? কী যুক্তি ছিল এতে? দেখা যাচ্ছে আমরা এরই মধ্যে বাংলা বছরের হিসাব পরিবর্তন করে ফেলেছি। এখন বাংলা মাস আগের মতো হিসাবে হয় না। প্রথম ছয় মাসের হিসাব একভাবে, পরের ছয় মাসের হিসাব অন্যভাবে। এতে প্রতিবছর ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পড়ে। অথচ পঞ্জিকার হিসাবে হয় অন্যদিন। ফলে বাঙালীর পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ বছরের প্রথমদিন দুই দিনে পড়ে। বিরাট পরিবর্তন। শত শত বছরের ঐতিহ্য আমরা পরিবর্তন করেছি। কেউ বাধা দেয়নি। সপ্তাহে দুই দিন ছুটি তাও হয়েছে। শুত্রু ও শনিবার এখন সাপ্তাহিক ছুটির দিন। প্রবল আপত্তি উঠেছিল তখন। ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা তখন বলেছিল সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমাদের ছুটি দুই দিন শুক্র ও শনিবার। বিদেশী ক্রেতাদের ছুটি রবিবার। এতে ছুটি পড়ে যাবে তিন দিন। ব্যবসা তিন দিন বন্ধ থাকবে। রফতানি-আমদানি বিঘিœত হবে। কত হিসাব দেখানো হলো তখন। বলা হলো রফতানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু বাস্তবে কী হলো? বাস্তবে দেখা যাচ্ছে গার্মেন্টস রফতানি, সার্বিক রফতানি কম তো হয়ইনি বরং বেড়েছে, ভালভাবে বেড়েছে। এত সব উদাহরণের পরেও অর্থবছর পরিবর্তন করতে বাধা কোথায় বুঝতে পারছি না। বাজেট পাস হয় জুন শেষে। তা কার্যকর হয় জুলাই থেকে। বাজেটের বরাদ্দকৃত টাকা মন্ত্রণালয় ওয়ারি ভাগাভাগি, উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, তার জন্য টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি জারি, টেন্ডার-পুনঃটেন্ডার প্রক্রিয়া ইত্যাদি কাজ সারতে সারতে এসে যায় জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি। কার্যাদেশ দিতে দিতে এসে যায় বর্ষাকাল। হাতে থাকে কম সময়। তাড়াতাড়ি কাজ করতে গিয়ে কাজের গুণগতমান রক্ষিত হয় না। কন্ট্রাক্টররা কোনমতে কাজ সারে। তারা অনেক সময় কাজ শেষ না করেই বছরের মধ্যে বিলের টাকা তুলে নেয়। এসব হচ্ছে অভিযোগ। এ কারণে কথা হয় অর্থবছর পরিবর্তনের। সরকারের মধ্যেও অনেকে আছেন এই মত সমর্থন করেন বলে খবরের কাগজে দেখি। অথচ কিছু হয় না। হলে বৃষ্টির মধ্যে তো রাস্তাঘাট ভাঙ্গাভাঙ্গির কাজটা অন্তত হতো না। মানুষও দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পেত। কাজের গুণগতমান বৃদ্ধি পেত। বাঙালীয়ানাও রক্ষা পেত যদি বৈশাখ মাসকে সামনে রেখে বছর গণনার একটা মধ্যপন্থা গৃহীত হতো। কিন্তু মনে হচ্ছে সরকার এখন এসব ভাবছে না। সরকার বর্তমান অবস্থার মধ্যেই বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তারা কোন অসুবিধা ভোগ করছে না বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। অতএব এ বিষয়টির ওপর আজকে আর আলোচনা বাড়াচ্ছি না। আলোচনা করা দরকার সর্বশেষ আর্থিক অবস্থা নিয়ে। সর্বশেষ অবস্থাতে দেখা যাচ্ছে বোরো ফসলের খবর ভাল। কোনরকমের দুর্যোগ না হলে এবার বোরোর ফলনে হবে রেকর্ড। দুই কোটি টন চাল হবে বলে হিসাব করা হচ্ছে। এই খবরে বাজারে চালের দাম পড়তির দিকে। এই মর্মে একটা খবরও দেখলাম। গেল বছরের অভিজ্ঞতা ছিল খারাপ। বোরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১০-১৫ লাখ টন ধান-গম আমদানি করতে হয়। বাজেটের ওপর চাপ পড়ে। চালের দামও উর্ধমুখী হয়। মানুষের কষ্ট বাড়ে। এবার অন্তত এই কষ্টটা হবে না। কিন্তু কষ্ট হচ্ছে অন্যত্র। এখন মে মাসের প্রথম। মাঝামাঝি সময়ে পবিত্র রমজান শুরু হবে। এরই মধ্যে বাজারের খবর ভাল নয়। দেখা যাচ্ছে ছোলা, চিনি ও পেঁয়াজের দাম বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। আদার দামও বেড়েছে। মাছ-মাংস, তরিতরকারি ইত্যাদির দামেও চাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। অথচ এসব জিনিসের সরবরাহে কোন ঘাটতি নেই। কাগজে দেখলাম ভোগ্যপণ্যের আমদানি চাহিদার তুলনায় বেশি। বাণিজ্যমন্ত্রীও আশ্বাস দিচ্ছেন। শুনতে পাচ্ছি ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) আমদানি প্রস্তুতিও ভাল। তাহলে মূল্যবৃদ্ধির এ প্রবণতা কেন? বলাইবাহুল্য, সরবরাহের দিক থেকে সবল না হলে সরকার এই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে না। এই সন্দেহের আরও কারণ আছে। খবরে দেখা যাচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারের খবর ভাল নয়। আমরা দীর্ঘদিন পড়তি তেলের দামের সুবিধা পেয়েছি। কিন্তু খবর হচ্ছে অপরিশোধিত তেলের দাম আবার বাড়ছে। বিশ্ব অর্থনীতি একটু ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তেলের মূল্যবৃদ্ধি পেলে বলাবাহুল্য আমাদের দেশে সব জিনিসের মূল্য বাড়বে। আমাদের এক্ষেত্রে তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। আন্তর্জাতিক বাজারে আরও কয়েকটি পণ্যের মূল্য বাড়বে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হচ্ছে। এর মধ্যে চাল-গমও আছে। এছাড়া আমাদের নতুন একটা উৎপাতও আছে। ডলারের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। আমদানি খুবই বেশি, রফতানি বৃদ্ধির পরিমাণ কম। ঋণপত্র খোলা হচ্ছে বেশি। এতে সরকারের উন্নয়নধর্মী মালামালও আছে। অবকাঠামোর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্রও আছে। ফলে আমদানির পরিমাণ বেশ বেশি। এছাড়া ব্যবসায়ীরাও অনেকটা দায়ী। ব্যাংকিং খাত উদারভাবে ঋণ সম্প্রসারণ করে আরেক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। ১৮ সাড়ে ১৮ শতাংশ ঋণ বৃদ্ধি ঘটেছে ১৬ সাড়ে ১৬ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার স্থলে। এই ঋণ সম্প্রসারণের ফলে বেসরকারী আমদানির পরিমাণও বেড়েছে। অনেকের আশঙ্কা এর মাধ্যমে বাইরে টাকা পাচার হচ্ছে। যাই হোক না কেন মোটের ওপর আমদানির পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হওয়ায় ডলারের মূল্য বেশ বেড়েছে। এতে ‘রেমিটেন্স’ যারা পাঠান তারা হয়ত খুশি। তারা এক ডলারের বিপরীতে দুই-তিন টাকা বেশি পাচ্ছেন। খুশি হয়ত গার্মেন্টেস রফতানিকারকরাও। তারা টাকার অঙ্কে বেশি রফতানি আয় করছেন। কিন্তু এই দুই পক্ষ ছাড়াও রয়েছে দেশবাসী। রয়েছে দেশের আমদানিকারক শিল্প। তাদের ব্যবসা করে টিকে থাকতে হবে। দেশবাসীকে পণ্যদ্রব্য খেয়ে বাঁচতে হবে। ডলারের মূল্য বাড়লে পণ্যের মূল্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়বে। আর এটা ঘটতে থাকলে মানুষের কষ্টের সীমা থাকবে না। এর বড় কারণ আছে একটি। মানুষের প্রকৃত মজুরি কোনভাবেই বাড়ছে না। বেকার সমস্যাও প্রকট। শিক্ষিত বেকার প্রচুর। মেয়েরা নতুন করে বেকার হচ্ছে। পোশাক খাতে চাকরি আর বাড়ছে না। ব্যাংক-বীমা খাতে লোকের চাকরি যাচ্ছে। অতএব মূল্যবৃদ্ধি মানে হবে সমূহ বিপদ। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির আরেকটা কারণ এবার সামনে আসছে। ব্যবসায়ীরা ডলারে বিদেশে ঋণ করেছেন। এই ঋণের পরিমাণ প্রচুর। তারা বলছেন দেশে ব্যাংক ঋণের ওপর সুদ বেশি। অতএব চাপ দিয়ে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে প্রচুর স্বল্পমেয়াদী ঋণ দেয়ার বিদেশে করেছেন। এই ‘ডলার’ ‘ডলার’ দিয়েই পরিশোধ করতে হবে। লাগবে প্রচুর ডলার। তাদের ডলার বাজার থেকে কিনতে হবে। এর চাপ অবশ্যই ডলারের মূল্যের ওপর পড়বে। এসব কথা সরকারের মাথায় রাখা দরকার। মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি ছাড়া আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। এবারের বাজেট হবে নির্বাচনী বছরের বাজেট। অতএব আশা করা যায় এতে এমন কিছু থাকবে না যা নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং গরিবের স্বার্থবিরোধী হয়। এটা খেয়াল রেখেই বাজেট হোক- তাই প্রত্যাশা। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×