ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আলী যাকের

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ০৭:২২, ২০ এপ্রিল ২০১৮

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

সম্প্রতি আমি যখন আমার দেশের দিকে তাকাই তখন মাঝে মধ্যে সন্দেহ হয় যে আমি কি বাংলাদেশেই আছি? বাল্যকাল থেকে এই দেশ, দেশের মানুষ আর সমাজকে চিনেছি রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কত বদলে গেছে আমার এই দেশ! আমি বলব না ভাল হয়েছে নাকি মন্দ। কেননা সব অভিমতই আপেক্ষিক। আমার যে কোন অভিমতকেই বয়সের চোখ দিয়ে দেখা একেবারে নিজস্ব মূল্যায়ন বলেই ধরে নেয়া হবে। কিন্তু তবুও লিখছি যখন আমার নিজের কথা, তখন তো বলতেই পারি যে এখনকার বাংলাদেশ আমার ভাললাগে না। কেননা আমি একে চিনি না। এ যেন কোন ভিন দেশে বাস আমার। আমার এ ধরনের মতের পেছনে যুক্তি অবশ্যই আছে। কিন্তু তাকে খ-ন করা যাবে না, এমন অর্বাচীন কথাও আমি বলব না। এখানে একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করি? আমার এক তরুণ ব্যবসায়ী বন্ধু বলছিলেন যে রাস্তায় গাড়ির ভিড় দেখলে তার ভাল লাগে, এমনকি তাকে যদি ওই ভিড়ের কারণে দীর্ঘক্ষণ রাস্তায় বসে থাকতেও হয়। কেননা তিনি মনে করেন সড়কে সড়কে এত গাড়ির প্রাচুর্য আমাদের ক্রমবর্ধমান স্বচ্ছলতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। তাঁর এহেন মন্তব্যকে অস্বীকার করি তেমন যুক্তি আমার কাছে নেই। তবে স্বভাবতই আমার মনে প্রশ্ন জাগে যে, অবকাঠামো নির্মাণের আগে যদি পরিকাঠামো তৈরি হয়ে যায় তাহলে এমন বিপদ তো ঘটবেই। রাস্তা নির্মাণের আগে যদি অবলীলায় আমরা লাখে লাখে গাড়ি আমদানি করি তাহলে এমন দশাই হবে। ভুলে গেলে চলবে না আমরা ১৯৭১ এ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে যখন দেশকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধে গিয়েছিলাম তার পেছনে একাধিক কারণ ছিল। এই কথাগুলো যদিও অসংখ্যবার বলা হয়েছে তবুও মনে হয় না এর প্রয়োজন ফুরিয়েছে। বস্তুতপক্ষে আমাদের দেশের অবস্থা এখন এমন যে এই কথাগুলো আমাদের নিজেদেরই বলতে হয় বারংবার। আমি সরাসরি কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। আমার একটা রাজনীতি অবশ্যই ছিল যা একেবারে আমার নিজস্ব। এর সঙ্গে কোন দলীয় মতবাদের মিল ছিল হয়ত কিন্তু তা সর্বৈব নয়। আমি একজন স্বাধীনচেতা বাঙালী হিসেবে একাত্তরে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। এই বাঙালীত্বের বিষয়টি একেবারেই আমার সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমার ভাষা, খাদ্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, ভাবাবেগ, জীবন দর্শন এবং বিনোদন সবকিছ্ইু বাঙালী ঐতিহ্যজাত। অবশ্যই আমাদের রাজনীতিও এই সাংস্কৃতিক পরিচয়গুলোকে ধারণ করেই নিজেদের কর্মকা-ে ব্রতী হয়। কিন্তু আমি অনেক রাজনৈতিক কর্মীকে এই বিষয়গুলো অবলীলায় ভুলে যেতেও দেখেছি। এগুলো তখনি ভুলা সম্ভব যখন নিজস্ব ক্ষুদ্রস্বার্থ মানুষকে বেশি আকর্ষণ করে। একাত্তরে আমাদের নিজস্বতা নিয়ে কোথাও কোন দ্বিধা ছিল না এবং সেই কারণেই আমরা বোধহয় একতাবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা চেয়েছিলাম। আমি যুদ্ধের নয় মাস বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল, গ্রাম, শহর, আধাশহর এবং নগরে ঘুরে বেড়িয়েছি এবং সর্বত্রই বাঙালীর মুক্তির প্রতি সকল মানুষের সরব এবং নীরব সমর্থন প্রত্যক্ষ করেছি। তখন আমরা আজকের মতো এত আধুনিক ছিলাম না। বহির্বিশ্বের সঙ্গে তখন আমাদের যোগাযোগ অনেক কম ছিল। অতএব, ঠিক যেমন আমরা আজকের তুলনায় তথাকথিত অনাধুনিক ছিলাম তেমন আমাদের চিন্তা- চেতনায় অনেক বেশি নিজস্বতা ছিল। বড় দুঃখের সঙ্গে আমাদের চিরায়ত মূল্যবোধের অভাব আমি প্রত্যক্ষ করি আজকের এই আধুনিক সমাজে। এ বিষয়গুলো মনে করিয়ে দেয় যখন আমরা কোন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হই। তখন আমাদের সকল সভ্য আবরণ থেকে বেরিয়ে আসে আমাদের অসভ্য চেহারাগুলো। এটাই প্রমাণ করে যে একটি আধুনিক সমাজে বাস করেও আমরা এখনও সত্যিকার অর্থে আধুনিক হতে পারিনি। মেধা ও মননে আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছি। অতি সম্প্রতি কিছু দুর্ঘটনার কারণে আমার এই বোধ জন্মেছে যে আমরা কুশিক্ষা এবং অর্ধশিক্ষার বিবরে নিমজ্জমান। সম্প্রতি দুটি দুর্ঘটনা ঘটে গেল। প্রথমটি আমাদের দেশের একজন প্রথিতযশা পদার্থবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর ওপরে কোন এক অর্ধশিক্ষিতের আক্রমণ এবং দ্বিতীয়টি একটি বিমানের দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনায় পঞ্চাশজন মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। এই দুটো ঘটনা বেশ কিছু মানুষের রুচিহীন বিকার এবং অশ্লীল চেহারা উন্মোচিত করে দিল আমাদের সামনে। আমরা স্বাভাবিক সভ্যতা, ভব্যতা এবং যুক্তি পরিহার করে নগ্ন সাম্প্রদায়িকতার উগ্র অবয়ব ধারণ করলাম অবলীলায়। বিংশ শতাব্দীর ’৫০ এর দশক থেকেই বাঙালীর স্বাতন্ত্র, ভাষায়-সংস্কৃতিতে কি জীবন দর্শনে আমাদের শিক্ষিত মানুষকে প্রভাবিত করেছে। রাজনৈতিক কি ভৌগোলিকভাবে একটি ভিন্ন দেশ হয়েও আমাদের সাংস্কৃতিক ভিন্নতা অনেক সময় আমাদের রাজনীতি থেকে বিযুক্ত হয়ে নিজেদের ভিন্ন ভাবতে অনুপ্রাণিত করেছে। এই চিন্তা ভাবনারই সূত্র ধরে আমরা বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দেবার দাবি তুলেছিলাম সেই ’৪০-এর দশকের শেষ ভাগে। এই ভাষার দাবি যে কেবল ভাষায় সীমাবদ্ধ ছিল না তা বলাইবাহুল্য। এ ছিল আমাদের সংস্কৃতি এবং জীবন দর্শনের ভিন্নতা সম্বন্ধে প্রথম উপলব্ধি। আমরা তখন সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের অংশ বিশেষ ছিলাম। আমাদের হয়ে সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতো পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতাদের দ্বারা। তারাই নির্ধারণ করতেন আমরা কি ভাবব, কিভাবে চলব এবং কেমন সমাজে বিচরণ করব। এই পাকিস্তানীরাই আমাদের ভাষার স্বাতন্ত্রের প্রশ্নে বোধহয় অশনি সঙ্কেত দেখেছিলেন দেশভঙ্গের। তাই ভাষা উপলব্ধির উপরেই তাদের প্রথম খড়গটি নেমে আসে। ভাষার প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করে আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত হলো অন্যান্য বিষয়াদির প্রতি এবং আমরা আবিষ্কার করলাম যে, সকল বিষয়ে পাকিস্তানের দুই প্রদেশের মধ্যে সমতা থাকবার কথা থাকলেও পূর্ববঙ্গ সবসময় তাদের বরাদ্দের চেয়ে অনেক কম পেয়েছে। যদিও এই আবিষ্কারটি করেছিলেন বুদ্ধিজীবীরা, এই বৈষম্য সম্বন্ধে মানুষকে সজাগ করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন রাজনীতিবিদরা। ক্রমেই বাঙালী বুঝতে পারল যে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সঙ্গে তাদের পক্ষে আর থাকা সম্ভব নয়। বন্তুত পক্ষে সেই ১৯৫৪ সালে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন থেকে শুরু করে প্রতিটি নির্বাচনেই বাঙালী তার অধিকারের কথা জানান দিয়েছে ভোটের মাধ্যমে। ১৯৬৯ এ এসে যে গণঅভ্যুত্থান হয় তার দ্বারা বাঙালী পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয় যে ভাষা, সংস্কৃতি এবং জাতীয়তার বিচারে তারা ভিন্ন একটি জাতি। বাংলাদেশের বীজ যা বপন করা হয়েছিল সেই ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে তা স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ পরিগ্রহ করে ১৯৬০ এর দশকের শেষ ভাগে এসেই। ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে তাই বাঙালী একেবারে পরিষ্কারভাবে পাকিস্তানকে জানিয়ে দেয় যে তারা একটি ভিন্ন জাতি গোষ্ঠী। পাকিস্তান এটা মেনে না নিয়ে বাঙালীকে দমন করার জন্যে অস্ত্রধারণ করে । ফলে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ এবং ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানবিরোধী যুদ্ধে বাঙালী জয়লাভ করে। জন্ম হয় নতুন দেশের। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। কিন্তু আমার এই লেখা রাজনীতি নিয়ে নয়। তবুও এমন একটা দেশে বাস করি যার প্রতিটি তাৎপর্যপূর্ণ পরিস্থিতির সঙ্গে রাজনীতি একেবারে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। সেখানে যে কোন বিষয়ে বলতে গেলে রাজনীতি তো আসবেই। বস্তুতপক্ষে আমাদের সংস্কৃতি চর্চা কি জীবন চর্যা কোনটিই রাজনীতি বর্জিত নয়। আমি যে নাট্য চর্চা শুরু করেছিলাম সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে তখনও দেশ এবং সমাজের জন্য কিছু সৃজনশীল কাজ করতে হবে এই ধরনের একটি ইচ্ছেই মূলত কাজ করেছিল। আমরা যদি আমাদের নাটক, সঙ্গীত, নৃত্য কিংবা চিত্রকলার দিকে তাকাই তাহলে দেখব এগুলো সবই আমাদের রাজনৈতিক বোধ সম্পৃক্ত। আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাবোধ কিংবা সমাজ কল্যাণের কথা চিন্তা না করে কোন কাজ করিনি। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে আমাদের চিন্তা-চেতনা পরিণত হওয়ার জন্য সর্বদায় কিছু চিন্তাশীল মানুষের সাহচর্য আমরা পেয়েছি। মনে কোন দ্বিধা কি কোন সন্দেহ দেখা দিলেই আমরা ওই সব মানুষগুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পেরেছি। অতীতের এই কথাগুলো নিয়ে যখন লেখার চিন্তা করছি তখন হঠাৎ করেই বর্তমানের একটি ঘটনা মনে এলো। সম্প্রতি রবীন্দ্র সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ সনজিদা খাতুনের ৮৫তম জন্মদিন পালিত হলো। ওই দিনে ভাবছিলাম যে আমাদের সংস্কৃতি চেতনা নির্মাণে এই ধরনের মানুষগুলোর কত বড় অবদান রয়েছে আমাদের জীবনে। এর কারণ সনজিদা খাতুন কিংবা ওয়াহিদুল হক প্রমুখরা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একেবারে নিঃস্বার্থভাবে নিজেদের আদর্শের ওপরে নির্ভর করে পথ চলেছেন যা আমাদের সর্বদায় অনুপ্রাণিত করেছে। কিন্তু তার পরবর্তী প্রজন্ম অর্থাৎ আমাদের নিজেদের সম্বন্ধে কি এই কথাটি আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি? আমার সন্দেহ হয় যে, আমাদের প্রজন্মের মানুষদের কৃতকর্মের জন্য হয়ত পরবর্তী প্রজন্মের সামনে উদাহরণ হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি আমরা। এর নানা কারণ থাকতে পারে, তবে সবচেয়ে বড় কারণ যা তা হলো আমরা নিঃর্স্বাথ এবং একাগ্রভাবে শুদ্ধ সংস্কৃতির চর্চা চালিয়ে যেতে পারিনি। আমাদের জীবন যাত্রায় ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য এবং বিলাস হয়ত আমাদের অনেক সময় কেড়ে নিয়েছে। সকল ব্যক্তিগত সুখের ওপরে উঠে কেবল শিল্প চর্চার আনন্দে বুঁদ হয়ে থেকে কাজ করে যাওয়া ছাড়া এই ভুবনে নতুন কিছু প্রবর্তন প্রায় অসম্ভব। সময় এসেছে এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাববার এবং নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করার।
×