ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাদিক ইসলাম

হ্যামলেটের সমস্যা

প্রকাশিত: ০৭:২২, ২০ এপ্রিল ২০১৮

হ্যামলেটের সমস্যা

হ্যামলেট বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ট্র্যাজেডি। শুধু হত্যা, রক্ত, ষড়যন্ত্র, হিংসা, লোভ, প্রতিহিংসা, দুরভিসন্ধি, মৃত্যু নয় তার চেয়ে আরও অনেক বেশি কিছু এই ট্র্যাজেডিকে করেছে পাঠকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু শত শত বছর ধরে। চরিত্রটির আবেদন এত জোরালো যে সে রক্তমাংসের মানুষের মতো কথা বলে, দ্বিধায় পোঁড়ে, হতাশায় তলিয়ে যায়, শঙ্কায় মুহ্যমান, হাহাকার করে, বিষণœতায় ভোগে, কখনও রাজকীয় আবরণে বদ্ধ, আত্মপ্রত্যয়ী আবার কখনও বা ভেঙ্গে পড়ে অতি সাধারণ মানুষের মতো। সে তীক্ষœ বুদ্ধিসম্পন্ন, সুশিক্ষিত, অবিচল আবার কখনও ভঙ্গুর মনা। ডেনমার্কের যুবরাজ হ্যামলেট। বাবার হত্যাকারী নিজ চাচাকে হত্যা করে প্রতিশোধ নেয়ার তীব্র যাতনায় দগ্ধ কিন্তু প্রতিশোধ নিতে ব্যর্থ। একটা বিরাট ধাক্কা তার ভিতরের সাজানো গোছানো অনুভূতিগুলোকে একেবারে তছনছ করে দেয়। প্রিয় বাবার হত্যা শুধু নয়। হ্যামলেটের প্রথম প্রচ- মানসিক আঘাত; তার বাবাকে হত্যা করে স্বয়ং তার চাচা (ক্লডিয়াস) তাতেই শেষ নয় সে মৃত ভাইয়ের বোনকে (হ্যামলেটের মা) বিয়ে করে অবৈধ রাজা বনে গিয়ে নতুন স্ত্রীকে নিয়ে আনন্দ ফুর্তিতে বল্গাহীন জীবন অতিবাহিত করে; তার জঘন্যতম অপরাধ তাকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করে না। এর উলটো দিকে হ্যামলেট মানুষের এই নিষ্ঠুরতা, বিবেকরহিত রূপ দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায় তার সুস্থ চিন্তা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। গভীর বেদনা আর হতাশা তাকে নিঃশেষ করে দেয়। হ্যামলেটের চাচার উদ্দেশ্যে তার উক্তিই মানুষের আসল রূপ বের করে আনে ‘একজন মানুষ বাহিরে হাসিমাখা মুখ কিন্তু ভিতরে শয়তান’। বাহির থেকে যে মানুষ ভদ্র মুখোশ পরে থাকে সেই কিভাবে নির্দয়ভাবে নিজের ভাইকে খুন করে এই অনৈতিকতার চরম হ্যামলেটের সব সুবিবেচনা ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। তাই হয়ত বারবার সে তার বাবার হত্যাকারীকে হত্যার সুযোগ পেয়েও পিছিয়ে আসে। তাই হ্যামলেট অস্থির কিন্তু বিলম্বিত, অস্বাভাবিক জগতের বাসিন্দা হয়ে যায় হৃদয়হীন, নির্মম পৃথিবী হ্যামলেটকে চিন্তার শরে বিদ্ধ করে। হ্যামলেটের পিতার আত্মা হ্যামলেটকে তার হত্যাকারী চাচার কথা বলে যায়; হত্যার প্রতিশোধ নিতে তার মনের আগুনকে প্রজ্বলিত করে । কিন্তু তবুও হ্যামলেট দ্বিধায় জর্জরিত এটা শুভ আত্মা না শয়তানের অবতার তা নিয়ে। মৃত্যুর মতো ঘটনা ক্লডিয়াসের কাছে ছোট হতে পারে কিন্তু হ্যামলেট অবলীলায় তার বাবার হত্যাকারীকে হনন করতে অপারগ। সেও যদি ক্লডিয়াসকে খুন করে প্রতিশোধের জন্য তবে সেও আরেক ক্লডিয়াস হয়ে যাবে। বাবার হত্যাকারী নিজ চাচা কিন্তু তা জেনেও কেন হ্যামলেট প্রতিশোধ নিতে দেরি করে? কেন সে দ্বিধান্বিত? তবে কি হ্যামলেট ভীত? সে কাজের চেয়ে কেন চিন্তার অনলে বেশি দগ্ধ? আসলে হ্যামলেট ভীত নয়, সে পেশাদার বা তার চাচার মতো নির্মম খুনী হতে পারে না। সে একজন সাধারণ মানুষ, সে আমাদের মতো একজন যে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেয়, আবার তা বাতিল করে দেয়। মনে মনে আমরা যেমন শত্রুকে খুন করে দেই, আবার শত্রুকে সামনে পেলে জর হয়ে যাই, হ্যামলেটও তাই। তাকে এই চিন্তা পুঁড়িয়ে দেয় কিভাবে শুধু লোভের বশে একজন তার নিজের ভাইকে নির্দ্বিধায় হত্যা করে আর অনুতাপহীন জীবন উপভোগ করে যায়। তাই তার প্রথম উক্তি ‘এই ডেনমার্ক শহরের ভিতরে কিছু একটা পঁচে গেছে।’ আধুনিক এক গবেষণায় দেখা গেছে ৯৮ শতাংশ মানুষ তার চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না বরং সে তার চিন্তা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এদিক দিয়ে দেখলে হ্যামলেট একজন আধুনিক ব্যক্তি। শুধু ষোলশ সালের এলিজাবেথান এক ব্যক্তি নয় সে সকল যুগের জন্য প্রযোজ্য। তাই তার সমস্যা একজনের থেকে সকলের হয়ে যায়। মানুষ কিভাবে তুচ্ছ লাভের জন্য এ পৃথিবীতে এত ভয়াবহ কাজ করতে পারে তা হ্যামলেটের চিন্তাকে বন্ধ্যা আর পঙ্গু করে দেয়। হ্যামলেট প্রতিটা ধার্মিক মানুষের মতো তার প্রার্থনারত চাচাকে একা পেয়ে ছেড়ে দেয় সে ভয় পায় এই প্রতিশোধের খুন তাকে আজীবন নরকবাসী করবে। তার আত্মোপলব্ধি ‘একটা স্বর্গ আছে যা আমাদের পরিসমাপ্তি সম্পূর্ণ করে’। অতিরিক্ত চিন্তাশীলতা আর সন্দেহপ্রবণ মন হ্যামলেটের শত্রু কিন্তু সে অপ্রকৃতস্থ চরিত্র নয়। আর মৃত্যু ভয়ও হ্যামলেটকে তাড়িয়ে বেড়ায়। সে জানে তার চাচাকে হত্যা করা মানে নিজের মৃত্যুও ডেকে আনা। তাই তার তাৎপর্যপূর্ণ অনুধাবন ‘হবে কি হবে না। এটাই প্রশ্ন। মৃত্যু মানে শেষ ঘুম আর ফিরে আসা নেই’। মৃত্যু ভয় হ্যামলেটের পুরো সত্তাকে গ্রাস করে ফেলে। সে কি আত্মহনন করবে না এক সাগর বাধাকে প্রতিরোধ করবে? কিন্তু একজন মানুষকে মেরে মৃত্যুর প্রতিশোধ নিলেই কি পৃথিবীর সব জঘন্য পাপ মুছে যাবে? তাই সংকট আচ্ছন্ন হ্যামলেট দোদুল্যমানতায় ভোগে তাই তার মুখ থেকে একেরপর এক দার্শনিক উক্তি বেরিয়ে আসে। সে জানে ‘আমাদের বিবেক আমাদের ভীতু করে দেয়’। তার আরেক স্বগতোক্তিতে মানুষকে নিয়ে তার বিশিষ্ট ধারণা মিলে যখন সে বন্ধু রোজেনক্রাজ আর গিল্ডেস্টার্নের কাছে তার অমূল্য চিন্তা তুলে ধরে। ‘মানুষ কী অসাধারণ এক সৃষ্টি। তার কর্মে কী মহৎ, কী অসীম তার কর্মক্ষমতা, চেহারা, চলাফেরায়, প্রকাশভঙ্গিতে কী প্রশংসাযোগ্য, জ্যোতিময় অবয়ব, এ পৃথিবীর সৌন্দর্য, প্রাণীকুলের সর্বশ্রেষ্ঠ’। কিন্তু পরক্ষণেই বিচলিত হ্যামলেটের ঘৃণা ঝরে পড়ে মানুষের প্রতি ‘কিন্তু আমার কাছে মানুষ একমুঠো ধুলার নামান্তর’। এ থেকেই বোঝা যায় হ্যামলেট জীবনের প্রতি কতটা বিতৃষ্ণ। হ্যামলেটের কালক্ষেপণ তার শত্রু হয়ে যায় যার পরিণতি ছয়টি মৃত্যু আর অবশেষে তার নিজের মৃত্যুও ডেকে আনে। বৃদ্ধ পলোনিয়াস, হ্যামলেটের প্রেমিকার বাবাকে, ক্লডিয়াস হ্যামলেট ও তার মায়ের গতিবিধিতে গুপ্তচর নিয়োগ করে হ্যামলেট তার মায়ের সঙ্গে কথোপকথনের সময় লুকিয়ে থাকা প্রেমিকার বাবাকে শত্রু ক্লডিয়াস ভেবে হত্যা করে। এই বেদনায় আর হ্যামলেটের অস্বাভাবিক আচরণে তার প্রেমিকা ওফেলিয়া পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করে। সব চক্রান্ত্রের হোতা ক্লডিয়াস যখন হ্যামলেটের দুই বন্ধুসহ তাকে চক্রান্ত করে ইংল্যান্ডে পাঠায় খুন করার জন্য হ্যামলেট তা টের পেয়েতার এই দুজনকে হত্যা করে। এদিকে পলোনিয়াসের ছেলে লিয়ার্টিস যে বাবার হত্যার বিরুদ্ধে তড়িৎ সিদ্ধান্ত নেয়; তার বাবার আর বোনের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে হ্যামলেটকে সম্মুখ যুদ্ধের আহ্বান জানায়। কিন্তু কুচক্রি ক্লডিয়াস ষড়যন্ত্র করে লিয়ার্টেসের তলোয়ারে বিষ মাখিয়ে দেয় আর হ্যামলেটের মদে মিশিয়ে দেয় বিষ। যুদ্ধে হ্যামলেট ছুরিকাহত হয় আর দুজনার তলোয়ার অদলবদল হয়ে গেলে লিয়ার্টিসও হ্যামলেটের তলোয়ারে বিদ্ধ হয় মৃতপথযাত্রী লিয়ার্টিস হ্যামলেটকে ক্লডিয়াসের সব ষড়যন্ত্র ফাঁস করে যায়। লড়াইয়ে হ্যামলেট জিতে যায় তাই তার মা আনন্দে ভুল করে হ্যামলেটের মদের পাত্র পান করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সবশেষে হ্যামলেট নিজ হাতে সব ষড়যন্ত্রের হোতা ক্লডিয়াসকে হত্যা করে কিন্তু বিষ মাখানো ছুড়ির আঘাতে মৃত্যুবরণ করে। এভাবে একে একে হোরাশিও ছাড়া সব চরিত্রের মৃত্যু ঘটে। হ্যামলেটের দ্বিধা আর মানসিক যুদ্ধের খেসারত দেয় এতগুলো প্রাণ কিন্তু সব কিছুর মূল নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্রকারী ক্লডিয়াস যে পিছন থেকে সব ঘটনার কলকাঠি নাড়ে। শেক্সপিয়ারের অন্য সব ট্র্যাজেডির মতো ‘হ্যামলেট’ এও ভাগ্য এক অদৃশ্য কিন্তু প্রধান ভূমিকা পালন করে যেখানে মানুষের জীবনের নিষ্ঠুর পরিণতি তার ভাগ্যই বয়ে আনে। তবে এও অনস্বীকার্য যে হ্যামলেট সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ। তার কর্ম আর অবিবেচক ভুল তার ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে। কারণ সে ভাবনাকে প্রশ্রয় দেয় বেশি। তাই বলা হয় হ্যামলেট যত না কর্ম সক্রিয় তার চেয়ে বেশি চিন্তার কাছে জিম্মি। আধুনিক মানুষদের মতো তার জগত যত না বাহ্যিক তারচেয়ে বেশি চিন্তার কাছে বন্দী। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায় সব জানার পরও কেন হ্যামলেট সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। হ্যামলেটের নৈতিকতা, সৎ চিন্তা তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে বাধা। আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলা যায় হ্যামলেট মালটিপল পারসনালিটি ডিজওর্ডারে (সঁষঃরঢ়ষব ঢ়বৎংড়হধষরঃু ফরংড়ৎফবৎ) ভুগছিল; হ্যামলেট ছিল পুরো একা সে শুধু নিজের দ্বৈতসত্তার সঙ্গে বা তার দুটুকরো মনের সঙ্গে অবিরাম যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। হ্যামলেট নিজেই নিজেই নিজের কর্মের সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করে রাখেÑ ‘সবার কাছে শুনো, অল্প জনের কাছে বলো’ তাই দার্শনিক হ্যামলেট তার হৃদয়ের বিরাট ঝড় নিজের মাঝেই চেপে রাখে। আরেকটা কারণ তার বাবার বিনা দোষে মৃত্যু হ্যামলটের জন্য এত বড় আঘাত হয়ে আসে যে তার কাছে পৃথিবীর সবকিছু অর্থহীন, অকারণ হয়ে পড়ে তাই তার ভাবনা আরেকটা মৃত্যু আমূল পঁচে যাওয়া পৃথিবীর কোন পরিবর্তন ঘটাবে না। হ্যামলেটের অতি সচেতন বোধ তার সমস্যাকে জটিলতর করে তোলে তাকে করে দেয় মানসিকভাবে শ্লথ তাই কার্যক্ষেত্রেও সে গতিহীন হয়ে পড়ে। তাই তার সব চিন্তা মৃত্যু কেন্দ্রী যে মৃত্যু চিন্তা পুরো নাটকের প্রধান মোটিফ। হ্যামলেট যে নিজের বিভক্ত সত্তার সঙ্গে বাক যুদ্ধে নিঃশেষিত তার মৃত্যুকালীন শেষ উক্তি ‘এই নিদ্রা চির নিঃশব্দের’ প্রমাণ করে মৃত্যুই তাকে অবিরাম মানসিক রক্তক্ষরণ থেকে মুক্তি দিতে পারে। এখনও হ্যামলেট পাঠ করলে সব পাঠকের মনে হবে হ্যামলেটের সমস্যা পাঠকের নিজের সমস্যা; এদিক দিয়ে দেখতে গেলে হ্যামলেট শুধু সমস্যা জর্জরিত একটি চরিত্র মাত্র নয় হ্যামলেট সব সমস্যা আক্রান্ত মানুষের প্রতীক। হ্যামলেট সব যুগের সব মানুষের ব্যক্তিক দ্বিধার প্রতিচ্ছবি।
×