ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টা মামলার দ্রুত তদন্ত করতে হবে - স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৫:২২, ৮ মার্চ ২০১৮

জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টা মামলার দ্রুত তদন্ত করতে হবে - স্বদেশ রায়

মহাত্মা গান্ধীকে যখন গুলি করা হয় তখন তিনি বলেছিলেন, ‘হা রাম!’ জাফর ইকবালকে যখন ছুরি দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপানো হচ্ছে তখন তিনি বলেছিলেন, ‘দেখো ওরা আমার ছাত্র কিনা?’ আমি জাফর ইকবালকে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তুলনা করছি না। তবে তাঁর আধুনিকতা ও শিক্ষকের পিতৃত্বপূর্ণ প্রাণমনকে স্যালুট না করে পারছি না। কারণ, মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও তিনি ঈশ্বরকে স্মরণ না করে খোঁজ নিচ্ছেন হত্যার চেষ্টাকারী তাঁর ছাত্র কিনা! যদি তাঁর ছাত্র হয়ে থাকে তাহলে সেখানে তাঁর ব্যর্থতা আছে, তিনি তাকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারেননি। এই বেদনা তাঁর নিজের মৃত্যু পথযাত্রা থেকে বেশি। বর্তমানের শিক্ষকদের ভেতর জাফর ইকবাল ও তাঁর স্ত্রী ইয়াসমিন হকের সঙ্গে অনেক বেশি কাজ করেছি ১/১১ এর পরে দুই বছর। আর গভীর সম্পর্ক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের সঙ্গে। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের ক্ষেত্রেও দেখেছি একই রকম ছাত্র অন্তপ্রাণ মানুষ তিনি। ছাত্রের জন্য তিনি মাঝে মাঝে যে দুঃসহ বোঝা বহন করেন তা দেখে মনে হয়, অনেকে নিজের সন্তানের জন্যও তা করেন না। আর ইয়াসমিন হক সম্পর্কে অনেক আগেই লিখেছি, তাঁর মতো সাহসী মানুষ খুব কম দেখা যায়। যাহোক, এঁরা কেউই আজ নিরাপদ নয়। আবারও তা প্রমাণ হলো পুলিশের সামনে জাফর ইকবালের ওপর হামলার ভেতর দিয়ে। জাফর ইকবালের ওপর হামলার পরে দেশব্যাপী যে প্রতিবাদ হয়েছে, ওই প্রতিবাদ বলে দিয়েছে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হারিয়ে যায়নি। প্রয়োজনে তারা রাজপথে আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য আবারও নামতে পারে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে যে প্রতিবাদ দেখা গেছে তা মানুষকে আশান্বিতও করে। তবে তার পরেও বলব, তরুণদের আরও বেশি সোচ্চার হওয়া উচিত ছিল। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকার যা করেছে তা নিয়ে কারও কোন প্রশ্ন নেই। আর যে যাই বলুক না কেন, মাঝে মাঝে আমরা নিজেরাও অনেক সময় একটু হতাশ হই। তার পরেও এটা চাঁদ-সূর্যের মতো সত্য- বাংলাদেশে প্রগতির বাতিঘর শেখ হাসিনা। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে যখন রক্তাক্ত হুমায়ুন আজাদ, বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনার গাড়ি ক্যান্টনমেন্টের গেটে (জাহাঙ্গীর গেটে) আটকে দেয়া হয়, তিনি ওই কয়েক কিলোমিটার পথ হেঁটে হুমায়ুন আজাদকে দেখতে গিয়েছিলেন। আর জাফর ইকবালের ওপর হামলার পরে শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে যে ব্যবস্থা নিয়েছেন, তা নিয়ে ইয়াসমিন হক যা বলেছেন, তার পরে আর কারও কোন কথা থাকে না। বরং শুধু বলা যায়, শেখ হাসিনা গুণীকে সম্মান দিতে জানেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যেমন সমাজের গুণী মানুষদের সম্মান দিতেন, ঠিক একইভাবে সম্মানিত করেন শেখ হাসিনা। এ লেখা যখন লিখছি তখন পত্রিকার পাতায় দেখেছি জাফর ইকবালের হাসি মুখ ও পাশে শেখ হাসিনা দাঁড়ানো। জাফর ইকবালের হাসি মুখ দেখে মন থেকে অনেক মেঘ কেটে গেছে। আর মনে হয়েছে শেখ হাসিনা এমনিভাবে শুধু জাফর ইকবালের পাশে নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের পাশে আছেন। তবে তার পরেও জাফর ইকবালের ওপর এই হামলার ভেতর দিয়ে প্রমাণিত বাংলাদেশে জঙ্গীরা এখনও তৎপর। তাই এখন প্রয়োজন, জাফর ইকবাল হত্যা চেষ্টা মামলা দ্রুত গতিতে সঠিক তদন্ত করা। কারণ, সব থেকে বড় বিষয় দেখা যাচ্ছে, এসব জঙ্গী হামলার তদন্ত কোন এক অদৃশ্য কারণে অতি ধীর গতিতে হয়। অন্যদিকে জঙ্গীরা জামিন পেয়ে যায়। বিচার বিভাগ স্বাধীন। তারা তাদের নিজস্ব গতিতে চলবে। তবে বিচার বিভাগের মনে রাখা দরকার, তারা কিন্তু আন্তর্জাতিক কোন হিউম্যান রাইটস রক্ষা কোর্ট নয়, তারা বাংলাদেশের বিচার বিভাগ। তাই বাংলাদেশের ভাল-মন্দের বাস্তবতা মেনে তাদের জামিন দিতে হবে। উচ্চ আদালতের জামিন দেয়ার অনেক ক্ষমতা আছে। আবার দেশের ভাল-মন্দ চিন্তা করারও অনেক যোগ্যতা আছে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের। তাছাড়া যারা জঙ্গী তারা বাংলাদেশের সংবিধান মানে না, তাদের কেউ কেউ ’৭২-এর সংবিধান মানে না। বাংলাদেশের প্রত্যেক বিচারপতির অন্তরে অবশ্যই ’৭২-এর সংবিধান গাঁথা থাকতে হবে। কারণ ’৭২-এর সংবিধান ৩০ লাখ শহীদ, সাড়ে ছয় লাখ মা-বোনের সর্বশ্রেষ্ঠ ধন ত্যাগের মাধ্যমে পাওয়া। তাদের কারণেই আজ আমরা যার যার অবস্থানে। বিচারপতিরাও ঠিক একই কারণে। তাই মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে পাওয়া এই আধুনিক দেশে যারা জঙ্গীবাদ ছড়াচ্ছে, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণকারীদের ওপর হামলা করছে, যারা ওই হামলার পৃষ্ঠপোষকতা করছে তাদের জামিন দেয়ার আগে বিচারপতিদের অন্তত একবার হলেও বাংলাদেশের মানচিত্রের ছায়া মনের ভেতর আনতে হবে। তাঁরা দেখতে পাবেন, সেখানে কত রক্ত। তাই তার পরেও যারা রক্ত ঝরাচ্ছে, রক্ত ঝরানোর পৃষ্ঠপোষকতা করছে তাদের অবস্থান অবশ্যই জেলের প্রকোষ্ঠে হতে হবে, বাইরে নয়। বিচার বিভাগ স্বাধীন। সরকারের তাই জামিনের ক্ষেত্রে কিছু করার নেই। তবে দুটি কাজ সরকারকে করতে হবে, যা নির্বাহী বিভাগের হাতে আছে। এক. যে কোন মূল্যে হোক তদন্তের গতি বাড়াতে হবে। দুই. প্রতিটি মামলায় সরকারের পক্ষে ভাল আইনজীবীদের দাঁড় করাতে হবে। আর জাফর ইকবাল হত্যা চেষ্টা মামলার তদন্ত থেকেই শুরু করতে হবে দ্রুত গতিতে তদন্তের কাজ। অন্যদিকে অবিলম্বে হাইকোর্ট বা সুপ্রীমকোর্টের কোন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বা বিচারপতি আছেন এমন কারও নেতৃত্ব, সাবেক ও বর্তমান আইন সচিব, পুলিশপ্রধান ও অন্যান্য কিছু পেশা থেকে লোক নিয়ে অবিলম্বে একটি তদন্ত টিম তৈরি করতে হবে। যাদের কাজ হবে এ যাবত বাংলাদেশে যত জঙ্গী হামলা, পেট্রোলবোমা হামলা, সরকারী সম্পদের ওপর হামলা হয়েছে- এসব ক্ষেত্রে যে মামলা হয়েছে ওই মামলাগুলোর তদন্ত কেন ধীর গতিতে হচ্ছে, আর কেন মামলার আসামিরা দ্রুত জামিন পেয়ে যায়, তা তদন্ত করা। এ বিষয়ে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হবে। যাতে করে মন্ত্রিসভা বা সরকারের নির্বাহী বিভাগ তদন্তের গতি বাড়াতে পারে এবং বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ জানতে পারে, কেন অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে এই জামিন হয়ে যাচ্ছে। এমনকি ওই তদন্ত কমিটি যদি এ কথাও জানতে পারে, আত্মীয়তা বা অন্য কোন কারণে কোন বিচারক জামিন দিচ্ছেন বা কোন রাজনৈতিক নেতা থানায় তদ্বির করে আসামি ছাড়িয়ে নিচ্ছেন, বিচার বিভাগের হাতে অনেক আসামি যাচ্ছে না- সেগুলোও তারা উল্লেখ করবেন। জাফর ইকবালের হত্যা চেষ্টা মামলাটি ত্রুটিমুক্ত পথে তদন্ত করতে হবে। ত্রুটিমুক্ত তদন্তের স্বার্থে সব থেকে সতর্ক থাকা উচিত- তদন্তের আগে এই অপরাধী ও অপরাধ নিয়ে নির্বাহী বিভাগের কোন ব্যক্তি বা প্রজাতন্ত্রের কোন কর্মকর্তা যেন আগাম কোন কিছু না বলেন, যা তদন্তকে বাধা দেয়। যেমন, আমাদের বর্তমান আইজিপি অনেক শিক্ষিত মানুষ। কিন্তু তিনি একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, জাফর ইকবালের হত্যাকারী সেলফ মোটিভেটেড। তাঁর অবস্থান থেকে যদি আগেই এভাবে বলে দেয়া হয় তাহলে তদন্ত অবশ্যই বাধা পাবে। কারণ, তিনি যেদিন এ কথা বলেছেন, তার পরের দিন সিসি ক্যামেরার ফুটেজের নিউজ, যা পত্রিকায় এসেছে; তাতে দেখা যাচ্ছে, সামনে ও পেছনে মিলে পাঁচজন অপরিচিতকে। তাই হত্যার চেষ্টাকারী যদি সেফল মোটিভেটেড হয়, তাহলে তারা পাঁচ জন কেন? দুই. বাংলাদেশে জঙ্গী হামলা এই প্রথম নয়। নব্বইয়ের দশকের পর ধীরে ধীরে এরা শক্তিশালী হচ্ছে। লাদেনের সেকেন্ড ইন কমান্ড জাওয়াহিরি গত বিএনপি-জামায়াত আমলে বাংলাদেশে এসেছিল। শুধু তাই নয়, এ পর্যন্ত যেসব জঙ্গী ধরা পড়েছে, তাদের অনেকের সঙ্গে জামায়াত-বিএনপির কানেকশন এবং তারা অতীতে ছাত্র শিবির করত এ ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, জেএমবি, হরকত-উল-জিহাদ এমনি শতাধিক জঙ্গী সংগঠনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। পাকিস্তানী ও আফগান জঙ্গীদের কানেকশন পাওয়া যায়। হয়ত অধিকাংশ এখন নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। তার পরেও তদন্তের আগে পুলিশপ্রধান এ ধরনের মন্তব্য করলে প্রকৃত তদন্ত আশা করা কঠিন হয়ে পড়ে। যা হোক, আমরা আশা করব ভবিষ্যতে তদন্তের স্বার্থে সবাই দায়িত্বশীল হবেন। কারণ, সবার আগে দেশ। যেমন, আমরা অতি ক্ষুদ্র। তার পরেও অনেক সময় অনেক তথ্য পেয়ে সরকারের কোন মহলের কাছে তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে গেলে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে তারা বলেন, বিষয়টি সত্য, তবে দেশের বা তদন্তের স্বার্থে প্রচার করবেন না। এমন অনেক কিছুই কিন্তু এই প্রায় সাড়ে তিন দশকের সাংবাদিকতা জীবনে প্রকাশ করিনি। এ কথা কোন কৃতিত্ব নেয়ার জন্য বলছি না। আমাদের তরুণ প্রজন্মের সাংবাদিকদের জন্যই বলছি, সর্বোপরি সাংবাদিকতাও দেশের স্বার্থে। দেশের প্রয়োজনে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করতে হবে। আবার অনেক বড় সংবাদ, যা প্রকাশ করতে পারলে পেশাগত জীবনে কয়েক ধাপ এগুনো যায়, এমন ক্ষেত্রেও দেশের প্রয়োজনে অনেক তথ্য প্রকাশ করতে নেই। কারণ আমরা যে যে পেশায় থাকি না কেন, আমাদের সবার জন্য সবার আগে দেশ ও মানুষ। সারা পৃথিবীতে নিজ নিজ দেশের নাগরিকরা এটাই মেনে চলেন। সর্বোপরি আবারও বলি, জাফর ইকবালের হাসি মুখ দেখে দেশের অনেক মানুষের মন থেকে মেঘ কেটে গেছে। তবে চাপাতি, ছুরি, পেট্রোলবোমা এগুলো শেষ হয়নি দেশ থেকে। আর এ জন্য অবিলম্বে দরকার জাফর ইকবাল হত্যা চেষ্টা মামলাসহ সকল জঙ্গী হামলার মামলার দ্রুত তদন্ত এবং তদন্তের মাধ্যমে এর শেকড় খুঁজে বের করা। কারণ, যারা এভাবে হামলা করছে তারা কোন পরগাছা নয়। তাদের কোথাও না কোথাও শক্তি আছে। তাই সেটা খুঁজে বের করে সেখানেই আঘাত করতে হবে। [email protected]
×