ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এলেন, জয় করলেন জীবনঘনিষ্ঠ লেখক সেলিম আজাদ চৌধুরী

প্রকাশিত: ০৯:০৮, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

এলেন, জয় করলেন জীবনঘনিষ্ঠ লেখক সেলিম আজাদ চৌধুরী

সেলিম আজাদ চৌধুরী লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন বহুদিন নয় কিন্তু তার প্রকাশ পাওয়া বইগুলো পড়লে মনে হয় তিনি তার মনন, চিন্তা, মেধা দিয়ে নিজেকে তৈরি করেছেন বহু আগে থেকেই। তাই এই ক্ষেত্রে তিনি এলেন এবং জয় করে নিলেন এমন এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল যেন। প্রকাশনা উৎসবে আনা বই দুটি ছাড়াও ইতোপূর্বে ‘না শরীর না প্রেম’ এবং একই সময়ে ‘সুরঙ্গ’ নামে আর একটি উপন্যাস বের হয়েছে তার। অসম্ভব প্রাণশক্তি ধীশক্তি এবং বহুমাত্রিক চিন্তা চেতনার এই মানুষটি নিজেকে যেমন আবিস্কার করেছেন, তেমনি স্বপ্ন দেখেছেন নানাভাবে, নানা আঙ্গিকে। তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা প্রকৃতির আদরে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময়ে। ফেনীর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। শৈশব কৈশোর কেটেছে বিস্তৃণ সবুজের নিস্তরঙ্গ কোলাহলে। সমাজের নানা অসঙ্গতি সঙ্কটের মধ্যে বড় হতে হতে তিনি এর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে চেয়েছেন পরবর্তী সময়ে তার লিখিত গ্রন্থ সমূহে। চেয়েছিলেন হতে অনেক কিছু, হয়েছেন একজন দক্ষ ফার্মাসিস্ট। জীবনের মধ্য সময়ে এসে স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটালেন। সেটি তার লেখক হওয়ার স্বপ্ন। তিনি নিজেই বলেছেন কৃষ্ণ চন্দরের বই পড়ে তিনি একসময় গল্পকার হতে চেয়েছিলেন। লিখে চলেছেন এখন তিনি অবিরাম। আমার তার মুক্তিযুদ্ধের একটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাস ‘সুরঙ্গ’ পড়ার সুযোগ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ ইতিহাসের অংশ। এই উপন্যাসের নায়িকা উপায়হীনভাবে দেশের অভ্যন্তরে থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের সঙ্গে কোন রকম আপোস না করে সাহসের সঙ্গে সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। হারিয়েছেন স্বামী ও শ^শুরের মতো দায়িত্ববান অভিভাবককে। আরও ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারে জেনেও তিনি তার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে এতটুকু সরে আসেননি। সততা ও অঙ্গীকার থেকে সেই কাহিনী হৃদয় গ্রাহ্য করে তুলে ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে নিরলস থেকে যে সাহস ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছিলেন, লেখক তার সহৃদয় দক্ষতার সঙ্গে গুরুত্ব দিয়ে প্রায় অনালোচিত এই অংশটুকু তুলে ধরেছেন। ‘তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে’ তার লেখা প্রথম ভ্রমণ কাহিনী। আমেরিকা ভ্রমণের বিচিত্র ধরনের অভিজ্ঞতাকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন কুশলতার সঙ্গে। সেলিম আজাদ চৌধুরী ভ্রমণ করেছেন আমেরিকা। অত্যন্ত কাব্যিক ভাষায় এই গ্রন্থে তিনি আমেরিকার ইতিহাস, ঐতিহ্যের সঙ্গে অভিবাসীদের সঙ্কট, অনিশ্চিত ভবিষ্যত, শৃঙ্খলা বা নিরাপত্তার অজুহাতে বিমান বন্দরের কর্মরত কর্মচারীদের অমানবিক আচরণসহ ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রক্রিয়া, রিপাবলিকান পার্টির অসন্তোষ এবং এই নির্বাচনের ফল তাদের ওপর মানসিকভাবে কি প্রভাব ফেলবে সেই ভেবে তার যে উদ্বিগ্নতা তা চমৎকারভাবে উঠে এসেছে ‘প্রবাসের স্বপ্ন’ শিরোনামের লেখায়। উঠে এসেছে দেশের চৌকস ছেলেদের দোহা বিমানবন্দরে টয়লেট পরিষ্কার করার কাজে নিয়োজিত থাকায় সেই কষ্টকর বেদনার কথা। নানা ধরনের নি¤œমানের কাজ করে তারা যখন দেশে ফিরে আসে তখন বিমানবন্দরে তাদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়, তাতে মনে হয় না এদেরই কষ্টে উপার্জিত অর্থে দেশের চাকা চলছে এ সত্য তারা উপলব্ধি করছে। এই ভ্রমণ কাহিনীতে স্বপ্নের দোলাচল, মাটির গন্ধ, প্রবাস জীবনের হাসিকান্না, এরাই ভালো লাউঞ্জ, এমিলি ডিকিনসনের জাদুঘর, হুবার ড্যাম, গ্র্যান্ড ক্যানিয়েনের পথে এবং জুয়ার নগরী লাসভেগাস শিরোনামের মধ্যে পৃথকভাবে উঠে এসেছে চমকপ্রদ সব ঘটনা, নানা তথ্য। এ দেশে বসবাসরত মানুষের কথা শুনে মনে হয়েছে যদিও বিদেশে রয়েছে কিন্তু দেশের জন্য তাদের মন কাঁদছে অহরহ। যুক্তরাষ্ট্র পোশাকশিল্পের জিএসপির সুবিধা বাতিল করা হবে না জেনে তারা সেই দেশে থেকেও স্বস্তি পায়। প্রবাসীরা একরাশ স্বপ্ন নিয়ে বিদেশ যায় কিছুদিনের মধ্যে সেই স্বপ্ন ফিকে হতে হতে একসময় ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। সন্তান ও বাবা মার পৃথক দেশে অবস্থানের ফলে যে নিদারুণ হাহাকার ও মর্মবেদনার সৃষ্টি হয় লেখক তার সমস্ত ভালবাসা দিয়ে তা ফুটিয়ে তুলেছেন। এমাস্ট শহরের প্রাকৃতিক বর্ণনা দিতে গিয়ে ঢাকা শহরের সঙ্গে তার তুলনা করে তিনি মার্কিন মুলুকের শহরগুলোকে বিশাল বিরান জনপদ বলে চিহ্নিত করেন। লেখক অনুধাবন করেছেন ভাগ্যের অন্বেষণে যারা আমেরিকা যান আজন্ম লালিত দেশকে তারা কখনও ভুলতে পারেন না। মনের গভীরে দেশের জন্য একটা হাহাকার থেকেই যায়। উইস্টার শহরে গির্জায় শপথ নেয়ার দৃশ্যটি তিনি নিপুণভাবে সঙ্গে তুলে ধরেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ভাগ্যের অন্বেষণে মার্কিন মুলুকে এসেছেন, যারা তারা নাগরিকত্ব গ্রহণে আবেদন করার পর সেই আবেদন গ্রহণযোগ্য হলে তাদের মার্কিন নাগরিকত্বের শপথ নিতে হয়। লাইনে দাঁড়ানো মানুষজনকে দেখে লেখকের মনে হয়েছে এটা তাদের জীবনের একটি অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। লেখক তাদের চোখে মুখে জন্মভূমি ছেড়ে অন্য দেশে আস্তানা গড়ার অপার আনন্দ দেখে দুঃখ পেয়েছেন। প্রচ- রকম তুষারপাতসহ বন্ধুদের প্রবাস জীবনের নানা সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা ও নানা সংবেদনশীল গল্প তার ভাষার সহজ সুন্দর ব্যবহারে মাধুর্যম-িত হয়েছে। কবি এমিলি ডিকিনসনের জাদুঘর দেখার চমৎকার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার এই লেখায়। জাদুঘরটি দুভাগে বিভক্তÑ এমাস্টেড ও এভারগ্রিন। এটি লাল ইটের তৈরি কমলা রঙের একটা দোতলা বাড়ি। এমাস্টে এটিই প্রথম ইটের বাড়ি। এই বাড়িতে ১৮৩০ সালে কবির জন্ম হয়। উল্লেখযোগ্য নিভৃতচারী কবি এমলি এই বাড়িতেই তার ৫৫ বছর জীবনে মোট ১৮০০ কবিতা লিখে নন্দিত হয়েছেন। সেই সাথে রয়েছে আওরঙ্গজেবের সমাধি দেখার ভালো মন্দ নানান অভিজ্ঞতাও। ‘হুবার ড্যাম’ শিরোনামের লেখাটিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে গৃহযুদ্ধের আগে আমেরিকার পতাকা ছাড়াও তাদের বিভিন্ন রাজ্যের নিজস্ব পতাকা ছিল। ১১টি অঙ্গরাজ্য মিলে একটি একক পতাকা তৈরি করতো তারা। এটি ‘কনফেডারেশন ফ্লাগ’ নামে পরিচিত। দক্ষিণাঞ্চলের অঙ্গরাজ্যগুলোর কেউ কেউ শখ করে এখনও এই পতাকা টানায়। তিনি তার লেখার মধ্য দিয়ে সমাজের অক্ষমতার প্রতি যেমন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন তেমনি নিজের দেশক ভাল করে না দেখার মানসিক দৈন্যও তাকে পীড়িত করেছে। আমেরিকায় বসবাসের যে স্বপ্ন তিনি একসময় দেখেছিলেন পরবর্তী সময়ে তার অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পেরেছেন সেই দেশ তার বসবাসের যোগ্য নয়। আনন্দ ও ভালোবাসার সঙ্গে বসবাসের জন্য এই পরিবেশ তার জন্য সহায়ক হবে না বরং তা তাকে বেদনা ভারাক্রান্ত করবে। আনন্দ, উচ্ছ্বাস ও মনভাঙ্গা নানা ঘটনা এই বইয়ের ছত্রে ছত্রে অনুরণিত। কাব্যময় ঢং- এ লেখা এই বইটিকে তাই খুব সহজেই ভ্রমণোপান্যাস বলা যায়। সমকালীন বিষয় নিয়ে লেখা, এই বইটি লেখনীর দক্ষতা এবং লক্ষ্যভেদীর ভাষা এবং মননধর্মী বৈশিষ্ট্যের জন্য সকল শ্রেণীর পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। ‘কোন কূলে আজ ভিড়লো তরী’ তার লেখা জীবন ঘনিষ্ঠ একটি উপন্যাস। বিদেশের রঙিন মোহে দেশ ছেড়ে যারা বিদেশ পাড়ি জমাচ্ছে নিজের শিকড় ছেড়ে তাদের জীবনের উদ্বাস্তুতা, সমৃদ্ধ শূন্যতার হাহাকার ও যন্ত্রণা নিয়ে গড়ে উঠেছে এই উপন্যাসের কাহিনী। পাশাপাশি রয়েছে বিশ^ সভ্যতার ভয়াবহ অন্ধকার। এই উপন্যাসও রয়েছে সেই মনভাঙ্গা একই সুর। উপন্যাসের শেষে সন্তানের সঙ্গে নির্ভয়ে থাকবেন বলে এক বাবা আমেরিকাবাসী হয়ে ক্রমান্বয়ে বুঝতে পারলেন প্রথমদিকে তার মধ্যে যে উজ্জ্বল স্মৃতির হাতছানি ছিল আজ তা নিষ্প্রভ, ম্রিয়মাণ। কপিল নামের এই ব্যক্তি ছেলের সঙ্গে আমেরিকা প্রবাসী হয়ে একসময়ে বেদনা ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেছেন ‘আফিয়া তুমি বেঁচে থাকলে আমি ছেলের কাছে চলে আসতাম না। তোমাকে নিয়ে দেশেই থাকতাম। তুমি নাই বলেই ছেলের কাছে থাকতে এসেছিলাম।’ এই অসহায়ত্ব, এই নিদারুণ কষ্ট আমাদের এখনকার বিদেশে থাকা ছেলে মেয়েদের মা-বাবার একান্ত কষ্ট। কিন্তু কঠিন বাস্তববাদী ছেলে মারুফের কাছে বাবার এই আবেগ অনুভূতি একেবারেই প্রশ্রয় পায় না। বাবার মধ্যের এই কঠিন শূন্যতা এবং শেকড়ের টান ছেলের মনে কোন দাগই কাটে না। লেখক যাকে অভিহিত করেছেন রঙিন মোহ বা ফ্যান্টাসিতে ভর করে শিকড় ছিড়ে তারা ধেয়ে যাচ্ছে এক স্বপ্নের আলো ঝলমল দেশে। কিন্তু দিনে দিনে তারা হয়ে ওঠে উদ্বাস্তুর মতো। সমৃদ্ধ শূন্যতার হাহাকারে ক্ষতবিক্ষত হয় তারা। এই দিকটিই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ‘কোন কূলে আজ ভিড়ল তরী’ উপন্যাসের পটভূমিতে। জীবন বিশ^াসে অটুট কাহিনী নির্মাণের এই কারিগরকে পাঠক মাত্রই তাকে মনে রাখবে। ভাষার এবং প্রকাশের সহজাত গুণে তার বইটি আলাদা প্রাণ পেয়েছে। সাবলীলতা পাঠককে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখবে। শব্দ নির্বাচন ভাষার ব্যবহারের দক্ষতা একে এক অন্য রকম মর্যাদা দিয়েছে। এই তিনটি বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন মোস্তাফিজ কারিগর। প্রকাশক শরীফা বুলবুল। আমি বইগুলোর ব্যাপক প্রচার ও প্রসার কামনা করি।
×