ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রেজা সেলিম

স্বাস্থ্য পরিষেবায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার ও কিছু নীতিগত বিষয়

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

স্বাস্থ্য পরিষেবায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার ও কিছু নীতিগত বিষয়

বাংলাদেশ স্বাস্থ্য পরিষেবার জাতীয় পর্যায়ে সামগ্রিক কোন উপাত্ত তথ্যভা-ার নেই। উন্নত দেশগুলো আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে রোগীর সব তথ্য সংরক্ষণ করে। এতে ফল হয় নানারকম। বিশেষ করে সরকার জানতে পারে কোন্ রোগে দেশের কী পরিমাণ মানুষ আক্রান্ত। আমাদের দেশে অন্যান্য রোগের যেসব জরিপ হয় তাতে প্রাদুর্ভাবের পরিসংখ্যান তথ্য কিছু ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। কিন্তু রোগের চিকিৎসাসেবার অনুসরণীয় বিস্তারিত তথ্য সেখানে থাকে না বা থাকার সুযোগও সীমিত। আমাদের দেশের মতো গরিব দেশগুলোয় চিকিৎসাসেবা এমনিতেই ব্যয়বহুল ও জটিল। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার এ রকম পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে সক্ষম, যা অনেক দেশে প্রমাণিত। গত এক দশকে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সবিশেষ অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, অনেক তরুণ প্রযুক্তি সেবার নতুন আইডিয়া ও ধারণা বাস্তবায়ন করছে, যা বিভিন্ন খাতে উদ্ভাবনী কৌশল নির্মাণে স্বীকৃত হয়েছে ও নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করেছে। যদিও স্বাস্থ্য পরিষেবায় তথ্যপ্রযুক্তির উদ্ভাবন হয়েছে কম, কিন্তু কিছু দৃষ্টান্ত ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে, যা নিয়ে বাংলাদেশ গর্ব করতে পারে। ঢাকার বেশকিছু বেসরকারী হাসপাতাল রোগীদের তথ্য-উপাত্ত বা রেকর্ড সরক্ষণ করে। এই কাজে বেশকিছু আধুনিক ও উন্নতমানের সফটওয়্যার তৈরি করা হয়েছে, যেগুলোর বেশিরভাগই আমাদের দেশে তৈরি করা হয়েছে। যদিও এই সফটওয়্যারগুলো তৈরি করা হয়েছে হাসপাতালের বিলিং রেকর্ড বা টাকা পয়সা লেনদেনের বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর তথ্য সংরক্ষণে যে পরিমাণ মনোযোগ বা অগ্রাধিকার দেয়া দরকার সেটি না থাকায় রোগের তথ্য বিস্তারিত পাওয়া যায় না। ফলে কিছু সীমাবদ্ধতা এখনও বিদ্যমান। আমাদের দেশে স্বাস্থ্য খাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে সবচেয়ে বেশি উদ্ভাবন হয়েছে বেসরকারী খাতে, মাঠ পর্যায়ে। এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে মোবাইল ডিভাইস, ফোন বা ট্যাবলেট। গ্রামে-গঞ্জে সীমিত আকারে ইন্টারনেট বিস্তৃত হওয়ার ফলে মোবাইল ডিভাইস দিয়ে ইন্টারনেটভিত্তিক স্বাস্থ্য ডাটা সংগ্রহ, রোগীদের ফলোআপ এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার বেশকিছু কাজ ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। মাতৃস্বাস্থ্য পরিচর্যায় এসএমএসভিত্তিক কিছু কাজও বিশেষ ফলপ্রসূ হয়েছে। কোন কোন বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ক্যান্সার রোগীদের তথ্য ব্যবস্থাপনায় ও রোগ পরিচর্যায় মোবাইল ফোনের কার্যকরী ব্যবহার করে তথ্যপ্রযুক্তি সেবা উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। স্বাস্থ্য ডাটা সংরক্ষণ কতখানি জরুরী এখন তা নিয়ে বিতর্ক না থাকলেও ডাটা সংরক্ষণ কত মেয়াদের জন্য হবে তা নিয়ে বা কতদিন এই ডাটা ধরে রাখা হবে এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ আছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যথাযথ উদ্যোগ নিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় ডাটা সেন্টার স্থাপন করে অন্তত বছরওয়ারি তথ্য সংরক্ষণ জরুরী। স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদগণ যখন স্বাস্থ্য উন্নয়নের কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তখন এসব ডাটা বিশ্লেষণ জরুরী হয়ে পড়ে। যে দুটি দিক স্বাস্থ্য ডাটা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য সেগুলো হলো- ১. স্বাস্থ্য উন্নয়ন গবেষণায় রোগের প্রাদুর্ভাব, বিস্তৃতি, চিকিৎসা ও মান সংরক্ষণ পর্যবেক্ষণ করা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে যথাযথভাবে রক্ষিত স্বাস্থ্য ডাটা গবেষণার কাক্সিক্ষত ফলাফল নির্ণয়ে প্রধান ভূমিকা পালন করে। ২. স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ ছাড়া বহুমুখী সেবা নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব। একটি সফল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ছাড়া কোন দেশেরই মৌলিক পরিকল্পনা সম্পূর্ণ হতে পারে না। এসব গুরুত্বের কথা বিবেচনায় রেখে আমাদের সরকারের বেশকিছু নীতিগত পদক্ষেপ জরুরীভাবে গ্রহণ করা দরকার। সংক্ষেপে কয়েকটি সম্ভাব্য ও আমাদের দেশে বাস্তবায়নযোগ্য পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করছি- ১. সরকারী উদ্যোগে স্বাস্থ্য ডাটা সেন্টার নামে একটা পৃথক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা দরকার। বর্তমানের স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমআইএস শাখা এ রকম কাজের জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুত নয়। দেখা গেছে সরকার যখন কোন বিভাগ আধুনিকায়ন করে তখন তার জনবলের মধ্যে আগের ধাঁচে কাজ করা জনবল সহজে নতুন কাজের ধারায় সম্পৃক্ত হতে পারে না বা বেগ পেতে হয়। তাছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আধুনিক পদ্ধতিতে ডাটা সংগ্রহ, বিন্যাস ও সংরক্ষণ বর্তমানে হাতে কাজ করা অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ বিপরীত বিধায় এক্ষেত্রে উদ্ভাবনী চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করাই শ্রেয়, যদিও সরকারকে তার পরিকল্পনার সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার জন্য বাস্তবায়নে সমস্যার মুখে পড়তে হয়। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দেশে প্রচুর প্রশিক্ষিত তরুণ জনবল আছে, যারা এই কাজে সরকারকে ভালভাবে সহযোগিতা করতে পারবে। ২. ডাটা সংগ্রহ পদ্ধতি আধুনিক ও উদ্ভাবনী, ব্যয়-সাশ্রয়ী হতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার প্রণোদনাভিত্তিক উদ্ভাবন প্রকল্প হাতে নিয়ে মোবাইল ডিভাইসসহ অন্যান্য সাশ্রয়ী ডিভাইস ব্যবহার করার উদ্যোগ নিতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে ভাল মানের তথ্যপ্রযুক্তির প্রায়োগিক গবেষণা কেন্দ্র বা সুযোগ না থাকায় তরুণদের উদ্ভাবনগুলো যথেষ্ট স্বীকৃতি পাচ্ছে না। কিছুদিন ধরে নানারকম প্রতিষ্ঠান কিছু মোবাইল এ্যাপ্লিকেশন তৈরির উদ্যোগ নিলেও প্রায়োগিক গবেষণার সুযোগ না থাকায় এসব ক্ষেত্রে বিশেষ কোন সাফল্য আসছে না। সরকারকে এই বিষয়ে উপযুক্ত নীতি পরিবেশ তৈরি করতে হবে, বিশেষ করে তরুণদের উৎসাহ দেয়ার নামে কর্পোরেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো নানারকম পুরস্কার দিয়ে কাজের আগেই স্বীকৃতি দিয়ে দেয়ার অভিনব কৌশল হাতে নিচ্ছে। কোন প্রায়োগিক গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি না করে প্রচারের জন্য তৈরি এসব কর্মকাণ্ড বন্ধ হওয়া দরকার। এতে তরুণদের সৃজনশীলের ক্ষতি হয়, যার ভূরি ভূরি প্রমাণ আছে। ৩. স্বাস্থ্য ডাটা বিন্যাসে স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ, গবেষক, চিকিৎসক ও হাসপাতালগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। সরকারকে নিয়মিত স্বাস্থ্য ডাটা বিশ্লেষণ দেখে নিতে হবে। যে কোন পরিকল্পনার আগে তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের সঙ্গে আলোচনা করে নেয়া বাঞ্ছনীয়। এ রকম সমন্বিত আলোচনা পরিকল্পনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত কর্মকর্তাদের জন্য সহায়ক হবে। ৪. স্বাস্থ্য ডাটা ব্যবহার হাসপাতালগুলোর জন্য চিকিৎসা পরিষেবা উন্নয়নে আন্তঃযোগাযোগের অন্যতম জরুরী বিষয়। এক্ষেত্রে রোগীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষায় আমাদের দেশের উপযোগী নীতিমালা বা প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আইন তৈরি করে নেয়া প্রয়োজন। টেলিমেডিসিন সেবায় কারও ব্যক্তিগত তথ্য যেন গোপনীয়তার শর্ত ভঙ্গ না করে সে বিষয়টিও সরকারকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করতে হবে। আশা করি, সরকারের নীতি নির্ধারকমহল প্রস্তাবগুলো ভেবে দেখবেন। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×