ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মহসিন ফয়েজ

নেত্রকোনার লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

নেত্রকোনার লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি

বাউল, ভাটিয়ালী, জারি, সারি, কবিগান, পালাগান, ঢপ, যাত্রা, কিচ্ছা, ধামাইল গান, ঘাটুগান, মেয়েলী গীত, গাইনের গীত, লোকছড়া ও প্রবাদ-প্রবচনসহ লোকসাহিত্য-সংস্কৃতির নানা উপাদান-অনুষঙ্গে সমৃদ্ধ এক জনপদ নেত্রকোনা। বিলুপ্ত ও বিলুপ্তপ্রায় লোকসাহিত্য এবং গীতরঙ্গের এসব উপাদান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন জনকণ্ঠের তরুণ সাংবাদিক, ছড়াকার ও গবেষক সঞ্জয় সরকার। ইতোমধ্যে জনকণ্ঠসহ একাধিক পত্র-পত্রিকায় তার বহু প্রবন্ধ-নিবন্ধ পাঠের সুযোগ হয়েছে আমাদের। এবার তার গবেষণাধর্মী ১৩টি প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘নেত্রকোনার লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি’ নামক একটি বই। বইমেলা ২০১৮-কে সামনে রেখে ‘আবিষ্কার প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত বইটির ভূমিকা লিখেছেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ যতীন সরকার। চার রঙ শোভিত লোকজ আঙ্গিকে দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ। সাড়ে ১১ ফর্মায় ১শ’ ৮৪ পৃষ্ঠার বইটিতে মুদ্রিত প্রবন্ধের বিষয়গুলো হচ্ছেঃ নেত্রকোনার কবিগান ও কবিয়াল, ঘাটু গান, বাউল চর্চা, বাউল কবি ও সাধক, ভাটিয়ালী গান, সারি গান, জারি গান, গাইনের গীত, ধামাইল গান, মেয়েলী গীত, যাত্রাশিল্প, লোক-ছড়া ও প্রবাদ প্রবচন। তবে প্রবন্ধগুলোতে শুধু অঞ্চলের বর্ণনাই করেননি তিনি, পাশাপাশি তুলে ধরেছেন প্রতিটি বিষয়ের নামাকরণ, উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস, পরিবেশন রীতি, সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট, বর্তমান অবস্থা, বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাবার কারণ এবং বিস্মৃতির গহীনে হারিয়ে যাওয়া লোকসংস্কৃতির অসংখ্য ধারক ও বাহকের নাম। প্রথম প্রবন্ধের নাম ‘নেত্রকোনার কবিগান ও কবিয়াল’। এতে কবিগানের উদ্ভব, উদ্ভবকাল, পশ্চিমবঙ্গের কবিগানের সঙ্গে এ অঞ্চলের কবিগানের পার্থক্য ও সাযুজ্যতা এবং নেত্রকোনা অঞ্চলের কবিয়ালদের পরিচিতি প্রসঙ্গে নিখুঁত বর্ণনা করেছেন তিনি। দ্বিতীয় প্রবন্ধ ‘নেত্রকোনার ঘাটু গান’-এ তুলে ধরেছেন শ্রীহট্টের আজমিরিগঞ্জ থেকে শুরু হয়ে পূর্ব ময়মনসিংহের গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়া ঘাটু গানের উৎপত্তি, বিকাশ এবং এর সামাজিক প্রেক্ষাপটের নানা দিকসমূহ। ‘ঘাটুগান’ নিয়ে এমন তাত্ত্বিক ও গবেষণাধর্মী আলোচনা এর আগে খুব একটা হয়নি। ‘নেত্রকোনার বাউল চর্চা’ এবং ‘নেত্রকোনার বাউল কবি ও সাধক’ প্রবন্ধ দুটিতে লেখক বাউল মতবাদের উদ্ভব, বিকাশ, পৌরাণিক ধর্ম-দর্শনের সঙ্গে ও বাউল ধর্ম-দর্শনের পার্থক্য এবং কুষ্টিয়া-নদীয়ার বাউলদের সঙ্গে পূর্ব ময়মনসিংহ তথা নেত্রকোনা অঞ্চলের বাউলদের বৈশিষ্ট্যগত ভিন্নতার স্পষ্ট ব্যাখা করেছেন। তুলে ধরেছেন নেত্রকোনা অঞ্চলের প্রয়াত এবং নবীন-প্রবীণ ৩৬ জন বাউল সাধকের পরিচিতি, গান এবং ‘মালজোড়া বাউল গান’ এর ইতিহাস। ভাটি অঞ্চল খ্যাত নেত্রকোনার দুটি বিশেষ গীতরঙ্গ হচ্ছেÑ ভাটিয়ালী ও সারিগান। নৌকা ও মাঝিকেন্দ্রিক এ দু’ ধরনের গানের পরিবেশন রীতি এবং সার্বিক প্রেক্ষাপট নিয়ে লিখেছেন ‘নেত্রকোনার ভাটিয়ালী গান’ এবং ‘নেত্রকোনার সারিগান’ নামক দুটি আলাদা প্রবন্ধ। সুন্দরবন অঞ্চলের গাজী-কালুর কাহিনী খ্যাত গাইনের গীত সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে এক সময় নেত্রকোনা অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কাহিনী বর্ণনা করেছেন ‘নেত্রকোনার গাইনের গীত’ প্রবন্ধে। তেমনি নারীদের মনোবেদনার প্রতিচ্ছবি খ্যাত ধামাইল ও মেয়েলী গীতের উদ্ভব, বিকাশ এবং পরিবেশন রীতির বর্ণনা পাওয়া যায় ‘নেত্রকোনার ধামাইল গান’ ও ‘নেত্রকোনার মেয়েলী গীত’ নামক প্রবন্ধ দুটিতে। লোকসংস্কৃতির জনপ্রিয় মাধ্যম যাত্রাশিল্পের এক সময় জয়জয়কার পরিস্থিতি ছিল নেত্রকোনায়। যাত্রাকে ঘিরে এক সময় নেত্রকোনা শহরের সাতপাই রেলক্রসিং এলাকায় গড়ে ওঠেছিল যাত্রাপল্লী এবং বেশকিছু সাজঘর। যাত্রার উৎপত্তি ও চড়াই-উৎরাইয়ের ইতিহাসের পাশাপাশি এ অঞ্চলের পেশাদার ও অপেশাদার যাত্রাদলগুলোর ইতিহাস এবং কলাকুশলীদের জীবনকাহিনী তুলে ধরেছেন ‘নেত্রকোনার যাত্রাশিল্প’ প্রবন্ধে। এছাড়াও ‘নেত্রকোনার লোক-ছড়া’ এবং ‘নেত্রকোনার প্রবাদ-প্রবচন’ প্রবন্ধ দুটিতে তুলে এনেছেন নেত্রকোনার গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য লোকছড়া এবং প্রবাদ-প্রবচনসমূহ। এক কথায় বলা যায়, নেত্রকোনার লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির নানা উপাদান-অনুষঙ্গকে এক মলাটের মধ্যে প্রকাশ করার এক নিরন্তর সাধনায় ব্রতী হয়েছেন সঞ্জয় সরকার। তবে বইটি পাঠের পর শুধু নেত্রকোনা অঞ্চলের পাঠকেরাই নন, বাংলা ভাষাভাষী সব পাঠকই আমাদের গৌরবোজ্জ্বল লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির নানা ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাবেন। এমনকি আগামী প্রজন্মের জন্যও বইটি ঐতিহ্যের স্বাক্ষর হয়ে টিকে থাকবে। তাই আশা করি সদ্য প্রকাশিত বইটি অবশ্যই পাঠকপ্রিয় হবে। যে মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সঞ্জয় সরকার গবেষণায় ব্রতী হয়েছেন সে উদ্দেশ্য অবশ্যই সাধন হবে।
×