ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষি জমিতে ইটভাঁটি

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২৮ জানুয়ারি ২০১৮

কৃষি জমিতে ইটভাঁটি

আবাদী জমি মানেই ফসলের মৌসুম। ফসল মানেই মানবের খাদ্য। জীবন ধারণের জন্য মানুষকে খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। আর সেই খাদ্য মানুষকেই উৎপাদন করতে হয়। উদপাদিত ফসল বা শস্য থেকেই যোগান হয় খাদ্যের। কিন্তু সেই জমিই যদি হয়ে যায় উজাড়, তবে চাষাবাদের ক্ষেত্রও হতে থাকে সঙ্কুচিত। লোপাট হয়ে যাচ্ছে আবাদী জমি। জনসংখ্যার তুলনায় জমির পরিমাণ যদি ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে, তবে খাদ্যশস্য উৎপাদনও কমে আসে। চাহিদানুযায়ী খাদ্য যোগান হয়ে পড়ে দুষ্কর। একদা এই বাংলায় চোখ যতদূর যেত, ততদূর দেখা যেত আবাদী জমি, ফসল তার কানায় কানায়। কৃষি জমির মাঝখান দিয়ে হেঁটে গেলে দেখা যেত সবুজ আর সবুজ পতাকার রং। আবার ফসল পাকার মৌসুমে দেখা যেত সোনালি রঙে সেজে উঠেছে জমি, সোনার বাংলার সোনালি ফসল। সরিষা ক্ষেতে হলুদ ফুলেরা নেচে উঠত বাতাসের আমেজ নিয়ে। কৃষকের মুখে হাসি ফুটে উঠত যখন পেকে সোনালি হতো ধানী জমি। জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জমির পরিমাণ যাচ্ছে কমে। আবাদী জমি পরিণত হচ্ছে ক্রমশ আবাসিক ভূমিতে। কল-কারখানাসহ নানাবিধ স্থাপনায় ঢেকে গেছে কৃষি জমি। সবচেয়ে ক্ষতিকর যে কাজটি হচ্ছে, তা হচ্ছে আবাদী জমির ওপর আইন লঙ্ঘন করে অবাধে গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত ইটভাঁটি। কৃষি জমিগুলো ধ্বংস করে গড়ে ওঠা এসব ইটভাঁটিতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আশপাশের পরিবেশ এবং স্থানীয় কৃষকরা। কৃষি জমির উপরের অংশের মাটি দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ইট। ইটভাঁটির ক্ষতিকর ধোঁয়ায় আশপাশের কৃষি জমিগুলোর ফলন যাচ্ছে কমে। ফলে বাধ্য হয়ে কৃষকরা ক্রমশ সরে যাচ্ছে কৃষি খাত থেকে। দরিদ্র কৃষক বা যারা স্বল্প জমির মালিক তারা বেকার হয়ে পড়ছে, ফলে তারা বাধ্য হয়ে জীবিকার প্রয়োজনে হয়ে যাচ্ছে ইটভাঁটির শ্রমিক। ফলে বর্গচাষী দরিদ্র কৃষক হয়ে যাচ্ছে স্বল্প মজুরির শ্রমিক। বদলে যাচ্ছে তার জীবনজীবিকার পেশা। পরিবেশ অধিফতরের নাকের ডগায় এবং চোখের সামনে আবাসিক এলাকার মাঝখানেও একের পর এক গড়ে উঠছে অবৈধ ইটভাঁটি। এসব ভাঁটিতে জ্বালানি হিসেবে পোড়ানো হচ্ছে পরিবেশের নিকটতম বন্ধু বৃক্ষ। অবাধে নিধন হওয়া বৃক্ষগুলো এ খাতে ঠাঁই পাচ্ছে। ভাঁটি থেকে নির্গত ছাই ও ধোঁয়া বায়ু দূষণের অন্যতম উপাদান। এ ছাই ও ধোঁয়া মূলত কার্বন মনো-অক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইডের উৎস। যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর, আবার ইট প্রস্তুত খাত দেশের গ্রীন হাউস গ্যাসের সবচেয়ে বড় উৎস হওয়ায় হুমকির মুখে পড়ছে মানুষের খাদ্যচক্র। পরিবেশ অধিদফতরই বলছে, শুষ্ক মৌসুমে ঢাকার বায়ু দূষণের জন্য ইটভাঁটি দায়ী ৫৮ ভাগ। এভাবে পরিবেশ দূষণের ফলে দিন দিন হুমকির মুখে পড়ছে জনস্বাস্থ্য। দেশে বর্তমানে ড্রামচিমনির ভাঁটিসহ ইটভাঁটির সংখ্যা প্রায় নয় হাজার সাত শ’টি। যার প্রায় পঞ্চাশ ভাগই অবৈধ। এসব ভাঁটিতে আধুনিক প্রযুক্তির পরিবর্তে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণভাবে অবৈধ ড্রামচিমনির ও ১২০ ফুট উচ্চতায় স্থায়ী চিমনির ভাঁটিতে পোড়ানো হচ্ছে ইট। অথচ ইট প্রস্তুত ও ভাঁটি স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৩-তে বলা আছে আবাসিক, সংরক্ষিত বা বাণিজ্যিক এলাকা, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা, সদর, সরকারী বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বন, অভয়ারণ্য বাগান বা জলাভূমি, কৃষিজমি ও প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকায় কোন ইটভাঁটি স্থাপন করা যাবে না। জেলা প্রশাসকের অনুমতি ছাড়া আইন লঙ্ঘন করে নিষিদ্ধ এলাকায় অবৈধ ইটভাঁটি প্রস্তুত করলে পাঁচ বছরের কারাদ- বা অনধিক পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-িত করা হবে। কিন্তু বাস্তবে দৃশ্যপট ভিন্ন, আইন রয়েছে কেতাবেই সীমাবদ্ধ। কোন অনুমতি ছাড়াই দেশজুড়ে ইটভাঁটি স্থাপন করা হয়েছে। এর ভয়াবহ পরিণাম নিয়ে কেউ ভাবছে না। জনগণ চায়, এসবের নিয়ন্ত্রণ। জনস্বাস্থ্য রক্ষায়ও বিষয়টি গুরুত্ব পাবেÑ এমন নিশ্চয়তা চায় দেশবাসী।
×