বাংলা কবিতার অভিমুখ কোন দিকে? এই প্রশ্নটা আমাকে এক অনুসন্ধানে নিয়োজিত করে। বলাবাহুল্য বিষয়টি একেবারেই নৈর্ব্যক্তিক আসেনি আমার কাছে কখনও। জনপ্রিয় কবিদের কবিতার লাইন ঘাঁটতে গিয়ে দেখছি দর্শন কম চটক বেশি। অন্তমিল আর ছন্দের চক্করে পড়ে বক্তব্যের শিরদাঁড়া সোজা রাখাটা দুরূহ। খুবই চটুল তুমি আমি প্রেম ল্যাম্পপোস্ট সেলফোন মার্কা ধ্বনিসর্বস্ব কবিতাগুলো পাবলিক ভাল খায়, অথচ তার এ্যান্ড প্রোডাক্টটা কী? মানুষের সেরেব্রাল ফ্যাকাল্টি বা চিন্তার কোষগুলো যদি খাদ্য পুষ্টি না পায় তাহলে সে সাহিত্যের মানে কী, সে কবিতার সার্থকতা কোথায়?
বীরেন মুখার্জীর ‘গুচ্ছঘাসের অন্ধকার’- নামকরণটিই বলে দেয় গ্রন্থের অভিমুখ। আমরা বুঝি এ পর্যন্ত নিজস্ব যাবতীয় উত্তরণ অবতরণকে কবি ধরতে চেয়েছেন এই গ্রন্থে। মূলত ব্যক্তিগত ভ্রমণ হলেও কবির বিচরণ সমাজবিচ্যুত অতীব ফ্যান্টাসি নয়। একেবারে সমাজরস এবং প্রাসঙ্গিকতায় জারিত সে ভ্রমণ। পাঠক সহজেই নিজেকে রিলেট করতে পারেন এই গমনাগমনের সঙ্গে।
মৃত্যুপাতের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি তবু
দৌড়ে যাচ্ছি ক্রমে
প্রসঙ্গের অন্তরালে
হতাশার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে সংগোপনে...
এই জাতীয় অজস্র উক্তি বারংবার বুঝিয়ে দেয় কবির গভীরতা। প্রাসঙ্গিকভাবেই যেটা মনে আসে বীরেন নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী কবি। তার কবিতার ভাবগুলো অত্যন্ত গভীর অথচ তা একেবারেই দুর্বোধ্য নয়। ‘মদ ও মধুর সঙ্গীত’ কবিতাটি ধরা যাক। কবি এখানে নিসর্গযাত্রী। অসীম ক্ষমতা তার। গোটা প্রকৃতি চলছে তার অঙ্গুলি হেলনে। তিনি নিজের মতো সাজিয়ে নিচ্ছেন প্রেক্ষাপট।
গোপনে ভেসে আসা পাহাড়ের ডাকে
প্রসঙ্গ পাল্টে এখন নৈঃশব্দ্য ট্রেনের যাত্রী
আশ্রম ঘুরে ঘুরে অবলোকন করছি
সবুজের নিশিযাপন।
কখনো বালুমহালের ইশারা সরিয়ে
নদীর ললিত চিত্রপটে বসিয়ে দিতে চাইছি
স্রোতের কারুকাজ, নিস্তব্ধ আকাশে
মেঘের ডাক পাঠিয়ে সঞ্চয় করছি
মদ ও মধুর সঙ্গীত
যাযাবর রোদ, সঙ্গী হবে কী ফের কোনদিন?
ব্যতিক্রমী হতে গিয়ে যে কবি দুর্বোধ্যতায় ঘুরপাক খান, সে কবির সন্ধান পেলেই তাকে আমি সঙ্গত কারণে বর্জন করি। বার বার পড়েও বীরেনকে বর্জন করতে পারলাম না। সঙ্গী হতেই হলো। সঙ্গী হয়ে বুঝতে পারলাম, বীরেন একটি কবির নাম কখনোই নয়, বীরেন একটি জার্নি- একটি উড়ান। কবি সে কথা স্বীকারও করেন।
তৃষ্ণা আছে বলেই হেঁটে যাচ্ছি নিরন্তর...
এই গমনের মধ্যে কোথাও অপেক্ষা থেকে যায়। কোথাও স্মরণ থেকে যায়। থাকে রোমন্থন। কিন্তু সে কে? প্রেম, প্রকৃতি না নিছক নিসর্গ! এই উত্তর পাওয়াটা কঠিন।
ওই চোখে দেখেছি এক পৃথিবীর সৌন্দর্য
ক্লান্তি নিরসনের অফুরন্ত সম্ভাবনা
ছন্দময় কথার ভাঁজে ভাঁজে প্রিয় আশ্রয়ের শোভা
দেখেছি, একজোড়া চোখ অনুচ্চ বর্ণমালায়
কীভাবে বদলে দিতে পারে কবির বোধিসত্তা।
সত্যি বলতে কি কবিতার ব্যাখ্যা হয় না, কবিতার ভূমিকা হয় না, কবিতা পড়তে গেলে কবিকে বুঝতে হয়। নানা ঘাত প্রতিঘাতে প্রতিকূলতা প্রশ্রয়ে একটা মানুষের যে কবিসত্তা গড়ে ওঠে তার সন্ধান না পেলে কবিতার রসাস্বাদন সম্ভব নয়।
গ্রন্থের ‘অপরিণামদর্শী হাওয়া’- শিরোনামটি একটু ভাবায় এবং কবির উদ্দেশ্য জানান দেয়। বোঝা যায় যে, কবি অকপট এবং তার হৃদয়ের আহ্বানকেই প্রাধান্য দেবেন, টাকা-আনা-পাইয়ের হিসেবকে নয়। এ কথা অবশ্য কবিমাত্রের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, এত কিছু ক্ষেত্র থাকতে, অর্থোপার্জন বা পেশার হাজার বিকল্পর মধ্য থেকে এক অনিশ্চিত কবিজীবনকে বেছে নেয়া কেন! কবির সরল ব্যাখ্যা গেঁথে যায় আমার মনের গভীরে।
মানুষ মাত্রই হাওয়ার সঙ্গী- মুদ্রাদৃশ্যে খোলস পাল্টিয়ে নতুন জন্মের প্রত্যাশা করে।
কবি এক ত্যাগের নাম। এটা ফুটে ওঠে কবিতায়। আত্মবিক্রয় নয় কবি যায় আত্মনিমজ্জনে। তথাপি এই বক্তব্য বুঝিয়ে দেয় কবির নিহিত আশাবাদ। মানুষের বেঁচে থাকা এক আশাবাদ ছাড়া আর কী-ই বা হতে পারে। নিরাশ মানুষ তো বেঁচে থাকতে পারে না। আত্মহত্যার সাহস না থাকলেও নৈরাশ্যে বেঁচে থাকা তো আত্মহত্যারই ভিন্ন নাম। সে পথে কবি যেতে চান না।
কপর্দকহীন সময়, নীতির নিমজ্জন বুঝি
কাদা-মাটি-জল ছুঁয়ে
নেমে যাই জন্মান্তরে
সাধ ও সাধনার কুঁড়িতে
তীর্থজলে
ভাসিয়ে প্রণয়সংহিতা
কখনও আকাক্সক্ষার গায়ে মাখি শূন্যতা;
কবির অনেক দ্যোতনা, ব্যাখ্যা। কবি কি এক স্প্রিট পারসোনালিটি? তা না হলে কি করে টের পান যে তিনি যখন নিদ্রাচ্ছন্ন- পৃথিবী তখন জেগে আছে?
আমি ঘুমিয়ে পড়লে-
প্রতিটি বাগান জেগে থাকে উঠোনের পাশে;
নেচে ওঠে কৌশল-সূত্র; সপ্রশ্ন কৌতূহল!
সারাদিনমান ভুলে
গুপ্ত সামিয়ানা খোলে কেউ কেউ
অকস্মাৎ শয্যাপাশে।
যদিও বীরেন আমাদের তুলনায় বয়সে তরুণ, তবু লিখছেন তো বহুদিন। তার লেখা পরিণত, পরিমিত, আবেগের প্রকাশ কম, ব্যাপ্তি বেশি। কবির মনের গভীরে যে ব্যাপ্তি তা এক আধ্যাত্মিকতার ইঙ্গিত দেয়। নব্বইয়ের কবি বীরেন নয়টি কাব্যগ্রন্থের স্রষ্টা। কিন্তু সেভাবে এক নিশ্বাসে আলোচিত হচ্ছে না কেন? এপার বাংলাতে অন্তত নয়। এই চটুলতা আর চাটুকারিতার যুগে আমরা বীরেনের মতো শক্তিশালী একজন কবিকে সঠিক নজরে দেখছি তো? আমার সন্দেহ থেকে যাচ্ছে।
অন্ধকার ম্লান হবে একদিন- সব মুখরতা, বিবমিষা দূরে যাবে সময়ের ক্লেদাক্ত সিঁড়িপথে। হতে পারে, ফুটে উঠবে নিরেট আলো কোনদিনÑ সত্য ও সভ্যতার হাতে হাত রেখে। এমন বিশ্বাসে চোখে রাঙিয়েছি শৈশবের দিন; অথচ দেখো, আমি এক আশ্চর্য ফুল, কীট ধ্বংসের অভিযোগে ঝুলে থাকি নিঃসঙ্গ কুঠুরিতে-
জন্মান্ধ পাথর জানে প্রাতঃস্নানে মেতেছে নগর
যখন গড়াচ্ছে জল শুদ্ধতার
রাশি রাশি ছড়িয়ে পড়ছে কথা
মুগ্ধতার ছিপি খুলে উড়ে যাচ্ছে আহত বাতাস
তবু কোথাও যাইনি আমিÑ
বহুকাল দীর্ঘ নিঃশ্বাসের ভেতর তাকিয়ে রয়েছি
এভাবে তোমার সীমানায়
জটিল ধোঁয়ার ভেতর যেন এক সরল গিনিপিগ!
সবশেষে বীরেনের গ্রন্থনাম কবিতা ‘গুচ্ছঘাসের অন্ধকার’ পাঠ করলেই স্পষ্ট হয় তাকে কেন শক্তিশালী কবি বলছি।
ফসিলের গন্ধমাখা বিকেলগুলোও সরে যাচ্ছে দূরে, আর হাতে উঠে আসছে অপাঠযোগ্য সিদ্ধান্ত। জিজ্ঞাসারাশির ব্যাকুলতা নিয়ে করতলে যা কিছু প্রতিফলিত হয় প্রতিদিন, তার টিকাভাষ্যে লুকিয়ে থাকে অন্তর্মুখী আয়না। জন্মান্তরের দৃশ্য সব আয়না ধরে না জানি, তবু গুচ্ছঘাসের অন্ধকার লুকিয়ে রাখে ঢেউ ভাঙা অহঙ্কারের শিলালিপি।
বলার কোন শেষ নেই। বেশি বলা সাজেও না। কবি আর পাঠকের মধ্যে আড়াল হওয়ার বিড়ম্বনা শুরুর আগেই থামতে চাই। পাঠককে বলি কবিতা পাঠ করুন, কবিতার বই মানুষকে উপহার দিন। ‘গুচ্ছঘাসের অন্ধকার’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে ‘দৃষ্টি’ আর মূল্য রাখা হয়েছে ২০০ টাকা। গ্রন্থটির বহুল প্রচার প্রত্যাশা করছি।