ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

যাযাবর জীবনে ভাসমান আলো

প্রকাশিত: ০৫:১১, ২০ জানুয়ারি ২০১৮

যাযাবর জীবনে ভাসমান আলো

যেখানে সূর্যের আলো, সেখানেই বিদ্যুত। প্রযুক্তির এমন সুযোগের ছোঁয়া লেগেছে ভাসমান বেদে বহরেও। তারা যেখানে যাচ্ছে, সেখানেই পাচ্ছে বিদ্যুতের আলো। এর সুবাদে জীবন-জীবিকাতেও লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। নৌকার আঁধার দূর করা ছাড়াও টেলিভিশনে পাচ্ছে দেশ-বিদেশের খবর। পাচ্ছে বিনোদন। ব্যবহার করতে পারছে মোবাইল ফোন। সন্তানদের দিতে পারছে শিক্ষার আলো। পটুয়াখালীর উপকূলীয় এলাকার নদ-নদীতে ঘুরে বেড়ানো বেশ কয়েকটি ভাসমান বেদে বহরে এ চিত্রের দেখা মিলেছে। যাযাবর প্রকৃতির বেদেরা বরাবরই ভাসমান জীবনে অভ্যস্ত। আজ এখানে-কাল সেখানে। নৌকার বহর বেঁধে সরদারের নির্দেশে পথচলা। অনেকটাই একঘেয়ে দারিদ্র্যে ভরা জীবন। কিন্তু সূর্যের আলোকে বিদ্যুতে রূপান্তর অর্থাৎ সৌর বিদ্যুত প্রান্তিক এ বেদে সমাজের একঘেয়ে জীবন অনেকটা পাল্টে দিয়েছে। অন্যান্য বছরের ন্যায় এবারেও বর্ষার শেষে প্রকৃতিতে শীতের ছোঁয়া লাগতেই দেশের নানা প্রান্ত থেকে বেদেরা বহর বেঁধে দক্ষিণাঞ্চলের জেলা পটুয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় নোঙর করেছে। নৌকার পাশাপাশি বহরগুলোর কয়েকটি আবার তীরে খুঁটি গেড়েছে। পলিথিনের ছাউনি দেয়া ঘরে কাটছে অস্থায়ী সময়। এমন কয়েকটি বেদে বহরের দেখা মিলেছে পটুয়াখালীর বুড়াগৌরাঙ্গ, রামনাবাদ, দাড়ছিরা, আগুনামুখা, পায়রা ও তেঁতুলিয়াসহ আশপাশের কয়েকটি নদ-নদীতে। আর প্রতিটি বহরের অধিকাংশ অস্থায়ী ঘরের ছাউনির ওপরে কিংবা নৌকার ছৈয়ে দেখা গেছে সোলার প্যানেল। যা জানান দেয়-বেদেরাও সৌর বিদ্যুতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। বুড়াগৌরাঙ্গ নদের পশ্চিম তীরে বদনাতলী ঘাটের দক্ষিণ পাশে দু’জন সরদারের নেতৃত্বে ১৮টি পরিবারের দুটি বহর অস্থায়ী বাসা বেঁধেছে। সৌর বিদ্যুত ব্যবহার প্রসঙ্গে বহরের সদস্য তরিফা বেগম জানান, সৌর বিদ্যুত তাদের জীবনের অনেক কিছু পাল্টে দিয়েছে। রাতের আঁধার দূর করে দিয়েছে। ছেলেমেয়েরা আগে পড়াশোনা করত না। এখন অন্তত বইয়ের পাতা খুলছেন। সাদাকালোর ছোট টিভিতে তারা নাচগান-খবর দেখছেন। নিজেরা অনেক কিছু জানতে-শিখতে পারছেন। সৌর বিদ্যুতের কারণে মোবাইল ফোন ব্যবহারেও সুবিধা হয়েছে। ঘরে বসেই চার্জ দেয়া যাচ্ছে। আরেক নারী শাহানারা জানান, জন্ম থেকেই নৌকায় বড় হয়েছেন। নৌকায় সারারাত কুপি বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হতো। এতে প্রচুর খরচ হতো। এখন আর কেরোসিন তেলের পিছনে প্রতিদিন টাকা খরচ করতে হচ্ছে না। আবার আলোও বেশি পাচ্ছেন। রাজ নামের এক শিশু জানায়, সৌর বিদ্যুতের আলোর কারণে তারা সমবয়সীরা রাতে একসঙ্গে বসতে পারছে এবং লেখাপড়াও করতে পারছে। বহরের প্রবীণ ব্যক্তি শান্ত সরদার জানান, গত চার-পাঁচ বছরে বহরগুলোতে সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার বেশি বেড়েছে। সবমিলিয়ে ১০-১২ হাজার টাকা খরচ করতে পারলেই এক বাতির সোলার প্যানেল কিনতে পারা যায়। এতে সাদাকালো টিভি দেখার সুবিধা যেমন রয়েছে, তেমনি মোবাইল ফোন চার্জেরও ব্যবস্থা রয়েছে। আর কিছু বেশি টাকা খরচ করা গেলে রঙিন টিভিও চালানো যায়। তিনি আরও জানান, এরই মধ্যে তার বহরের অধিকাংশ পরিবার সোলার প্যানেল কিনে নিয়েছে। ইদানীং বাকি বা কিস্তিতে কেনার সুবিধা থাকায় অনেকেই এর প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। বহরের আরেক সরদার দেলোয়ার হোসেন জানান, সৌর বিদ্যুত তাদের জীবনেও অনেক পরিবর্তন এনেছে। দেশ-বিদেশের খবরের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের পেশার খবর জানতে পারছেন। এর মাধ্যমে অনেকে বাপদাদার পুরনো এ পেশা ছেড়ে দিয়ে নতুন লাভজনক পেশায় চলে গেছেন। কেউ কেউ এতে বিস্ময়কর সাফল্য পেয়েছেন, এটি সবচেয়ে বড় অর্জন। আর এটি সম্ভব হয়েছে কেবল সৌর বিদ্যুতের সুবাদে। তিনি আরও জানান, সোলার প্যানেলে বহনেও কোন সমস্যা নেই। তারা যেখানে যান, সেখানেই তা সঙ্গে করে নিয়ে যান। একটি তারের সঙ্গে আরেকটি জুড়ে দেয়া তারা শিখে নিয়েছেন। পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার দাঁড়চিরা নদীর তীরে একটি বহরের ২২টি পরিবারের ১৭টিতেই দেখা গেল সৌর বিদ্যুত ব্যবহার করছে। একইভাবে দশমিনা উপজেলার তেঁতুলিয়া নদীর ধলারচরে অন্তত ৮টি পরিবার, রামনবাদ নদী তীরের হরিদেবপুরে দুটি বহরের ১৪টি পরিবার এবং একই নদীর আমখোলা ঘাটের কাছে একটি বহরের ১০টি বেদে পরিবার সৌর বিদ্যুত ব্যবহার করছে। গত কয়েকদিনে বিভিন্ন এলাকায় ঘোরার সময়ে এভাবে আরও বেশ কিছু বেদে বহরে সৌর বিদ্যুত ব্যবহারের দৃশ্য দেখা গেছে। যেখানে সূর্যের আলো, সেখানেই বিদ্যুত। প্রযুক্তির এ আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছে সুপ্রাচীন ঐতিহ্যে লালিত বেদে সমাজের মানুষও। চিরায়ত আঁধার কাটিয়ে তারাও হচ্ছেন আলোর যাত্রী। মাগুরা মাগুরায় ঘর সাজানোর পণ্য তৈরিতে ব্যস্ততা বেড়েছে সোলার শিল্পীদের। শোলার পণ্য তৈরি করে জেলার শালিখা উপজেলার শতপাড়া গ্রামের শতাধিক নারী পুরুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। তাদের শোলার তৈরি পণ্য ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় চালান যাচ্ছে। শীত মৌসুমে জেলার বিভিন্ন এলাক্য়া মেলা অনুষ্ঠিত হওয়ায় তাদের এখন বসার সময় নেই। জানা গেছে, জেলার শালিখার শতপাড়া গ্রামে বেশ কয়েকটি মালাকার পরিবার রয়েছে। শোলা দিয়ে নানা ধরনের পণ্য তৈরি করে ৮টি পরিবারের শতাধিক নারী পুরুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। শোলা কেটে এনে রোদে শুকিয়ে তারপর তৈরি করা হয় শোলার ফুল, মালা, হাত পাখা, মুখোশ, ঘর সাজানোর মালা প্রভৃতি। শোলা শিল্পীদের বৈশাখ মাস থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত কাজ বেশি থাকে তা ছাড়া বছরই কাজ থাকে। মেলার সময় তাদের কাজ বেড়ে যায়। শিল্পীদের বেশিরভাগ মহিলা। বিল থেকে শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে কেটে বাড়িতে এনে সারা বছরের কাজের কাঁচা শোলা সংরক্ষণ করে রাখা হয়। এর পর কেটে সে পণ্য তৈরি করা হয়। রং করে সুন্দর করা হয়। পুরুষের পাশাপাশি মহিলারা সমানতালে এই কাজ করেন। তাদের তৈরি মিভিন্ন মেলায় বেশি বিক্রি হয়। শতপাড়া গ্রামের শোলা শিল্পী নিমাই মালাকার জানান, তারা শোলা দিয়ে ঘর সাজানোর ফুল, মালা, হাত পাখা, মুখোশ, পাখি, ফুল প্রভৃতি তৈরি করেন। যা আয় করেন তা দিয়ে তাদের সংসার চলে যায়। একজন শিল্পী দৈনিক ৪ থেকে ৫ শত টাকা আয় করেন। -সঞ্জয় রায় চৌধুরী, মাগুরা, থেকে
×