ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্নের পথে প্রতিবন্ধী তামান্না স্বপ্নের পথে প্রতিবন্ধী তামান্না

প্রকাশিত: ০৪:২১, ১৩ জানুয়ারি ২০১৮

স্বপ্নের পথে প্রতিবন্ধী তামান্না স্বপ্নের পথে প্রতিবন্ধী তামান্না

অদম্য মেধাবী, দৃষ্টিনন্দন, স্পষ্ট লেখনী, পেশাদার চিত্রশিল্পীদের হার মানাবে তার অঙ্কনে। চেহারাও আর ১০ জনের চেয়ে বিধাতা দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন অনেকখানি সুন্দরী করে। এসবের অধিকারী যে, তার নাম তামান্না নূরা। কিন্তু বিধিবাম এই তামান্না নূরা জন্ম প্রতিবন্ধী। তামান্না নূরার জন্ম ২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারা গ্রামে। বাবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রওশন আলী। মা খাদিজা পারভীন শিল্পী। তিন ভাইবোনের মধ্যে তামান্না নূরা বড়। জন্ম প্রতিবন্ধী তামান্না নূরার দুটি হাত ও একটি পা নেই। শুধু বাম পাটি নিয়ে জন্ম নেয় তামান্না। জীবনে কখনও দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারেনি। দুই হাত দিয়ে স্পর্শ করতে পারেনি মমতাময়ী মাকে। তার পরেও তার ইচ্ছা বোঝা নয় লেখাপড়া শিখে স্বাবলম্বী হয়েই বাঁচতে চায়। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় তামান্না। ছোট বোন মমতাহেনা রশ্মী প্রথম শ্রেণীতে পড়ে। ভাই মহিবুল্লার বয়স দুই বছর। তামান্না জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। এর আগে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষাতেও জিপিএ-৫ পেয়েছিল তামান্না। এখন সে দশম শ্রেণীতে পড়ছে। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে সে বেছে নিয়েছে বিজ্ঞান বিভাগ। পা দিয়ে লেখার পাশাপাশি সুন্দর ছবি আকার জন্য প্রশংসিত হচ্ছে এই কিশোরী। তামান্না জানায়, প্রথম প্রথম যখন আমি লিখতাম তখন আমার পায়ের আঙুলের ফাঁকে ব্যথা হতো। আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যায়। এখন এটা আমার কাছে কিছুই মনে হয়না। আরও বলে, আমার স্কুলে যেতে খুবই ভাল লাগে। যে দিন আমি স্কুলে না যাই, সেদিন আমার খুব খারাপ লাগে। তামান্না বলে, পড়াশোনার পাশাপাশি তার ছবি আঁকতে খুবই ভাল লাগে। গাছপালা, পশু-পাখি, মানুষের ছবি আঁকতে ভাল লাগে তার। তামান্না বড় হয়ে মানুষের সেবা করতে চায়। এজন্য বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়াশোনা করছে। তার এই স্বপ্ন পূরণে সমাজের সব শ্রেণী পেশার মানুষের কাছে সহযোগিতা চায় তামান্না। তামান্নার এ পর্যায়ে উঠে আসা কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল তা জানান তার বাবা রওশন আলী। তিনি বলেন, আমি শিক্ষিত হয়েও কোন চাকরি করিনি আমার মেয়ের জন্য। ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে আমার মনে চ্যালেঞ্জ ফুটে উঠল যে ওকে অনেক উপরে নিয়ে যেতে হবে। প্রথম যখন ওর পায়ের আঙুলের ফাকে চক দিই, ও বলছিল, আব্বু একটু যেন ব্যথা করে। এরপর আমি কলমের মতো পাটখড়ি দিতাম পায়ের আঙুলের ফাঁকে। একটা সময় যখন সেটা ওর অভ্যাস হলো, তখন আস্তে আস্তে কলম দিতে শুরু করলাম। কিছুদিন পর সে বর্ণমালা লেখা শিখে ফেলল। কিন্তু স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে যাবার পর সবাই বলল, একে আনছেন কেন, এ কি পারবে নাকি? এরকম কথা আমাকে ভীষণ আহত করেছিল। আমার মনে হয়েছিল, এই মেয়েকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। স্কুলে ভর্তি হবার পর তামান্না প্রথম শ্রেণী থেকে বার্ষিক পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়। অভিশপ্ত প্রতিবন্ধী নয়, পরিবার বা সমাজের বোঝা নয় প্রকৃত মানুষ হতে চায় এই তামান্না নূরা। সে পা দিয়ে শুধু লেখে না, চামচ দিয়ে খেতেও পারে। মুঠোফোন ব্যবহার করতে পারে। যেন একটি পাই দুই হাতের যোগান দেয়। তামান্না নূরার মা খাদিজা খাতুন শিল্পী বলেন, জন্ম থেকেই ওর দুটি হাত ও একটি পা নেই। কিন্তু তামান্না সব কাজ নিজে করতে পারে। পা দিয়ে খাওয়া-দাওয়া, সাজগোজ করা, চুল আঁচড়ানো, বইয়ের পাতা উল্টানো, ছবি আঁকা, খাতায় দাগ কাটা, লেখার কাজ সবই করতে পারে। পা দিয়ে করাটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। -সাজেদ রহমান, যশোর থেকে
×