ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী

ঐতিহ্যের পথ বেয়ে রাজশাহী নগরে ‘টমটম ভাস্কর্য’

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ৬ জানুয়ারি ২০১৮

ঐতিহ্যের পথ বেয়ে রাজশাহী নগরে ‘টমটম ভাস্কর্য’

ইতিহাসের পথ ধরে পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে এবার রাজশাহী নগরীতে স্থান পেয়েছে ঘোড়ার গাড়ি ভাস্কর্য। নগর সৌন্দর্য বর্ধনের অংশ হিসেবে সম্প্রতি রাজশাহী নগরীর গ্রেটার রোডের বহরমপুর মোড়ে এই ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। এই চত্বরটির নাম দেয়া হয়েছে ‘ঐতিহ্য চত্বর’। আম ও সিল্ক সমৃদ্ধ রাজশাহী নগরীর আদি ঐতিহ্য ঘোড়ার গাড়ির ভাস্কর্য স্থাপনে বেড়েছে নগরীর সৌন্দর্য। জানা যায়, রাজশাহীর মানুষের যাতায়াতের জন্য এককালে প্রধান মাধ্যম ছিল ঘোড়ায় টানা ‘টমটম’ গাড়ি। তাই ‘টমটমের শহর’ নামেই পরিচিতি পেয়েছিল পদ্মাপাড়ের রাজশাহী। কালের আবর্তে রাজশাহীর সেই টমটম এখন নির্বাক ইতিহাস ও ঐতিহ্য। সেই ঐতিহ্যের স্মারক যেন রাজশাহী শহরের পরিচিতি ধরে রাখে সেজন্য শহরে বসানে হলো ‘টমটম ভাস্কর্য’। নগর সৌন্দর্য বর্ধনের অংশ হিসেবে এই ভাস্কর্য স্থাপন করেছে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন (রাসিক)। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের (রাসিক) প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক জানিয়েছেন, ঢালায় ও ফাইবার সিট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই টমটম ভাস্কর্যটি। শিল্পী ফয়সাল মাহমুদ ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেছেন। ভাস্কর্যটি নির্মাণে খরচ হয়েছে ১৭ লাখ টাকা। যা নির্মাণে দুই বছর সময় লেগেছে। ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, একটা সময় ছিল যখন শহরের জমিদার ও অভিজাত শ্রেণীর মানুষজন ঘোড়ার গাড়িকে প্রধান বাহন হিসেবে ব্যবহার করতেন। ঐতিহ্যবাহী রাজশাহীর ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঘোড়ার গাড়ি। ঐতিহ্য লালন করে এখনও কিছু ঘোড়ার গাড়ি রয়েছে রাজশাহীতে তবে তা আর মানুষ কিংবা মালামাল বহনের জন্য ব্যবহার হয় না। কিছু সৌখিনতার কাজে ব্যবহার হয় মাত্র। বিশেষ করে কোন অনুষ্ঠান সম্পর্কিত র‌্যালি কিংবা শোভাযাত্রায় ব্যবহার হয়ে আসছে। এজন্য কচুয়ানদের অপেক্ষায় থাকতে হয়। নগরীর প্রবীণরা জানান, রাজশাহীর প্রাণকেন্দ্র সাহেববাজার জিরো পয়েন্ট। এই স্থানটিকে ঘিরে এক সময় বসত কোচোয়ানদের (ঘোড়ার গাড়ি চালক) মিলনমেলা। জিরো পয়েন্টের আশপাশে সারি সারি করে সাজানো থাকত সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়ি। তখন দূরবর্তী বাহন হিসেবে ঘোড়ার গাড়িই ছিল একমাত্র মাধ্যম। কিন্তু কালের বিবর্তনে এবং উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বিলীন হয়ে গেছে সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ এই বাহনটি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেও রাজশাহীতে প্রায় ৭শ’ ঘোড়ার গাড়ির ছিল। নগরবাসীর দুরের যাত্রার একমাত্র বাহন ছিল ঐহিত্যবাহী ঘোড়ার গাড়ি। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহীর হরিপুর, কাটাখালি, বানেশ্বর ও নওহাটাসহ বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাজশাহীর প্রাণকেন্দ্র সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে গাড়ি নিয়ে জড়ো হতেন কোচোয়ানরা। যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি পণ্য পরিববহনেও এই গাড়ির জুড়ি ছিল না। পুরনো এসব কোচোয়ানদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তখনকার আমলে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে বেশি ঘোড়া আনা হতো। তখন একটি ঘোড়ার দাম ছিল ২শ’ থেকে ৩শ’ টাকা। এখন এই ঘোড়ার দাম ২০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজশাহীতে পাক হানাদার বাহিনীর তা-বে মানুষসহ নিরীহ পশুপাখিও রেহাই পায়নি। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রেও অনেক কোচোয়ান ঘোড়াসহ নিহত হন। অনেকে প্রাণ ভয়ে রাজশাহী থেকে পালিয়ে যান। আবার অনেকে যুদ্ধের পরে নিজ পেশা বদলান। একটা সময় রাজশাহীর জিরো পয়েন্টের সেই ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া স্ট্যান্ডটিও বিলীন হয়ে যায়। প্রায় থেমে যেতে বসে ঘোড়ার বাহন। এই ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজশাহীর সাহেব বাজার এবং রাজশাাহী কলেজ সংলগ্ন মাস্টারপাড়া এলাকায় ছিল বেশকিছু কোচোয়ানদের ঠিকানা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঘোড়া চালকরা সংখ্যায় কমে যায়। যান্ত্রিক বাহনের সম্প্রসারণে হারিয়ে যায় এসব ঘোড়ার গাড়ির কদর। বাধ্য হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়ে যেতে বসায় পেশা বদলাতে শুরু করেন তারা। বতর্মানে রাজশাহীতে ঘোড়াগাড়ি আছে। ব্যবহারও নামে মাত্র। অতীতে সংখ্যায় ৭শ’ ঘোড়ার গাড়ি থাকলেও এখন মাত্র ৫ টিতে দাঁড়িয়েছে। রাজশাহীতে বর্তমানে যে পাঁচজন ঘোড়াগাড়ি চালক আছেন তারা হলেনÑ নগরীর কাঁঠালবাড়িয়া এলাকার আব্দুল খালেক (৭০), নওহাটা এলাকার নুর আলী (৫৫), নুরুল ইসলাম (৬০), পবা উপজেলার আন্ধারকোঠার আবু সাত্তার (৬০) ও একই উপজেলার হরিপুর এলাকার সেন্টু (৫৮)। তারা এখন মূলত রাজশাহী শহরের এই ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ির প্রচলনটি ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। নগরীর পিএন সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশ ঘেঁষে নিজ ঘোড়ার গাড়িতে এখনও ভাড়ার অপেক্ষায় বসে থাকেন আব্দুল খালেক। তিনি বলেন, ‘আইয়ুব খানের আমল থেকেই ঘোড়া গাড়ি চালান তিনি। নানা আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে এই গাড়িতে করে। কিন্তু এখন আর আমাদের সেই অবস্থা নেই। এখন ঘোড়ার খাওয়ার টাকা যোগাড় হয় না। অনেক সময় নিজেরা না খেয়ে ঘোড়াকে খাওয়ায়। কোচোয়ান আব্দুল খালেক বলেন, রাজশাহীতে এখন অনেক ধরনের যানবাহন। তাই এখন আমাদের আর কদর নাই। আগে ঘোড়ার গাড়ি যাত্রীবাহী ছিল, এখন মালবাহী গাড়ি হয়ে গেছে, তাও ভাড়া মেলে না। ভাড়া পেলে ২শ’ থেকে ৩শ’ টাকা পাওয়া যায়। আর ভাড়া না পেলে বসে থাকতে হয়। অনেক সময় রিজার্ভ পাই, তখন একটু আয় হয়। রাজশাহী নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা আবদুর রহিম বলেন, ঘোড়াগাড়ির সেই টুকটাক টুকটাক আওয়াজ আর কানে আসে না। বাজারের দিকে গেলেই সারারাস্তা এমন ভাবেই আওয়াজ করে লাইন ধরে যেত গাড়িগুলো। সে সময় অনেক ভাল লাগত গাড়িরগুলোর সাজসজ্জা দেখতে। তখনকার ঘোড়াগুলোও ছিল দেখার মতো। এখন শুধুই স্মৃতি। রাজশাহী শহরে এখন অনেকটায় শূন্য ঘোড়ার গাড়ি। সেখানে সম্প্রসারিত হয়েছে যান্ত্রিক গাড়ি। এসব যান্ত্রিকতায় একদিকে শব্দ দূষণ ও অন্যদিকে ধোঁয়ায় বিরক্ত হচ্ছে নগরবাসীর। তবুও জীবন থেমে থাকার নয়। ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ির বিলুপ্তিতে নগরীতে এসেছে বাহারি ধরনের গাড়ি। গাড়িগুলো সময় বাঁচালেও মানুষকে তেমন প্রশান্তি দিতে পারে না। সময়ের প্রয়োজনে মানুষকে দিন দিন বেশি যান্ত্রিক আর যান্ত্রিকতা নির্ভর করে তুলছে। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেন, ঘোড়ার গাড়ি রাজশাহীর ঐতিহ্য। এ ঐতিহ্য ধরে রাখতেই স্থাপন করা হয়েছে ‘ঐতিহ্য চত্বর’। এখানে স্থান পেয়েছে ঘোড়ার গাড়ির ভাস্কর্য। নগর সৌন্দর্যের অংশও এটি বলে জানান তিনি।
×