ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আলী যাকের

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ৫ জানুয়ারি ২০১৮

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

(পূর্ব প্রকাশের পর) অর্থাৎ এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর সাথে একটি যোগাযোগ স্থাপন করি। অন্ধ অনুকরণ এই যোগাযোগকে ব্যাহত করে। আমি আবিষ্কার করি যে যেইসব জনগোষ্ঠীর সাথে একটি পণ্য কি সেবার স্বার্থে আমার যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে তাদেরকে সম্পূর্ণভাবে জানা আমার কর্তব্য। অতএব এ বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নেয়া দরকার। সেই থেকেই মার্কেট রিসার্চ কিংবা বাজারজাতকরণ সমীক্ষা সম্বন্ধে আমি জ্ঞানার্জন করার চেষ্টা শুরু করি। আমি আমার পেশার প্রতি আরও গভীর পেশাগত চিন্তা-ভাবনায় উদ্যোগী হই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমি যখন বিজ্ঞাপন পেশায় ফিরে এলাম তখন প্রথমেই আমি ভাবলাম যে যাদের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞাপন করব তাদের আমার জানা দরকার। তখন আমার একজন অগ্রজ প্রতিম বন্ধু ছিলেন শ্রী চিত্ত মিত্র, যিনি কলকাতায় মার্কেট রিসার্চ এর কাজ করতেন। তাকে অনুরোধ করলাম এই ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে। তিনি সাগ্রহে তাতে সম্মতি দিলেন। অতএব সেই ’৭২-এ এই আমরা বাংলাদেশে নানা শ্রেণীর ভোক্তাকে জানার জন্য একটি বিশেষ সমীক্ষা চালায়। ইংরেজীতে এর নামকরণ করেছিলাম গধৎশবঃ গধঢ়ঢ়রহম ঝঃঁফু। এই কথাগুলো বললাম এই কারণে যে, আমার পেশার সেই শুরু থেকে আজ পর্যন্ত আমি পেশাদারী মনোভাব নিয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি। ’৭২-এর ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মামুন, মামুনুর রশিদ, আমাকে বলল যে ভাষা দিবস উপলক্ষে ও মঞ্চে একটি নাটক নামাবে এবং সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে, এই নতুন দলের প্রথম নাটক হবে মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’। তখনও দলের নাম ঠিক হয়নি। আমরা মহড়া শুরু করে দিলাম। আমার তখন বিশাল বপু। আর দরাজ গলা। অভিনয় সম্বন্ধেও মোটামুটি জ্ঞান ছিল। অতএব, ঠিক হলো নেতার ভূমিকায় আমিই অভিনয় করব। দারোগার ভূমিকায় সুভাষ দা, অর্থাৎ স্বনাম ধন্য অভিনেতা এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা সুভাষ দত্ত অভিনয় করবেন। শত ব্যস্ততার মাঝেও সুভাষ দা এই নাটকে যে নিরবচ্ছিন্ন সময় এবং পরিশ্রম দিয়েছেন সে জন্য আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ ছিলাম। মুর্দা ফকিরের ভূমিকায় মামুনুর রশিদ স্বয়ং এবং প্রধান যুবকের ভূমিকায় মুজির-বিন-হক নির্বাচিত হলো। যদ্দুর মনে পড়ে দশ, বারো দিন টানা এবং পরিশ্রমী মহড়ার পর নাটকটি দাঁড়িয়ে গেল। কিন্তু দলের নাম তখনও ঠিক হয়নি। একদিন আমি আর মামুন গেছি বিটিভির ডিআইটি অফিসে। কথায়, কথায় নাটকের আরেক দিকপাল আব্দুল্লাহ-আল-মামুন জিজ্ঞেস করলেন দলের নাম কি? আমাদের কোন জবাব নেই। দলের নাম তখনও দেয়া হয়নি। মামুন বললেন ‘নাগরিক’ নামে তো একটি দল রয়েছে। তোমাদের দলের নাম দাও ‘আরণ্যক’। আরণ্যকে কবর নাটক অভিনয়ের মধ্য দিয়েই শুরু হয়ে গেল আমার নাট্যযাত্রা। আরণ্যকের হয়ে আমি একটি নাটকেই অভিনয় করেছিলাম। ‘কবর’ নাটকের সফল মঞ্চায়নের পর দীর্ঘদিন আরণ্যক আর কোন নাটক মঞ্চে আনেনি। ‘কবর’ নাটকে অভিনয়ের পর নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের জিয়া হায়দার এবং আতাউর রহমান আমাকে আহ্বান জানালেন নাগরিকে নাটক করতে। অভিনয়ে আমি তখন প্রচন্ড আগ্রহী। অতএব কালক্ষেপণ না করে সম্মত হয়ে গেলাম। আমি যখন নাগরিকে এলাম তখন তাদের মঞ্চে অভিনয়োপযোগী কোন নাটক ছিল না। আমাকে বলা হলো একটি নাটক বেছে নিয়ে আমারই নির্দেশনায় মঞ্চস্থ করতে। বন্ধুবর গোলাম রব্বানী তখন নাগরিকে ছিল। সে বাদল সরকারের ‘বাকি ইতিহাস’ নাটকটি পড়েছিল। তারই পরামর্শে আমি নাটকটি ভালভাবে পড়ে দেখলাম এবং সেটির মঞ্চায়নের দায়িত্ব সানন্দে গ্রহণ করলাম। সেই থেকে সুখে দুঃখে, হাসি কান্নায় নাটকের সঙ্গেই লগ্ন হয়ে আছি। প্রসঙ্গত বাকি ইতিহাসের মঞ্চায়নকে কেন্দ্র করে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন বোধ করছি। আমার প্রথম নাট্য নির্দেশনার শুরুতেই আমি দলের সবাইকে কিছু কথা বলেছিলাম যেগুলো স্মরণ করা প্রাসঙ্গিক হবে বলেই আমি মনে করি। আমি বিশ্বাস করতাম যে শৃঙ্খলা বোধ ছাড়া কোন বড় মাপের কাজ করা কখনওই সম্ভব নয়। এই বিশ্বাস আমার সকল সাফল্য এবং খ্যাতির পেছনে কাজ করেছে। এই মহড়া শুরু করবার পর শৃঙ্খলার প্রশ্নে দলের মধ্যে কিছু অসন্তোষ দেখা দেয় এবং দু’একজন সদস্য দল ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। কিন্তু দলের বৃহত্তর স্বার্থে আমি সবসময় অনড় ছিলাম। ফলে অনেক সময় দলেরই স্বার্থে এমন অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে যা কতিপয় সদস্যের পছন্দ হয়নি। তারা হয় দলত্যাগ করেছে অথবা নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমার এতে কোন কিছু করার উপায় ছিল না। আমি নাগরিকে যখন কাজ শুরু করি তখনই আমার কাজের ধারা এবং উদ্দেশ্য সম্বন্ধে দলের সদস্যদের কিছু কথা বলেছিলাম। আমি বলেছিলাম যে আমাদের প্রথম কাজ হবে নাটককে সৌখিন মাধ্যম থেকে অর্গলমুক্ত করে পেশাদার চর্চা হিসেবে গড়ে তোলা। নাটককে ক্লাবে অভিনীত শখের থিয়েটার হিসেবে দেখলে চলবে না। সারাদিনের কাজকর্ম শেষে মহড়াকক্ষে এলাম। সেখানে কিছুক্ষণ গাল, গল্প হলো। তারপর নারী সাহচর্যের আকর্ষণ তো আছেই। এইভাবে তাইরে নাইরে করে সন্ধ্যা অতিবাহিত করে যার যার বাড়িতে রওনা হলাম। এভাবেও নাটক করা যায় যাতে নাটকের সংশ্লিষ্ট সবার মন রাখা সম্ভব কিন্তু সৃজনশীল নাটকের কোন স্বার্থরক্ষা হয় না। সুতরাং একেবারে পেশাদারী মনোভাব নিয়ে নাটক করতে হবে। নাহলে সময় অপচয় হবে কেবল। নাটক হবে না। প্রথম দিকে সবার মনযোগ পেতে অসুবিধা হলে আমাদের দল নাগরিকের সবাই অনুধাবন করেছিলেন যে শখের থিয়েটার থেকে পেশাদারী থিয়েটারে উন্নতি হতে হলে আর কোন গতি নেই। এই সময় নাটক নিয়ে আমাদের পড়াশোনাও শুরু হয়ে গেছে। কিয়ার্কেগার্ড এবং জাঁ পল সার্ত্রের দর্শন অস্তিত্ববাদ বা এক্সিসটেনশিয়ালিজম সম্বন্ধেও জেনে গেছি। ‘বাকি ইতিহাস’ নাটকে এও বেরিয়ে এসেছে যে, নাট্যকার এই নাটকে অস্তিত্ববাদ দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছেন। সে এক সময় গেছে !! কিছু কথা কোন ভাবনা চিন্তা না করে কেমন অবলীলায় বলে ফেলতাম। তারপর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধি একটু বেড়েছে। এখন বেশি কথা বলার প্রবণতা কমেছে এবং একটু ভেবে চিন্তে কথা বলার প্রবণতা বেড়েছে। ‘বাকি ইতিহাস’ প্রথম দফায় মঞ্চায়নের জন্য যখন তৈরি হলো, তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে নিয়মিত মঞ্চায়ন করতে হলে একটানা হল বুকিং দিতে হবে। তাই ব্রিটিশ কাউন্সিল মঞ্চ পর পর আট রবিবারের সকালের জন্য বুক করে ফেললাম। এ নিয়ে বিস্তর তর্কাতর্কি হয়েছিল। অনেকেই মনে করেছিল যে পর পর আটটি প্রদর্শনী এক নাগাড়ে টানা দুঃসাধ্য হবে। আট রবিবারের ভাড়া দেয়ার টাকা গ্রুপের কাছে ছিল না। মনে পড়ে প্রথম দফায় টাকাটা আমিই দিয়েছিলাম। তখন আমার চাকরিটা ছিল অপেক্ষাকৃত কম বেতনের তাই বেশ কষ্ট হয়েছিল টাকাটা দিতে। প্রথম রবিবারের আগের শনিবার সন্ধ্যায় ছিল স্টেজ রিহার্সাল। দুবার মহড়া শেষ করতে রাত বারোটা বেজে গিয়েছিল। তখন আমার একটা ভোক্সওয়াগান বিটল গাড়ি ছিল। কোম্পানির কাছ থেকে টাকা ধার করে কিনেছিলাম। এই গাড়িটির একটি যুৎসই নাম হতে পারে ‘ইচ্ছে গাড়ি’। যখন ইচ্ছে হতো তখন অবলীলায় নিরুপোদ্রব গড়গড়িয়ে চলত। আবার যখন ইচ্ছে হতো না দিব্যি বেঁকে বসত। নট নড়ন চড়ন! নট কিচ্ছ্।ু তো ওই রাতে গাড়িতে ছিলাম আমি এবং সহকর্মী নায়লা জামান, সারা আমিন আর আসাদুজ্জামান নূর। রোকেয়া হলের সামনে এসে আমার ‘ইচ্ছে গাড়ি’ থেমে গেলেন। অনেক কাকুতি মিনতি করে, অনেক ধাক্কাধাক্কি করেও কোন লাভ হলো না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ওকে ঠেলে ঠেলেই রাজারবাগে বাড়ি অবধি নিয়ে যাব। আমি স্টিয়ারিং ধরে ধরে আর বাকি সবাই গাড়ির পেছনে ধাক্কা দিতে লাগল। এস্কাটন গার্ডেন আসতেই সারা বাসায় ঢুকে পড়ল। বাংলামোটর আসতে নায়লাও ওর বাসায়। অতএব বাকি রইলাম আমি আর নূর। দেড় ঘণ্টা পরে গলদঘর্ম হয়ে পৌঁছলাম। এই আপাত তুচ্ছ ঘটনাটি সবিস্তারে বর্ণনা করলাম দুটি কারণে। প্রথমত, ওই গভীর রাতে দুই সুন্দরী রমণী ঢাকার রাস্তায় গাড়ি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে এ ছিল বিরল এক দৃশ্য। আর দ্বিতীয়ত ওই নির্জন রাস্তায় এমন সূবর্ণ সুযোগ কোন দুর্বৃত্ত যে গ্রহণ করেনি সেটাও একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার বৈকি। (চলবে)
×