ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

হারিয়ে যাচ্ছে মৌটুসী পাখি

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭

হারিয়ে যাচ্ছে মৌটুসী পাখি

বর্ণালী পাখির স্বর্গভূমি সোনালী সবুজ এই বাংলাদেশের অতি চেনা হামিং বার্ড গোত্রের ক্ষুদে মৌটুসী পাখিরা হারিয়ে যাচ্ছে। মৌটুসীরা এদেশের অতি ক্ষুদ্র প্রজাতির পাখি। অতিচেনা টুনটুনি পাখিদের চেয়েও এরা আকারে অনেক ছোট এবং ওজনেও কম। তবে এরা অতি সুন্দর পাখি। তেল চিকচিকে বর্ণালী উজ্জ্বল পালক এবং লম্বা বাঁকানো ঠোঁটের কারণে মৌটুসীরা সহজেই নজর কাড়ে। মৌটুসীদের খাদ্য হচ্ছে ফুলের মধু, পরাগ, পাপড়ী আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পোকা মাকড়। সে জন্য ঠোঁটের আকৃতি লম্বা আর সুঁচালো। লম্বা ঠোঁট ফুলের পাপড়ীর ফাঁকে ঢুকিয়ে দিয়ে এরা ফুলের গোড়ায় সঞ্চিত মধু চুষে খায়। মৌটুসীদের বাসার নির্মাণ কৌশল সুন্দর ও আকর্ষণীয়। এরা গাছের ডাল, কা- আর পাতার চিকন শক্ত আঁশ, মাকড়সার জাল, তুলো, নরম পালক দিয়ে বুনে বুনে ছোট্ট অথবা লম্বাটে বাসা বানায়। যা ছোট ঝোঁপঝাড় আর পাতার আড়ালে লুকানো অবস্থায় গাছের ডালে ঝুলে থাকে। বাসার মুখটা থাকে উপরের দিকে। অতি ক্ষুদ্র নীলচে এবং খয়েরী ফুটকি যুক্ত প্রজাতি ভেদে বর্ণালী ডিম দেয় বাসায় দুটো থেকে তিনটে। এদের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য ১০ থেকে ১২ সেন্টিমিটারের বেশি হয় না। এর মধ্যে লেজ প্রায় ৩ সেন্টিমিটার এবং ঠোঁট ১.৭ সেন্টিমিটার থেকে ২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। অনেক এলাকায় মৌটুসীদের নীল টুনি নামেও এদের কোন কোন প্রজাতিকে ডাকা হয়। নানা প্রজাতির মৌটুসী পাখি ইতোপূর্বে গ্রামেগঞ্জে সর্বত্র চোখে পড়লেও এদের সংখ্যা পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতায় বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। এদের মধ্যে এখনও যে সব প্রজাতির মৌটুসী পাখি আমাদের দেশে দেখতে পাওয়া যায় তাদের মধ্যে মৌটুসী Purple Rumped Sunbird), নীলটুনি Purple Sunbird), সিঁদুরে লাল মৌটুসী Crimson Sunbird), সবুজ মৌটুসী Ruby Cheeked Sunbird), মাকড়সাভুক মৌটুসী Little Spider Hunter) উল্লেখযোগ্য। নীলটুনি : মৌটুসী প্রজাতির পাখিদের মধ্যে নীলটুনিরাই সব চাইতে সুদর্শন। এদের পুরুষটির গায়ের রং উজ্জ্বল এবং চকচকে নীল। ঘাড়ের কাছে কিছু পালক উজ্জ্বল সবুজ আর মেয়ে পাখিটির পালক উজ্জ্বল বাদামী আর হালকা সবুজের মিশেল। এদের মধু চুষকি নামেও ডাকা হয়। এরা মূলত ফুলের মধু খেতেই বেশি ভালবাসে। এদের ঠোঁট লম্বা এবং অগ্রভাব কিছুটা বাঁকানো। ঠোঁটের রংও কুচকুচে কালো। সিঁদুর লাল মৌটুসী : এরা স্থানীয় প্রজাতির পাখি। সর্বত্র দেখা গেলেও সংখ্যায় অনেক কম। এদের গলা, বুক এবং পিঠের কিছু অংশের পালকের রং লাল টকটকে। মাথার অগ্রভাগ এর পালক নীল। এদের বুকের বাকি অংশের পালক ধূসর এবং লম্বা লেজ ও পিটের উপরের অংশের পালক হালকা সবুজ। এদের প্রায় ৭ থেকে ৮ সেন্টিমিটার লম্বা লেজ আলাদা বৈশিষ্ট্য এনে দিয়েছে। এরা মধুর প্রতি আকৃষ্ট হয় বেশি। সবুজ মৌটুসী : এই প্রজাতির মৌটুসী স্থানীয় প্রজাতির পাখি। মাথার উপরিভাগ থেকে গলার দু’পাশে এবং পিঠের কিছু অংশের পালক এর রং উজ্জ্বল সবুজ। ঠোঁট থেকে বুকের কিছু অংশের পালক হলদে এবং অন্য অংশের রং লালচে ও কমলা রঙের এবং হালকা সবুজ রঙের মিশেল। পিঠের পালক হালকা সবুজ ও বাদামী। তবে চোখের দু’পাশে কিছু অংশের পালক খয়েরী। এদের ঠোঁট অন্য প্রজাতির পাখিদের মতো লম্বা নয় ছোট তবে চিকন। এর সাধারণত পোকা মাকড় খেতেই বেশি ভালবাসে। তবে ফুলের মধুও খায়। মাকড়সাভূমি মৌটুসী : মৌটুসী প্রজাতির মধ্যে এরা অপেক্ষাকৃত বড় এবং এদের ঠোঁট লম্বা অগ্রভাগ সরু। এদের গায়ের উপরিভাগের পালক সবুজ আর বুকের সন্মুখভাগ ধূসর আর লেজের দিকের পালক হলদেটে। ছোট মাকড়সা এবং পোকা মাকড়ের প্রতি এদের আসক্তি বেশি থাকলেও এরা মধুও খায়। গ্রাম বাংলায় এই প্রজাতির মৌটুসী পাখির সংখ্যা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। মৌটুসী : এই প্রজাতির পাখির দেখা মেলে সর্বত্রই। এদের বুকের পালক হলুদ ও সাদা, মাথার পালক উজ্জ্বল নীল ও কালোয় মিশেল। আর ঘাড়ের নিচের পালকের কিছু অংশের রং লাল আর বাকি অংশ বেগুনী। সুন্দর বাহারী পাখি। এদের ঠোঁট অপেক্ষাকৃত মোটা তবে লম্বা। এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে মধু, ফুলের পাপড়ী এবং ক্ষুদে পোকা মাকড়। এদের তাল ও খেজুরের রস খেতেও দেখা গেছে। পরাগায়নে সহায়ক কৃষকবান্ধব এই পাখিগুলো গাছে বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় ফুলের মধু খেতে গিয়ে বিষক্রিয়ায় মারা পড়ছে বেশি। অথচ এরা ফুলে ফুলে মধু খেতে গিয়ে শুধু পরাগায়নেই সহায়তা করে না। বরং ফুলের ক্ষতিকর পোকা মাকড় খেয়ে ফলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে। -আবু জাফর সাবু, গাইবান্ধা থেকে
×