ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

এক ‘রাজপুত্তুরের’ বিদায়

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ৭ ডিসেম্বর ২০১৭

এক ‘রাজপুত্তুরের’ বিদায়

ভারতীয় জাদুঘরের পাশের গলি দিয়ে খানিক হাঁটলেই সময়ের বোধ লোপ পায়। এই গলিতেই না একদিন জেগে উঠেছিল ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর!’ কবিগুরুর ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ রচিত হয়েছিল এই পথেরই একটি বাড়িতে। এই রাস্তার নাম সদর স্ট্রিট। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এক অসামান্য চতুর্দশপদীও রয়েছে ‘সদর স্ট্রিট’ নামে। মাইকেল মধুসূদনের প্রতি নিবেদিত সেই কবিতা। কিন্তু এই সব নামের পাশে একটি নাম এই রাস্তা ধরে রাখেÑ শশী কাপুর। বম্বে বায়োস্কোপের মুকুটহীন সম্রাট পৃথ্বীরাজ কাপুরের তৃতীয় পুত্র তখন অনেকটাই থিয়েটারলোকের বাসিন্দা। বয়স আর কত! মাত্র ১৮। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের উঁকি। ‘শশীরাজ’ নামের আড়ালে নিজেকে রাখতেন চেহারা-চরিত্রের এই ‘রাজপুত্তুর’। ১৯৫৬-এ শশী কলকাতায় আসেন। বাবার থিয়েটার গ্রুপ ‘পৃথ্বী থিয়েটার’ এ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেজ ম্যানেজারের দায়িত্ব তখন তার কাঁধে। এর থেকে শুরু তার পথচলা। এক সময়ের বলিউড হার্টথ্রব শশী কাপুর গত সোমবার পরলোক গমন করেন। বাবা পৃথ্বীরাজ কাপুর ছিলেন নির্বাক যুগের ভারতীয় ছবির অন্যতম প্রধান অভিনেতা। মনে হয়, খানিকটা অসময়ে চলে গেলেন তিনি। একুশ শতকের বলিউড এত কোলাহলময় যে আলাদা করে চন্দ্রাস্ত খেয়াল করার সময়টা আর নেই। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও হিন্দী সিনেমা বলিউড ছিল না। তখনও মুম্বই ম্যাক্সিমাম সিটি হয়নি। তখনও ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস বা ইন্ডিয়া গেট দেখে লোকে বুঝত ওই শহরের ইংরেজিয়ানা। শশী কাপুর সেই সময়ের নায়ক। তখনও নায়কের মুখ আলাদাভাবে মাধুর্য ছিল, পেশীর দম্ভে মজে থাকাই দর্শকের একমাত্র কাজ ছিল না। ফলে তার কমনীয় মুখ নিয়ে শশী কাপুর যখন পর্দা আলোকিত করে ফেলছেন, পথভোলা সেই পথিককে দেখে সকালবেলার মালতী ও সন্ধ্যাবেলার মল্লিকা উৎফুল হয়ে উঠত। শশী কাপুরের ভাই রাজ কাপুর ও শাম্মী কাপুরও ছিলেন ষাট ও সত্তরের দশকের জনপ্রিয় বলিউড অভিনেতা। তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায় শশী কাপুরের জন্ম। বিখ্যাত অভিনেতা রাজ কাপুর ও শাম্মী কাপুরের ছোট ভাই তিনি। পৃথ্বীরাজ কাপুর তার বাবা। মুম্বাইয়ের মাতুঙ্গার ডন বস্কো হাই স্কুলে অধ্যয়ন করেন। চার বছর বয়সেই অভিনয়কর্মে সংশ্লিষ্ট হন। পুথ্বী থিয়েটারে গমনকালে বাবা পৃথ্বীরাজ কাপুরের পরিচালনায় ও নির্দেশনায় নাটকসমূহে অভিনয় করেন। ১৯৪০-এর দশকের শেষদিকে শিশুশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন। বাণিজ্যিকধর্মী চলচ্চিত্র সংগ্রাম, দানা পানিতে ‘শশীরাজ’ নামে আবির্ভূত হন। পৌরাণিক চলচ্চিত্রে ওই সময়ে একই নামে আরও একজন শিশু শিল্পী অভিনয় করত। আগ ও আওয়ারায় শিশুশিল্পী হিসেবে স্মরণীয় অভিনয় করেন। ওই চলচ্চিত্রসমূহে তার বড়ভাই রাজ কাপুরের ছোটকালের চরিত্রে এবং ১৯৫০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সংগ্রাম চলচ্চিত্রে অশোক কুমারের ছেলেবেলার চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৪ সময়কালে সর্বমোট চারটি হিন্দী চলচ্চিত্রে শিশুশিল্পী ছিলেন তিনি। ১৯৬০-এর দশক থেকে শুরু করে ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বলিউডের অত্যন্ত জনপ্রিয় তারকায় পরিণত হয়েছিলেন। ১৯৬৩ সালে দ্য হাউজহোল্ডার ও শেক্সপিয়ার-ওয়াল্লার ন্যায় ইংরেজী ভাষার চলচ্চিত্রসমূহে অংশ নেন। ১৯৫৬ সালে কলকাতায় নিজ থিয়েটারে প্রশিক্ষণ গ্রহণকালীন ইংরেজ অভিনেত্রী জেনিফার ক্যান্ডলের সঙ্গে ভালবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। সহকারী মঞ্চ ব্যবস্থাপক ও অভিনেতা হিসেবে বাবার থিয়েটার গ্রুপ পৃথ্বী থিয়েটারে কাজ করতেন। জিওফ্রে ক্যান্ডলের শেক্সপিয়ারীয় গ্রুপ ওই সময়ে কলকাতায় আসে ও তার কন্যাই জেনিফার। বেশ কয়েকবার সাক্ষাতকারের পর তারা একে-অপরের দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। শুরুতে ক্যান্ডলের বাবা এতে বাধার কারণ হয়ে দাঁড়ান ও বউদি গীতা বালির সমর্থনে জুলাই, ১৯৫৮ সালে তাদের সম্পর্কে পরিণয়ে গড়ায়। তারা একত্রে কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। এ দম্পতির কুনাল কাপুর, করণ কাপুর ও সঞ্জনা কাপুর- তিন সন্তান রয়েছে। ১৯৮৪ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে জেনিফারের দেহাবসান ঘটে। ভারতের অন্যতম প্রথম অভিনেতাদের একজনরূপে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে অংশ নিয়েছেন তিনি। অভিনেত্রী নাদিরার সঙ্গে আবেগময় চলচ্চিত্র চার দিওয়ারি এবং মেহেন্দি লাগি মেরে হাতের ন্যায় সামাজিক চলচ্চিত্রে অংশ নিয়ে সাড়া জাগান শশী কাপুর। ১৯৬০-এর দশকে অভিনেত্রী নন্দার সঙ্গেও বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে জুটি গড়েন। ১৯৯০-এর দশকে এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন, নন্দা তার প্রিয় নায়িকা এবং অন্যতম পরামর্শদাত্রী ছিলেন। অন্যদিকে, নন্দাও শশী কাপুরকে তার প্রিয় নায়করূপে স্বীকার করেছেন। ১৯৬০-এর দশকের শেষভাগ থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত রাখী, শর্মিলা ঠাকুর, জিনাত আমানের সঙ্গে জুটি গড়েন শশী কাপুর। এ ছাড়াও হেমা মালিনী, পারভিন ববি ও মৌসুমি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন তিনি। এর মধ্যে হেমা মালিনীর বিপরীতে ১০টি চলচ্চিত্রে ছিলেন। বহুনায়ক নিয়ে গড়া প্রেম কাহানীতে রাজেশ খান্নার সঙ্গেও কাজ করেছেন। শশী কাপুর ১৭৫টিরও বেশি ছবিতে অভিনয় করেছেন। এ ছাড়া অনেক জনপ্রিয় ছবির প্রযোজক তিনি। তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে আছে ‘সিলসিলা’, ‘জুনুন’, ‘কালযুগ’, ‘বিজেতা’, ‘উৎসব’। ১৯৯১ সালে ‘আজুবা’ নামে একটি হিন্দী ছবি পরিচালনা করেন শশী কাপুর। এ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন অমিতাভ বচ্চন। তা ছাড়া এই তারকা ১৯৮৮ সালে একটি রাশিয়ান ছবি পরিচালনা করেন। শশী কাপুর ২০১১ সালে পদ্মভূষণ ও ২০১৫ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পান।
×