ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাব্যনাট্য কারিগর

প্রকাশিত: ০৭:২৮, ১ ডিসেম্বর ২০১৭

কাব্যনাট্য কারিগর

মধ্যযুগের কবি আলাওল রচিত পদ্মাবতী এবং ১৮৬০ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত পদ্মাবতী কাব্যগ্রন্থ দুটি বাংলা সাহিত্যে উৎকৃষ্ট আসন দখল করে আছে। দুই পদ্মাবতীর ব্যবধান অনেক- ভাষাগত বা ভাবগত সবদিকেই। কায়কোবাদের মহাশ্মশান মহাকাব্যটি আরেকটু ব্যতিক্রম। কাব্যনাট্য বা মহাকাব্য সৃষ্টিতে নিবেদিত কবিগণ নিজ নিজ আস্থার জায়গা তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। ঠিক তেমনই উনিশ শতকের পঞ্চম দশকে আবির্ভূত হন সৈয়দ শামসুল হক। এক বাংলা ভাষার মধ্যে যে কত স্বাদ, কত বৈচিত্র্য থাকতে পারে তা তিনি আবিষ্কার করতে সক্ষম হন। কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক, চিত্রনাট্য, কাব্যনাট্য সকল বিষয়ে পারদর্শিতার ছাপ রাখেন। ফলে তাঁকে সব্যসাচী লেখক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তিনি শুধু সব্যসাচী নন, সর্বজনীন বলে মনে করি। সাহিত্যের এতগুলো শাখার নিপুণ কুশলীকে কোনো একটি অভিধায় ভূষিত করা যায় না। সকল বিষয়ে খ্যাতির শীর্ষে তাঁর অবস্থান। এই নিবন্ধে এখানে শুধু সৈয়দ হকের ১০টি কাব্যনাট্য নিয়ে অল্প কিছু কথা বলার চেষ্টা করছি। মানুষ আসতে আছে কালীপুর হাজীগঞ্জ থিকা মানুষ আসতে আছে ফুলবাড়ী নাগেশ্বরী থিকা মানুষ আসতে আছে যমুনার বানের লাহান মানুষ আসতে আছে মহররমে ধূলার সমান ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ কাব্যনাটকে এভাবে মানুষ এনে শুরুতেই মঞ্চ ভরে ফেলা এক অন্যরকম কৃতিত্ব। এই কৃতিত্ব যে-কেউ দেখাতে পারে না। আবার সেই মানুষগুলো দিয়ে পুরো একটি পটভূমি তুলে ধরা চাট্টিখানি কথা নয়। পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধের নাটক। যুদ্ধ চলাকালীন একটি খ- ঘটনা। এই ঘটনায় স্বাধীনতা প্রাপ্তির কথা বলা হয়নি তবে জাতীয় পতাকা দিয়ে স্বাধীনতা প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করে পরিসমাপ্তি টানা হয়েছে। এখানেই লেখকের সার্থকতা। মুক্তিযুদ্ধে জীবন দান করা বা জীবন বাঁচানোর কৌশল এই নাটকে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বাস্তবতা কত নির্মম ছিল ভয়াবহ সেই দিনগুলোতে, তার সাক্ষাৎ এখানে পাওয়া যাবে। বিশেষ করে পীর সাহেব, মাতবর এবং মাতবরের মেয়ে চরিত্রের মাধ্যমে আমরা একটি ঘটনাকে পরিস্ফুটিত হতে দেখি। গ্রামবাসী যখন বলতে থাকে মুক্তিবাহিনী আসছে, তারা বাজার বন্দর দখল নিচ্ছে এবং নতুন নিশান উড়াচ্ছে। কিন্তু এটা তারা দেখেনি, শোনা কথা। তখন মাতবর বলে, নিজ চক্ষে দ্যাখো নাই সেটা বোঝা যায় চক্ষুর চেয়েও দূরে দুই কান যায় শোনো নাই মানুষের মরণ-চিৎকার? আওয়াজ কি পাও নাই আগুন লাগার? দ্যাখো নাই সেই তাপে লাল আসমান ভোরের আগেই এক ভয়ানক ভোরের লাহান? মূলকথা মাতবর যখন পাকিস্তানীদের পক্ষে তখন তার কানে মুক্তিবাহিনীর কথা কিছুতেই ঢুকবে না। সেজন্যেই মাতবর উঁচু গলায় বলতে পারে সৈন্যের সঙ্গে কি পারে মাটির কিষান? মাতবর পীরকেও নিজের পক্ষে নিতে চেষ্টা করে। পীরকে বুঝিয়ে বলতে বলে গ্রামবাসীকে যে আমাদের জয় হবে। গ্রামবাসী ও মাববরের মধ্যে যখন এমন বাদানুবাদ চলতে থাকে তখন মাতবরের মেয়ে এসে গ্রামবাসীকে শান্ত হতে বলে। সবাই আশ্চর্য হয় এবং মাতবর আতঙ্কিত হয়। মেয়ে তার বাবার মুখোশ খুলতে চেষ্টা করে এই বলে- কেউ যাইতে চায় না বাজান ক্যান জানতে চান? নিজের মুখের দিকে একবার নিজেই তাকান কি দেখতে পান? নিজের মুখের দিকে আয়না ছাড়া তাকানো যায় না সবাই জানে। মাতবর মেয়ের কথায় হতভম্ব হয়ে পড়ে। হাতে পায়ে ধরে মিনতি করে মেয়েকে ঘরে যেতে বলে। কিন্তু মেয়ে গতরাতের ঘটনা খুলে বলে। কিভাবে তাকে মিলিটারির হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। মাতবর নিজেই কলমা পড়িয়ে মেয়েকে মিলিটারির সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে কিন্তু গভীর রাতেই সে চলে গেছে। এই বিশ্বাসঘাতকের কথা মেয়ের কণ্ঠে এভাবে এসেছে- জিগ্যাসা করেন তারে, এক রাত্রি পরে সাধের জামাই তার নাই ক্যান ঘরে? রাত্রি দুইফরে সে ক্যান ফালায়া গেল আমার জীবন হঠাৎ খাটাশে খাওয়া হাঁসের মতন? এই উক্তি দিয়ে তার সর্বনাশের কথা পরিষ্কারভাবে বুঝানো হয়েছে। শেষে মেয়ে বিষপানে আত্মহত্যা করে এবং নিজের পাইকের ফলায় খুন হয় মাতবর। বুঝিয়ে দেয়া হয় অনেক আত্মহত্যা, অগ্নিকা-, ধ্বংসযজ্ঞ, নারীর সম্ভ্রম হানির বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। ‘সবশেষে পতাকার ওপর আলো থাকে।’ বুঝে নিতে কষ্ট হয় না এই আলোই আমাদের ভবিষ্যৎ। ‘নিলক্ষা আকাশ নীল, হাজার হাজার তারা ঐ নীলে অগণিত আর নিচে গ্রাম, গঞ্জ, হাট, জনপদ, লোকালয় আছে ঊনসত্তর হাজার। ধবলদুধের মতো জ্যোৎস্না তার ঢালিতেছে চাঁদ- পূর্ণিমার।’ -সূত্রধারের এমন কথা দিয়েই শুরু হয় ‘নূরলদীনের সারাজীবন’। এই নাটকের কাব্যিক সূত্রপাত থেকেই অনুমান করা যায় এটা শুধু ইতিহাস নির্ভর নয়, অনেক জীবনঘনিষ্ঠ বক্তব্য এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে। সূত্রাধার নূরলদীনের পরিচয় তুলে ধরে যখন বলে চলে- নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় যখন শকুন নেমে আসে এই সোনার বাংলায়; নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় যখন আমার দেশ ছেয়ে যায় দালালেরই আলখাল্লায়; নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় যখন আমার স্বপ্ন লুট হয়ে যায়; তখন বুঝতে বাকি থাকে না ১১৮৯ সনে রংপুরের নূরলদীন যে ডাক দিয়েছিল সেই ডাকের প্রয়োজন এদেশে এখনও প্রয়োজন। সেই সময়ের সঙ্গে বর্তমান সময়ের সামঞ্জস্যপূর্ণ কথাকে কাব্যিকভাবে তুলে ধরে সৈয়দ হক কালজয়ী এই কাব্যনাট্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি ১৯৮২ সালে এটি রচনা করলেও শুধু বর্তমান সময় পর্যন্ত নয়, আগামীতেও এটা সময়োপযোগী হিসেবে স্থায়ী রূপলাভ করবে বলে বিশ্বাস। মৃত নূরলদীনকে প্রতীক হিসেবে দাঁড় করিয়ে তার মুখ থেকে অন্যায়-অত্যাচার, শাসন-শোষণের কথা প্রকাশ করেছেন সৈয়দ হক যে-কথা আজও সমানভাবে প্রযোজ্য। গরিব চাষীরা কোম্পানিকে নগদ টাকায় খাজনা দেবার আদেশে ধান বিক্রি করে। আবার সেই মহাজন-জমিদার-কুঠিয়ালদের কাছ থেকে দ্বিগুণ দামে ধান কিনতে হয় ক্ষুধার তাড়নায়। তখন কর্জ ছাড়া উপায় থাকে না, আবার সেই কর্জ পরিশোধ করতে চাষীরা তাদেরকে গরু, জমি সবকিছু দিয়ে দেয়। অবশ্য নূরলদীনের প্রতিবাদের ভিতটা তৈরি হয় আরও আগে। তখন সে খুব ছোট ছিল এবং বাবার আহ্বানে মক্তবে না গিয়ে মাঠে গিয়েছিল বাবার সঙ্গে। আনন্দে সে বইখাতা ফেলে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু যখন দেখল গরুর বদলে তার বাবা জোয়ালে কাঁধ দিয়েছে তখন তার কষ্টের কান্না সে ছাড়া বোঝার সাধ্য কারও নেই। নূরলদীনের দীর্ঘ এই সংলাপটিতে শুধু ক্ষুধা আর অপমানের চিত্রই ফুটে ওঠেনি, অসহায়ত্বের করুণ চিত্র লিপিবদ্ধ হয়েছে। পাঠক বা দর্শকের চোখে জল চলে আসবে। জোয়াল কাঁধে বাবা লাঙল টানতে অক্ষম হয় এবং সে পড়ে যায়। সংলাপটির অংশবিশেষ তুলে ধরছি। (চলবে)
×