ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

*যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ

লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা বাস দিয়ে চলছে বিআরটিসির বরিশাল ডিপো

প্রকাশিত: ২১:৫১, ৩১ অক্টোবর ২০১৭

লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা বাস দিয়ে চলছে বিআরটিসির বরিশাল ডিপো

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ দীর্ঘদিনের পুরনো বাস আর মাথাভারী প্রশাসনিক ব্যয় নিয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিআরটিসির একমাত্র বাস ডিপোটি এখন লোকসানের মুখে পরেছে। একসময়ে রাষ্ট্রীয় সড়ক পরিবহন সংস্থার দেশের সর্বোচ্চ লাভজনক এ বাস ডিপোটি এখন দুই যুগের পুরনো মেরামত অযোগ্য বাস দিয়ে যাত্রীসেবার নামে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের পরিধিই কেবল বৃদ্ধি করছে। পুরনো লক্কর-ঝক্কর বাস যাত্রীসেবার পরিবর্তে বর্তমানে যাত্রী দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। এ কারণে যেসবস্থানে বেসরকারী বাস রয়েছে সেখানকার যাত্রীরা বিপদে না পরলে বিআরটিসি বাসে উঠেন না। এরমধ্যে রয়েছে কতিপয় প্রভাবশালী অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে এ ডিপোর ৬১টি বাসের মধ্যে ১৮টি মেরামতে অযোগ্য হয়ে পরেছে। অবশিষ্ট ৪৩টি বাসের মধ্যে ১৬টি এসি বাস মাত্র তিন বছর আগে ভারতীয় ঋণে সংগ্রহ করা হলেও তা এখন যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ ভ্রমণের পরিবর্তে বিড়ম্বনাকে বৃদ্ধি করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রাষ্ট্রীয় সংস্থাটির অনেক বাসে বর্ষার সময় ছাতা মাথায় দিয়েও বসতে হয় যাত্রীদের। সূত্রে আরও জানা গেছে, শত বিড়ম্বনার পরেও দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে বিআরটিসি বাসের গ্রহণযোগ্যতা এখনো রয়েছে। এখনো সংস্থাটির বরিশাল বাস ডিপোর ৪৩টি গাড়ি দৈনিক প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার সড়কপথে অন্তত পাঁচ হাজার যাত্রী পরিবহন করে আসছে। তবে প্রতি মাসে ডিপোটি দেড় কোটি টাকারও বেশি যাত্রীভাড়া আয় করলেও পুরনো গাড়ির অতিরিক্ত জ্বালানি ব্যয়, নদ-নদীবেষ্টিত দক্ষিণাঞ্চলের সড়কপথে ফেরি ভাড়া ও সেতুর মাত্রাতিরিক্ত টোল পরিশোধের সাথে অতিরিক্ত প্রশাসনিক ব্যয় মেটাতে এ বাস ডিপোটির লাভের পথ রুদ্ধ করছে। বছরে দুটি উৎসব ভাতা প্রদানেও এ ডিপোটির কোষাগার থেকে অতিরিক্ত প্রায় ২০ লাখ টাকা চলে যাচ্ছে। ফলে একসময়ের লাভজনক বরিশাল বাস ডিপোটি এখন অনেকটাই লোকসানের মুখে পরেছে। বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত বিআরটিসির বাস ডিপোটি ১৯৮২ সালে সামরিক সরকার বন্ধ করে দেয়ার পর ১৯৮৭ সালে পুনরায় চালু করার প্রতিটি স্তরেই পুরনো বাসই ছিল একমাত্র ভরসা। এরমধ্যে প্রায় তিন বছর পূর্বে ১০টি নতুন ভারতীয় এসি বাস দিয়ে বরিশাল-মাওয়া রুটে বিশেষ একটি সার্ভিস চালু করা হয়। প্রথমে এ সার্ভিসটি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও নিন্মমানের গাড়ির কারণে এখন তা যাত্রী বিড়ম্বনায় পরিণত হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বরিশালে অনুরূপ ১৬টি বাস প্রদান করা হলেও তার সবগুলোই এখন এ ডিপোর অনেকটা বোঝায় পরিণত হয়েছে। এসব এসি বাসের প্রায় সবগুলোতেই প্রচন্ড গরমে যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ কেড়ে নিচ্ছে। অথচ যাত্রীদের এ জন্য বাড়তি ভাড়াও গুনতে হচ্ছে। এছাড়া বৃষ্টি মৌসুমে ও মাছের কোনো ঝুড়ি নিলে বাসের ভেতরে পানি পড়তে থাকে অনবরত। তাই এসব রুটে সবসময় যারা চলাচল করেন সেইসব যাত্রীরা পানি থেকে রক্ষা পেতে ছাতা নিয়েই বাসে উঠেন। ডিপো সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বরিশাল-মাওয়া ছাড়াও বরিশাল-রংপুর, বরিশাল-চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং ভোলা-বরিশাল-খুলনা-যশোর রুটে সংস্থাটির এসি বাস চলছে। তবে অতিনিন্মমানের এসব এসি বাস চলছে সম্পূর্ণ জোড়াতালি দিয়ে। দুঃসহ গরমে যাত্রীদের মাথার ঘাম পায়ে গড়াচ্ছে। প্রায় প্রতিটি গাড়ির এসি ব্যবস্থাই ত্রুটিপূর্ণ। গাড়ির মূল বডি থেকে শুরু করে এর দরজা পর্যন্ত জোড়াতালি দিয়ে চালাতে হচ্ছে। সূত্রমতে, এসব কিছুর পরেও রাষ্ট্রীয় সড়ক পরিবহন সংস্থাটির ৪৩টি বাস বরিশাল থেকে মাওয়া ছাড়াও কুয়াকাটা থেকে রংপুর, বরিশাল থেকে খুলনা-যশোর হয়ে বেনাপোল, বরিশাল-কুয়াকাটা, বরিশাল থেকে পটুয়াখালী হয়ে বরগুনা, বরিশাল থেকে খুলনা হয়ে সাতক্ষীরা, মুন্সিগঞ্জ পর্যন্ত প্রতিদিন যাত্রী পরিবহন করে আসছে। যারমধ্যে কোনো রুটের বাসেই যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দে ভ্রমণের উপযোগিতা নেই। এমনকি ২০০২ সালে বরিশাল থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত বিআরটিসির একটি ‘স্পেশাল পর্যটক বাস সার্ভিস’ চালু করার পর গত প্রায় ১৫ বছরেও এ রুটে কোনো মানসম্মত বাস দিতে পারেনি বিআরটিসি। সে সময়ে বরিশাল থেকে ঝালকাঠী-পিরোজপুর-খুলনা-যশোর হয়ে বেনাপোল পর্যন্ত একটি বাস সার্ভিসও চালু করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ এ সড়কপথের বাস সার্ভিসটির অবস্থাও এখন অত্যন্ত করুণ। সংস্থাটির লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা বাস গত মাসে বরিশাল থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত রুটে দিন দশেকের বেশি পরিপূর্ণভাবে যাত্রী পরিবহন করতে পারেনি। অবশিষ্ট কুড়ি দিনই পথে পথে যাত্রী বোঝাই গাড়ি বিকলের ঘটনা ঘটে। যে কারণে দেশি-বিদেশি যাত্রীদের দুর্ভোগ চরম পর্যায়ে পৌঁছার পর চলতি মাসে ওই রুটের সার্ভিসটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অন্য প্রায় সবগুলো রুটেও বিআরটিসির বাসের একই দুর্গতি অব্যাহত রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে বিআরটিসির বরিশাল ডিপোর ৪৩টি সচল বাসের বিপরীতে এখানে কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে ১৯০ জন। যা এ বাস ডিপোটির লাভের পথকে অনেকটা রুদ্ধ করেছে। এখানে সর্বসাকূল্যে ১০০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রয়োজন হলেও অতিরিক্ত জনবল পুষতে গিয়ে ডিপোটির অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটাই নড়বড়ে হয়ে পরেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তাছাড়া ডিপোর কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যাত্রী সংকটের অজুহাত থেকে শুরু করে বাস মেরামতে অতিরিক্ত খরচসহ বিভিন্ন খাত থেকে রয়েছে বিপুল পরিমান অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ। এসব অভিযোগে বিভিন্ন সময় তদন্ত হলেও তা আর কোনদিন আলোর মুখ দেখেনি। ফলে দুই যুগের পুরনো ও মেরামত অযোগ্য বাস এবং বিশাল অঙ্কের প্রশাসনিক ব্যয়ভারের কারণে লাভের মুখ দেখতে পারছে না বরিশাল বিআরটিসির বাস ডিপো। বিআরটিসি বাসে চলাচলকারী ভূক্তভোগী একাধিক যাত্রীরা বলেন, গাড়ির ইঞ্জিন খারাপ থাকায় বরগুনা থেকে বরিশালে আসতে পথিমধ্যে চার থেকে পাঁচ বার ইঞ্জিন বিকল হয়। যে কারণে অনেক যাত্রীরাই তাদের নির্ধারিত কাজ সেরে সঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারছেন না। এ ছাড়া গাড়ির উপরের ছাঁদ ফুটো। তাই বর্ষা মৌসুমে ও গাড়ির ছাদে মাছের ঝুড়ি নেয়ায় গাড়ির ভিতরে ঝর ঝর করে পানি পরছে। উপায় না পেয়ে যাত্রীদের গাড়ির ভিতরেই ছাতা খুলে বসতে হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে যাদের কাছে ছাতা থাকে না তাদের ভিজতে ভিজতেই গন্তব্যে পৌঁছতে হচ্ছে। এছাড়া অনেক গাড়ির জানালায় গ্লাস নেই। ভাঙ্গা-চোরা গ্লাস যাওবা আছে তা আবার দড়ি দিয়ে বাঁধা। সিটগুলো ভাঙ্গাচূড়ার কারণে যাত্রীদের সিটে বসতেও চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। এ ব্যাপারে বরিশাল বাস ডিপোর ম্যানেজার মোঃ কামরুজ্জামান জানান, পরিস্থিতি উত্তরণের চেষ্টা চলছে। যত দ্রুত সম্ভব বরিশাল বাস ডিপোতে ভালো মানের বাস সরবরাহের ব্যাপারে সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছেন। তিনি আরও জানান, বরিশাল-খুলনা-বেনাপোল ও বরিশাল-কুয়াকাটা রুটে ভালমানের এসি বাস চালুর জন্য সংস্থার সদর দফতরকে অনুরোধ করা হয়েছে। অতিরিক্ত জনবলের বিষয়ে তিনি (কামরুজ্জামান) কোনো মন্তব্য না করে জনবল নিয়োগের বিষয়টি তার এখতিয়ার বহির্ভূত নয় বলে উল্লেখ করেন।
×