ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভোটের পদধ্বনি শোনা যায়

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ৩০ অক্টোবর ২০১৭

ভোটের পদধ্বনি শোনা যায়

বয়স্কের ভোটাধিকার সূত্রেই দেশের বারো আনা মানুষ রাজনীতির বাজারে জমায়েত হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন দৈনন্দিন ব্যাপার নয়। এমনকি মাসিক বা বার্ষিক ঘটনাও নয়। একবার হয়ে গেলে চার-পাঁচ বছর দম ধরতে হয়। পাছে ভোটার হাতছাড়া হয়ে যায় সেই ভয়ে প্রতিটা দলই নিজ নিজ ক্ষমতানুযায়ী যত পেয়েছে ভোটার, করায়ত্ত করে দল রজ্জুতে বাঁধার প্রচেষ্টায় থাকে সচেষ্ট। প্রতিটি মানুষেরই সমান অধিকারপ্রাপ্ত। কিন্তু সে জন্য তাকে তৈরি করে নিতে হবে। সে কাজে সময় চাই, চাই ধৈর্য। কিন্তু আমরা সে জন্য অপেক্ষা করিনি। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কলমের এক খোঁচায় প্রাপ্ত বয়স্ক স্ত্রী-পুরুষ সকলকে ভোটাধিকার দেয়া হয়েছে। ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য কোন যোগ্যতারই প্রয়োজন নেই, বয়স আঠারো হলেই হলো। তার আগে এই বয়স ছিল একুশ। কৈশোরোত্তীর্ণরাও এখন ভোটার। এসব বয়স্ক ভোটাধিকারী যে প্রকৃতপক্ষে বয়স্ক নয় এ কথা আমাদের নেতৃবর্গ জানেন না বোঝেন না, এমন নয়। জেনেশুনে, ভেবেচিন্তেই এ ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশে এখন শতকরা ৬০ জন নিরক্ষর অশিক্ষিত। ভোটের মর্ম তারা কিছু বোঝেনি, এটা অনায়াসে বলা যায়। সোজা কথায় ভোটের হিসেবে তারা ‘সাবালক’ বলা যাবে না। এটা সবই অবজ্ঞাত যে, ভোটদাতারা যত বেশি অজ্ঞ হবে, ভোটপ্রার্থী বিজ্ঞদের তত বেশি সুবিধা হবে। তাই বলে বলা যাবে না, পুরো নির্বাচন ব্যাপারটাকেই ‘খেলো’ করে ফেলা হয়েছে। যদি হয়, তবে রাজনৈতিক দলগুলোই এ জন্য দায়ী। তারা ভোটারদের মনোজগতে ভোটের বিষয়ে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কিত দিকটি প্রবিষ্ট করাতে পেরেছে। তা নয়। কারও কারও কাছে মনে হয়, এই যে ভোটারদের বয়স একুশ থেকে নামিয়ে আঠারো করা হয়েছে। এর একমাত্র কারণ ‘অবোধ, নির্বোধের’ সংখ্যা যত বাড়বে, নির্বাচন তত সহজ হবে। পাশাপাশি গর্ব করে অনেকে বলেনও, কত বড় একটা অধিকার লোকজনের হাতে এনে দেয়া হয়েছে। অনধিকারী অধিকারভোগী ওই জনগণ শুধু অশিক্ষিত নয়, অতি দরিদ্রও। নামমাত্র টাকা দিয়ে অনায়াসে ভোট কিনে নেয়া যায়, চা-বিড়ি খাওয়ালেও কার্য সিদ্ধ হয়। এটা এ দেশের ভোটের রাজনীতির অনেক পুরনো চিত্র। কেউ এমনটাও মনে করেন, লাভের মধ্যে এই হয়েছে যে, বয়স্ক ভোটাধিকার নামক রাজনৈতিক অধিকারটি দিয়ে দুর্নীতির একটি প্রশস্ত মহাসড়ক তৈরি হয়েছে। অবশ্য নেতারাও স্বখাত সলিলে ডুবেছেন। তবে কি, অসহায়, অক্ষমের ভোটে নির্বাচিত সরকার অক্ষম হতে বাধ্য? ত্যাগী জনদরদী নেতার বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে এসেছে। রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, বিত্তবান, অর্থবান লোকেরা নির্বাচনে অনায়সে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থী বনে যান। আর টাকার জোরে ভোটার কিনে ফেলার কৌশলও রপ্ত করে ফেলেন। ফলে টাকার বিজয় ঘটে, জনবান্ধব রাজনীতিক এই চর্চায় অবতীর্ণ না হওয়ার কারণে কোথাও কোথাও জামানত হারান। নির্বাচনী ব্যয় নির্দিষ্ট করে দিলেও, টাকা দিয়ে ভোট কেনা বন্ধ করা যায় না, ভোটারের সচেতনতার অভাবে। এটা তো বাস্তব যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এদেশের একটি মস্ত বড় সমস্যা। তা জেনেও রোহিঙ্গা এবং আটকে পড়া পাকিস্তানীদের ভোটার করা হয়েছে ভোটের লোভে। অদূরদর্শিতা যে অনেক সময় দেশদ্রোহিতায় পরিণত হয়, এটি তার অন্যতম উদাহরণ। দলপ্রেম এবং দেশপ্রেমের মধ্যে যে মস্ত বড় একটা বিরোধ রয়েছে সেটা সম্ভবত রাজনীতিকদের মনে খুব স্পষ্ট নয়। এ কারণে অনেক সময় দেখা যায়, দলের স্বার্থে দেশের স্বার্থকে বলি দেয়া হচ্ছে। পাকিস্তান পর্বে ভোটের নামে যা হয়েছে, তা সর্বার্থে জনমতের প্রতিফলন ঘটেনি, কেবল সত্তর সালের নির্বাচন ছাড়া। সত্তর সালে সাধারণ ভোটারের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা যেমন অদ্ভূতপূর্ব, তেমনি ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল অপরিসীম। কিন্তু বাংলাদেশ পর্বে পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক জান্তা শাসকরা ভোট নিয়ে যে ছিনিমিনি খেলেছে, তাতে ভোটাধিকার, জনমত প্রতিফলনÑ সবই পদদলিত হয়েছে। ভোটারের অধিকার খর্বের সেই মহোৎসবে ভোটকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছিল। নির্বাচন কমিশন ছিল জান্তা শাসকদের বশংবদ। জান্তারা যেভাবে চেয়েছে, সেভাবেই ভোট আয়োজন করা হয়েছে। আবার ভোটের ভ্রান্ত ফলাফল জান্তার পক্ষে না গেলে তা উল্টে ফেলা হয়েছে। রাজনীতিকরা নয়, মাসলম্যানরাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রার্থী হওয়া শুধু নয়, নির্বাচিতও হয়েছে। ফলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা দানবে পরিণত হয়ে গণনিপীড়নকে যেমন প্রাধান্য দিয়েছে, তেমনি দুর্নীতিকেও। সামান্য থেকে অর্থে-বিত্তে অসামান্য হয়ে উঠেছে। মানি ইজ নো প্রব্লেম-এর প্রবক্তা জান্তা শাসক রাজনীতিকে কঠিন করে তোলার নামে উৎসাহিত করেছেন যে, রাজনীতি খুব একটা লাভজনক ব্যবসা। সেই ব্যবসাকে ত্বরান্বিত করতে বিভিন্ন দল ভেঙ্গে বহু দল গঠন করিয়েছেন। আবার বিভিন্ন দলের দলছুট ও উচ্ছিষ্টদের নিয়ে দল গঠন করেছেন। সেই জান্তা শাসকের আমলে দেখতে দেখতে নতুন দল গজিয়ে উঠতে লাগল যত্রতত্র ব্যাঙের ছত্রের মতো। এই ছত্রপতিরা সকলেই উচ্চাকাক্সক্ষী। কেউ রাজত্বের, কেউ মন্ত্রিত্বের, কেউ ধনার্জনের অভিলাষী। রাজা, মন্ত্রী হতে গেলে সেপাই-শান্ত্রীর প্রয়োজন। সে আয়োজনও চলতে থাকে। সেইসব নেতার (!) সহচর অনুচররা ‘রং রুট’ জোটাতে লেগে যায়। প্রত্যেক দলনেতারই একটি করে সেনাদল গড়ে ওঠে। কোন দলের সঙ্গে কোন দলের মিল নেই। প্রতিটি সেনাদল একে অন্যের বিরুদ্ধে উদ্যত মুষল যেন। ফলে দেশময় মারামারি খুনোখুনী। খোদ জান্তা শাসকের নির্মিত রাজাকার, আলবদর, চৈনিক, মুসলিম লীগ ইত্যাদি সমন্বয়ে গঠিত বারোভাজা দলটির মধ্যে খুনোখুনী, হাঙ্গামার কমতি ছিল না। জান্তার সৃষ্ট রাজনীতির প্রধান কাজ হয়েছে অরাজকতার সৃষ্টি। এ যে মারামারি খুনোখুনী, হাঙ্গামা- সবই যেন জান্তা রাজনীতির মতে ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’। খুন করতে খুনী নিজেই যদি খুন হয়, তাহলে তার পরিবারকেও লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছে। জান্তা শাসকরা স্পষ্ট করে দিয়েছেন, রাজনীতি অতি লাভের ব্যবসা। ভুঁইফোঁড় এসব রাজনীতিকের ভিড়ে গণবান্ধব, ত্যাগী, আদর্শবাদী রাজনীতিকরা হারিয়ে যেতে থাকেন। কেউ কেউ প্রলোভনের চক্রবালে পতিত হয়ে জান্তা শাসকদের গীত ও গান গেয়ে নিজের দীর্ঘকালের অর্জনকে ধূলিসাত করতে পিছপা হননি। দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, চোরাচালানি, ডাকাত, বাটপাড় ইত্যাদি অপরাধে অপরাধীরা জান্তা শাসকদের দলভারি করতে পিছপা হয়নি। এরা রাষ্ট্রায়ত্ত মিল-কলকারখানার মালিক বনে গেছেন ব্যাংকের অর্থ লগ্নি নিয়ে। ব্যাংকের অর্থ লোপাট প্রক্রিয়ায় খেলাপী ঋণের সংখ্যা বাড়তে থাকে। দাগি এবং যাবজ্জীবন কারাদ-ভোগীরাও রাজনীতির উচ্চাসনে ঠাঁই পেতে থাকে। সবচেয়ে ভয়াবহ দিক স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিগুলো জান্তা শাসকের সহায়তায় আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রী, সিনিয়র মন্ত্রী হয়ে যান। আর ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক ও বাংলাদেশবিরোধী দলগুলো রাজনৈতিক অঙ্গনে তৎপর হয়ে ওঠে জান্তার পৃষ্ঠপোষকতায়। অর্জিত স্বাধীনতার সুফলগুলোকে সমাধিস্থ করে পাকিস্তানী চেতনা ও ভাবধারা প্রকটিত হয়ে ওঠে। মুছে যেতে থাকে স্বাধীনতার সব স্মৃতি, এমনকি স্মৃতিসৌধও। সমস্ত দেশটাকে লোভনীয় রাজনীতির জালে জড়ানো হয়েছিল। যাকে আমাদের নয়া সিইসিও বলেছেন, ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা ছিলেন সেই শাসক। দল ভেঙ্গে অজস্র দল গঠন, ধর্ম ব্যবসায়ী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতিতে পুনরুজ্জীবন, অরাজনীতিকদের রাজনীতিতে এনে পরিবেশ কলুষিত করাই ছিল এই বহুদলীয় গণতন্ত্র। গোটাবিশেক দল থেকে এক লহমায় এক শ’ বিশটি রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠার নামই হচ্ছে এই ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’। জান্তা শাসক যখন রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করেন, প্রথম সারির রাজনৈতিক দল তাতে অংশ নেয়নি অযথা প-শ্রম ভেবে। সেই নির্বাচনে ঝাড়ফুঁক দানকারী, মলম বিক্রেতা, যৌবন বটিকার কারবারি, বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তিরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এদের নির্বাচনী ব্যয়ও সরকারী তহবিল থেকে প্রদান করা হয়েছিল। সে এক প্রহসনের সময় ছিল। লোক হাসানোর কাজটি সে সময় থেকেই শুরু। নির্বাচনকে যে কত হেয় করা যায়, ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ছিল তারই উদাহরণ। গণতন্ত্র আনতে পারেননি। আনার কথাও নয়। সামরিক জান্তা গণতন্ত্রে বিশ্বাসই করে না যেখানে, সেখানে গণতন্ত্রের প্রবক্তা হওয়ার সুযোগ কোথায়? তবে এটা ঠিক, তিনি বহুদল গঠন করিয়েছিলেন। খোদ আওয়ামী লীগ থেকে দলছুট হয়ে গঠিত হয়েছিল আটটি দল। মুসলিম লীগ নামক ৫টি দল তৈরি করান। আর মওলানা ভাসানীর ন্যাপ পার্টি তো নিজেই গিলে ফেলেন। এমনকি দলটির নির্বাচনী প্রতীকও। দল ভেঙ্গে আরও দল গঠনের সংখ্যা বাড়ালেই যে দলের শক্তি বাড়ে না, বরং দুর্বল ধারার দল গড়ে ওঠে। জান্তা শাসক নিজের দলের শক্তি বাড়াতে বিভিন্ন দলের শিক্ষিত, অশিক্ষিত, যোগ্য, অযোগ্য সকলকে নির্বিচারে দলে টেনে এনেছিলেন অর্থ, সম্পদ, ক্ষমতা, পদ ও পদবির লোভ এবং টোপ ফেলে। কর্তব্য অকর্তব্য জ্ঞানশূন্য এসব অবোধজন তারসহ অন্য দলকে অল্পবিস্তর বেসামাল করে তুলেছিল। দ্বিতীয় জান্তা শাসক, প্রথম জান্তা শাসকের পথ ধরে এগিয়েছেন। তিনিও দল ভাঙ্গার কারিগর ছিলেন। দল থেকে ভাগিয়ে নিয়ে মন্ত্রী বানানোর কায়দাকানুন রপ্ত ছিল বলে ক’দিন পরপর মন্ত্রী বদল ঘটানো হতো। এই দুই শাসক রাজনীতির শুধু নয়, ভোটেরও ক্ষতি করেছিলেন। আর ভোটারদের উপঢৌকন দিয়ে ভোট আদায়ের সুবিধাবাদী চরিত্রের বিস্তৃতি ঘটাতে থাকেন। দেশসুদ্ধ লোককে শুধু নয়, সামরিক কর্মকর্তাদেরও রাজনীতির জালে জড়ানো হয়েছিল। সে এক জগাখিচুড়ি সময় পাড়ি দিয়েছে দেশবাসী। দুই জান্তা শাসকই আওয়ামী লীগ নামক দলটির ওপর একের পর এক আঘাত হেনেছে। দলটিকে করেছে দুর্বল। জান্তাদের কাম্য ছিল না দেশের কল্যাণ হোক। বরং কামনা ছিল দলের কল্যাণ সাধন এবং তার ওপর ভর করে শাসন ক্ষমতা দীর্ঘমেয়াদী করাই ছিল উভয়ের লক্ষ্য। নিজেদের ক্ষমতা বাড়েনি একচুলও। তারপরও তারা ক্ষমতার ভিত্তি তৈরি করতে পারেনি। বরং আন্দোলনের মুখে এবং নিজস্ব বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন তারা। যে নষ্টামি করেছেন দুই জান্তা শাসক ও তাদের অনুচররা তার মাশুল গুনতে হচ্ছে দেশবাসীকে আজও। আগামী বছরের শেষ নাগাদ জাতীয় সংসদের নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন তিন মাসব্যাপী রাজনীতিক দল, সুশীল সমাজসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নির্বাচন আয়োজন নিয়ে সংলাপ করেছে। তাতে কেউ কেউ বলেছেন, নির্বাচনের প্রধান সমস্যা বিশৃঙ্খলা। কিন্তু বলেননি এই বিশৃঙ্খলার জনক ও ধারক কারা। বক্তারা জান্তা শাসকদের নাম মুখে আসে না জানি। কিন্তু ইতিহাসের সত্য তাতে চাপা পড়ে না। ভোটের পদধ্বনি শোনা যায়। তাই এখন থেকেই ভোটারদের কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে বোধ তৈরি করা উচিত। নতুবা ভোট বেচাকেনা নামক নষ্টামি দূর হবে না।
×