ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৪:১০, ১০ অক্টোবর ২০১৭

ঢাকার দিনরাত

জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চমৎকার ভূমিকা রেখে ওয়াশিংটনে অস্ত্রোপচার শেষে বিলেত ঘুরে বেশ ক’দিন পর দেশে ফিরলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর গণসংবর্ধনার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে রাজধানীর বেশ কিছু সড়কে বিশেষ সজ্জার ব্যবস্থা নেয়া হয়। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছাকাছি তা ছিল নজর কাড়ার মতোই। ভূমিতেও স্থাপিত হয়েছিল সুদীর্ঘ বিলবোর্ড। তাতে প্রধানমন্ত্রীর ছবিসহ কিছু অর্থময় পঙ্ক্তিও উৎকীর্ণ ছিল। যেমনÑ ‘মানবতার পক্ষে শান্তির লক্ষ্যে তোমার বজ্র কন্ঠ/ আজ সারা বিশ্বে ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত।’ ‘শেখ হাসিনার অবদান/ পদ্মা সেতুর দৃশ্যমান।’ এতে বানান ও বাক্যের শুদ্ধতা সামান্য ক্ষুণœ না হলে আরো ভালো হতো। বজ্রকণ্ঠ হবে এক শব্দ। কণ্ঠ শব্দের বানানে ‘ন’ নয়, মূর্ধণ্য হবে; আর ‘পদ্মা সেতু দৃশ্যমান’ই সঠিক, বাক্যে ‘সেতুর’ রাখলে লিখতে হবে ‘দৃশ্যমানতা’। রুদ্ধ মুক্তাঙ্গন ঢাকার পার্কগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে বলে আমরা হাপিত্যেশ করি। সংবাদকর্মীরা খেটেখুটে পার্কগুলোর দৈন্যদশা তুলে ধরেন। পাঠক পড়ে ক্ষুব্ধ হন, কর্তৃপক্ষ নীরব থাকেন। ফলে পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয় না। এভাবে ধীরে ধীরে একটি শহর ভেতরে ভেতরে পঙ্গু ও খর্বকায় হয়ে পড়ে। আজ থেকে দশ বছর পর যদি এ লেখা কেউ পড়েন ইন্টারনেটের কল্যাণে, তিনি যদি আলোচিত পার্কটির হালফিল খবর জানতে চানÑ তখনই বোঝা সম্ভব কী ক্ষতি হয়ে গেছে। বলছিলাম ‘মুক্তাঙ্গন’ পার্কটির কথা। পাকিস্তান আমলে প্রায় ৮৪ শতাংশ জমির ওপর মুক্তাঙ্গন পার্কটি গড়ে ওঠে। জিপিওর পশ্চিম কোলঘেঁষা পার্কটি ১৯৭৯ সাল থেকে রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের জন্য ব্যবহৃত হতে শুরু করে। ১৯৯০ সালের পর থেকেই পার্কটির চরিত্র ধীরে ধীরে বদলে যেতে দেখে ঢাকাবাসীরা। সর্বশেষ ২০১১ সালের ২৬ এপ্রিল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ এক আদেশে মুক্তাঙ্গনে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ওই সময় হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কয়েকটি ইসলামী সংগঠন মুক্তাঙ্গনে সমাবেশ ডাকলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় ডিএমপি এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত কোন সংগঠনকে সেখানে সভার অনুমতি দেওয়া হয়নি। সভা-সমাবেশ না হওয়ার সুবাদে এখানে মহাসমারোহে চলছে দখল উৎসব। মুক্তাঙ্গনের সিংহভাগই অবৈধভাবে দখল করে ‘ঢাকা মাইক্রোবাস ও কার মালিক সমিতি’ নামের একটি সংগঠন প্রাইভেট কার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। পার্ক তার স্বরূপে ফিরুকÑ সীমিতভাবে অরাজনৈতিক সামাজিক সংগঠনের অনুষ্ঠানের জন্য আংশিক খোলা জায়গা ব্যবহারের সুযোগও রাখা যেতে পারে সবদিক বিবেচনা করে। আর যদি পার্ককে গাড়ি পার্কিংসহ অন্য কোনো ব্যবসায় লাগাতে হয় তাহলে জেলা প্রশাসন বৈধ উপায়ে তা করুক। হরিলুট হবে কেন? নিঃশব্দ আর্তনাদ! পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে বিড়ালের টানাহেঁচড়া, খুলে মিলল নবজাতক। এমন শিরোনাম দেখে চমকে উঠতে হয়। সম্প্রতি রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় ময়লার মধ্যে পড়ে থাকা পলিথিনের ব্যাগ থেকে জীবন্ত নবজাতককে উদ্ধার করা হয়েছে। ব্যাগটি নিয়ে একটি বিড়াল টানাহেঁচড়া করছিল। নবজাতকটি বেঁচে উঠুকÑ এটাই চাইবেন শুভ বোধসম্পন্ন মানুষরা। ঢাকা শহরে এ ধরনের ঘটনা ঘটে অনেক, যার সবগুলোই গণমাধ্যমে আসে না। ডাস্টবিনে কাপড়ে জড়ানো নবজাতকের লাশ পাওয়ার একটি সংবাদ এসেছিল কিছুকাল আগে। অনেক সময় দেহ শেয়াল কুকুরের খাদ্যও হয়। মনে আছে অনেকরই যে, রাজধানীর ভাটারায় একটি পারিবারিক গোরস্তান থেকে এক নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। লাশটি একটি গেঞ্জি দিয়ে মোড়ানো ছিল। নবজাতকটির হাত, নাক ও মুখের মাংস কুকুর বা অন্য কোন প্রাণীর পেটে যায়। এই নিষ্ঠুর রাজধানীতে কিছুকাল পরপরই আমরা এমন নবজাতক হত্যার খবর শুনি। গত বছর মানিক মিয়া এ্যাভিনিউ এলাকার ন্যাম ভবনের ৩ নম্বর গেটসংলগ্ন নর্দমার পাশ থেকে নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। সদ্য জন্মগ্রহণের চিহ্নসহ লাশটি ছিল একটি কাগজের কার্টনে। শিশুটি পৃথিবীতে কি মৃত হিসেবেই এসেছিল, নাকি জন্মের পর মারা গেছে? মারা গেছে, নাকি মেরে ফেলা হয়েছে! এমন আরও কিছু শ্রাব্য-অশ্রাব্য কথাবার্তা কি খুব অসঙ্গত বলে মনে হবে? প্রতিটি নতুন শিশুর জন্মগ্রহণের নেপথ্যে রয়েছে এক জোড়া মানব-মানবী। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হোক, তারা জনক-জননী। অথচ তাদের অনেকেই তাদের সন্তানের জন্মক্ষণেই পরিত্যাগ করেন, তার মৃত্যুই চান! নিজেদের রক্ষার জন্য নিজ সন্তানের মৃত্যু! কিসের রক্ষা? লোকলজ্জার ভয় থেকে? এই পৃথিবীতে যত প্রজাতির প্রাণী রয়েছে সেসবের মধ্যে একমাত্র মানুষের পক্ষেই সম্ভব সদ্যজাত সন্তানকে মৃত্যুপুরিতে নিক্ষেপ করা। একটি হায়েনা কিংবা একটি কুকুর বা কোন শকুন কি কখনও তার সদ্য জন্মগ্রহণকারী শাবকটিকে ছুড়ে ফেলে! ঢাকায় নর্দমায় বা গোরস্তানে নবজাতককে ফেলে দেয়ার বিষয়টিকে আমরা উপেক্ষা করে যেতে পারি না। এটি স্বার্থপর মানুষের এক অজ্ঞাত মানসিক অবস্থা, তার চূড়ান্ত বিকার। এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কী হতে পারে! যে নগরে বা যে সমাজে মানুষ তার সদ্য জন্ম নেয়া সন্তানকে অস্বীকার ও নোংরা ন্যাকড়ার মতো পরিত্যাগ করতে পারছে, সেই নগর বা সমাজেরও কি কোন দায়ভাগ নেই এতে? কালক্রমে সদ্যমৃতের তালিকায় উঠে যাচ্ছে মানুষের বিবেক, তার মনুষ্যত্ব। শহরের নিঃশব্দ আর্তনাদ নিষ্ঠুর ও ইঁদুরদৌড়ে ব্যতিব্যস্ত মানুষের কানে কি পৌঁছোয়? লালন ঘরানার পান্থজন বাসের মধ্যে আধুনিক বাউলজুটিকে দেখে আসছি এক বছরেরও বেশি সময় ধরে। ভেবেছিলাম তারা লালনের দেশ থেকে এই ‘সব সম্ভবের মহানগরী’তে এসেছেন মূলত কর্মসংস্থানের আশায়। হয়তো টিকতে পারবেন না বেশিদিন। তারপর আবার ফিরে যাবেন আখড়ায়। না, এমনটা হয়নি। বরং ওই দুই বাউল স্থায়ী হয়ে গেছেন ঢাকায়। এখন তাদের বেশ আত্মবিশ্বাসী এবং দৃঢ়চেতা বলে মনে হয়। জিন্সের প্যান্ট, ছোট করে ছাঁটা চুল। হাতের দোতরাটি না থাকলে গায়ক বলে মনে হতো না। খেয়াল করলে দেখা যায় পেছনে ছোট্ট ঝুটি রয়েছে। ছোট্ট ভূমিকা দিয়েই গান শুরু করেন। লালনগীতি। বাসযাত্রীরা ঘুরে তাকাতে বাধ্য হন, কেননা কানে পশার মতো সেই গান। দুখানা গান শেষ হলে সঙ্গী বাসযাত্রীদের উদ্দেশে বললেন, বাউলের গান ভাল লাগলে আপনারা পুরস্কৃত করতে পারেন। দশ টাকা নাকি শত টাকা- কে কত দিচ্ছেন সেদিকে ভ্রƒক্ষেপ করেন না বাউল, সমান সমীহভরে তা গ্রহণ করেন। পথেঘাটে লোকের সামনে সরাসরি হাতটা বাড়িয়ে না দিয়ে গানটান শুনিয়ে কিছুটা মনোরঞ্জন করে সাহায্য প্রার্থনা করা অতটা দোষের বলে মনে হয় না। যদিও বাসের ভেতর দোতারা বাজিয়ে গান শোনানোর মানুষ কালেভদ্রে মেলে। এর আগে যে বাউলের দেখা পেয়েছিলাম বাসের ভেতর তার ছিল লম্বা চুল, পোশাকে ভিন্নতা। বুঝতে দেরি হয়নি যে মানুষটির বসবাস সুরের জগতে। কিন্তু পার্থিব ভুবনের নিত্য প্রয়োজনও তাকে পূরণ করতে হয়। মুখ ফুটে টাকাপয়সা চাইতে নিশ্চয়ই তাদের সংকোচ হয়। কিন্তু না চাইলে যাত্রীরাও নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে টাকাপয়সা দেন না। ব্রিটেনের পথেঘাটে, যানবাহনে গিটার বাজিয়ে বহু লোক গান শোনান। এর একটা পোশাকি নাম আছে- বাস্কিং। এই বাস্কিংয়েরও প্রচলিত রীতিনীতি আছে, মুখ ফুটে কেউ অর্থ দাবি করেন না। সামনে থাকে খোলা টুপি। বিলেতে জন্মগ্রহণকারী এক মধ্যবয়সী সিলেটী বলছিলেন তার যৌবনের গল্প। বাবার চা বাগান থাকলে কী হবে, পাউন্ডের টানাটানি পড়লে তিনি গিটার নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়তেন। আন্ডারগ্রাউন্ড রেল স্টেশনের এক কোনায় দাঁড়িয়ে একের পর এক গান শোনাতেন। সেই আশির দশকে এভাবে তিনি ভালই রোজগার করতেন। বাসের ওই দুই বাউল-বন্ধুকে আমাদের ভাল লেগেছে আরেকটি কারণে। সেটি হলো অনেক বাসযাত্রীই লালন ছাড়া অন্য ধরনের গান শোনানোর আবদার করেন। কিন্তু তারা বিনয়ের সঙ্গে বলেন, শুধু লালনের গানই তারা গেয়ে থাকেন। এটা তাদের ব্রত বা দায়বদ্ধতা। তাই লালনের যে কোন গানের অনুরোধ করলে তারা সেই গানই শোনানোর চেষ্টা করবেন। অন্য গান নয়। ঢাকার পথে পথে লালনের গান শুনিয়েও যে জীবিকা নির্বাহ করা যায়, এই দুই লালনগীতির শিল্পী তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন। আবাসিক এলাকার ফুটপাথ রাজধানীর অনেক সড়কেরই এখন জরাজীর্ণ দশা। প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে কার্পেটিং উঠে গিয়ে এইসব সড়কে তৈরি হয়েছে অসংখ্য গর্ত। সময়মতো এসব গর্ত মেরামত না করার কারণে বাড়ছে জনদুর্ভোগ। আছে ফুটপাথ দখল করে রিকশাভ্যান রাখা কিংবা ভ্রাম্যমাণ দোকান গড়ে তুলবার দুর্ভোগও। সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা যায়, অতিবৃষ্টির কারণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ১৫৮ কিলোমিটার এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১০ হতে ১৫ শতাংশ সড়ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানি হলো বিটুমিনাস কার্পেটিংয়ের শত্রু। পানি জমে থাকলে এ ধরনের কার্পেটিং সহজে নষ্ট হয়ে রাস্তায় ভাঙন দেখা দেয়। তাই অর্থ ও জনদুর্ভোগ লাঘবে অনেকেই বিকল্প হিসেবে কংক্রিটের সড়ক নির্মাণের পরামর্শ দেন। যাহোক, আসি ফুটপাথ প্রসঙ্গে। সাধারণত মিডিয়ায় প্রধান সড়কের ফুটপাথ বেদখল হওয়া নিয়ে প্রতিবেদন থাকে। ফুটপাথ পথচারীদের চলাচলের জন্য হলেও সেখানে মোটর সাইকেলঅলারাও দাপুটে চলাচল করে থাকে। আর বিচিত্র সব পণ্যের পসরা নিয়ে বসে যান খুচরা বিক্রেতারা। তবে আবাসিক এলাকার ফুটপাথও যে বেদখল হয়ে যায় তার খবর আমরা খুব একটা রাখি না। এখন ফেসবুক-যুগে সেসব খবরও আমরা পাচ্ছি। গত সপ্তাহে উত্তরার ফুটপাথ দখল নিয়ে লিখেছেন এক এলাকাবাসী। তুলে দিচ্ছি: ‘হঠাৎ করেই দখল হয়ে গেল উত্তরা ৪ নাম্বার সেক্টরের ৫ নাম্বার রাস্তায় ওয়াসার পানির পাম্পের পাশের ফুটপাথ। গতকালও মানুষ হেঁটে গেছে এখান দিয়ে- কিন্তু আজ সকালে দেখা গেল ঘর। উত্তরার মতো একটা আবাসিক এলাকায়, যেখানে মানুষ সন্ধ্যায় পরিবার নিয়ে হাঁটে এইসব ফুটপাথে, সকালে-দুপুরে-বিকেলে আগা খান স্কুল, টার্কিশ হোপ স্কুল এবং আরও দু’একটা স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী-অভিভাবক-শিক্ষকরা যাতায়াত করে যে ফুটপাথ দিয়ে, সেটা রাতারাতি দখল করে কে বা কারা এই নাগরিক অধিকার কেড়ে নিল এবং কোন শক্তিতে, জানতে ইচ্ছে করছে। প্রক্রিয়াটি এখনও চলমান- আরও ঘর ওঠানোর জন্য খুঁটি গাড়া হয়েছে। কোন কর্তৃপক্ষ এটা লক্ষ্য করছে কি না বোঝার কোন উপায় কি আছে?’ ০৮ অক্টোবর ২০১৭ [email protected]
×