ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

মগের মুলুকের রোহিঙ্গারা

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ৫ অক্টোবর ২০১৭

মগের মুলুকের রোহিঙ্গারা

(গতকালের চতুরঙ্গ পাতার পর) ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমার সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারকে গণহত্যা বলে বিবেচনা করে। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট বিস্তারিত আলোচনার পর একই অবস্থান নেয় এবং এই সমস্যা সমাধানে মিয়ানমারের ওপর বাণিজ্য অবরোধ আরোপের প্রস্তাব দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিউইয়র্কে ১৯ সেপ্টেম্বর বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে আছে। এই সমস্যা সমাধানে ট্রাম্প নিরাপত্তা পরিষদকে আরও দৃঢ় ও দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের ত্রাণকল্পে ৫২ মিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়। ইসলামী সম্মেলন সংস্থা রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রতিবাদ জানায় এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থানকে পূর্ণাঙ্গভাবে সমর্থন করে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বান্তকরণে সমর্থন করেন এবং মিয়ানমার থেকে বিতারিত রোহিঙ্গাদের সর্বাত্মক ত্রাণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তুরস্কের প্রথম মহিলা (ফার্স্ট লেডি) প্রতীকী ত্রাণ নিয়ে কক্সবাজার সফর করেন এবং রোহিঙ্গাদের অনুকূলে তুর্কি জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থন জ্ঞাত করেন। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া মিয়ানমার কর্তৃক রোহিঙ্গা বিতারণের তীব্র নিন্দা করে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থানকে পূর্ণাঙ্গ সমর্থন জানায়। পরে আসিয়ান গোষ্ঠীর বার্ষিক সভায় রোহিঙ্গা বিপর্যয়ের যথার্থ নিন্দা ও নিরসন সূচক অবস্থান নিতে ব্যর্থ হওয়ায় মালয়েশিয়া সেই সভায় গৃহীতব্য যৌথ বিবৃতি স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানায়। মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত সচেতন বিশ্ববাসীর আন্তর্জাতিক গণআদালত রোহিঙ্গা নিধনকে গণহত্যা হিসেবে আখ্যায়িত করে এর হোতা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নেতাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে। এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অন্যান্য মানবিক সংস্থাসমূহ মিয়ানমার সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মম অত্যাচারকে গণহত্যামূলক অপরাধ হিসেবে নিন্দা করে এবং এই মর্মান্তিক পরিস্থিতির দ্রুততম উপশম দাবি করে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো একইভাবে রোহিঙ্গাদের অত্যাচারকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করে মিয়ানমার সরকারকে তা সত্বর সমাধানের আহ্বান জানান। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা সমস্যার ওপর সর্বসম্মতভাবে প্রস্তাব গ্রহণ করার পরও চীন ও রাশিয়া (রাশিয়া ও চীন নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য) জোরালোভাবে রোহিঙ্গা নিধনের জন্য মিয়ানমার সরকাকে প্রত্যক্ষভাবে দায়ী না করে কূটনৈতিকভাবে এর সত্বর সমাধানের ওপর জোর দেয়। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ গ্র্যান্ডি কক্সবাজার এলাকা ঘুরে এসে ঢাকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব পুনর্প্রতিষ্ঠিত করে মিয়ানমার সরকারকে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে বলে ঘোষণা করেন। এর আগে মিয়ানমার সরকার কর্তৃক নিযুক্ত জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশন রাখাইন রাজ্যের উন্নয়নের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব মিয়ানমার সরকার কর্তৃক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করাকে রোহিঙ্গা সমস্যার ফলপ্রসূ স্থায়ী সমাধান হিসেবে শনাক্ত করেন। জাতিসংঘের প্রাক্কলন অনুযায়ী, ৬ মাস পর্যন্ত বাস্তুত্যাগী ও বাংলাদেশে শরণার্থী রোহিঙ্গাদের ত্রাণ দেয়ার জন্য প্রয়োজন হবে ২৫০ মিলিয়ন ডলার। এই প্রয়োজন ভালভাবে নিরিখ করে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংককে শরণার্থী রোহিঙ্গাদের ২৫০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। বলা হয়েছে যে, এই সহায়তার একটি বড় অংশ শরণার্থী রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য, অস্থায়ী আশ্রয়স্থল ও স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার জন্য ব্যয় করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, আরাকান রোহিঙ্গা মুক্তি বাহিনীর (আরসার) সন্ত্রাসবাদকে বাংলাদেশ কখনই সমর্থন করবে না। তথাপি দেশের নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের মতে, পাকিস্তান সমর্থিত আরসার মাধ্যমে শরণার্থী রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে এদেশে সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্ররোচিত ও বিস্তৃত করার আশঙ্কা বিদ্যমান। গত ২২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের জাতীয় সংসদে গৃহীত অবস্থান অনুযায়ী রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ৫টি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তার উত্থাপিত প্রস্তাবের মধ্যে মিয়ানমার সরকার কর্তৃক অত্যাচার ও গণহত্যা বন্ধকরণ, রাখাইন রাজ্যে সকল বেসামরিক জনগণকে প্রতিরক্ষণের লক্ষ্যে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নিরাপদ বলয় সৃষ্টিকরণ, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কোফি আনান কমিশন কর্তৃক প্রণীত সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া সকল রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতিসহ সে মিয়ানমারে তাদের আগের বাসস্থানে ফিরিয়ে নেয়া। তিনি জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রকে এসব দাবি সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে যথাযথভাবে আদায় ও বাস্তবায়নের জন্য আহ্বান জানান। মানবতা প্রসূত তার এই প্রস্তাব বিশ্বের সকল শান্তিকামী সচেতন দেশে সাড়া যুগিয়েছে ও সমর্থন অর্জন করেছে। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও গণহত্যার অভিযোগের বিপরীতে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের প্রধান নীতিনির্ধারক আউং সান সুচি ১৯ সেপ্টেম্বর তাদের সংসদে এক ভাষণে দাবি করেছেন যে, রাখাইনে সহিংসতা বন্ধ করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এবং মিয়ানমার সরকার সেখান থেকে কেন রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন তার কারণ শনাক্ত করছেন। তিনি বলেছেন বাংলাদেশে অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক কিনা তা যাচাই-বাছাইয়ের পর তাদেরকে তারা ফেরত নেবেন। তার এই দায় এড়ানো বক্তব্য মানবতা সচেতন সকল বিশ্ববাসীকে হতাশ করেছে। সুচির মিথ্যাচারী বক্তব্য তেমনি অনুরণন করে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রতিফলিত করেছেন সে দেশের উপরাষ্ট্রপতি হেনরি ভ্যান থিও। মিয়ানমারের এই দুই নেতা তাদের নির্লজ্জ মিথ্যাচারের প্রতিকূলে উপগ্রহের মাধ্যমে ধারণকৃত রাখাইন এলাকার অত্যাচার ও জননিধনের নিশানা পূর্ণ মাত্রায় অবজ্ঞা এবং এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত সংবাদদাতাদের প্রতিবেদনসমূহকে অবজ্ঞা করেছেন। সুচির মিথ্যাচারের প্রতিবাদে এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তার অবস্থানকে বালিতে চোখ ঢুকিয়ে বাস্তবতাকে অস্বীকার করার নামান্তর হিসেবে উল্লেখ করেছে। সুচি ও তার উপরাষ্ট্রপতির মিথ্যা তথ্যে ভরপুর বক্তব্যের সবচাইতে দায় এড়ানো অংশ হলো যে, তারা কেবলমাত্র তাদের দেশ থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় লাভকারী উদ্বাস্তু নাগরিকদেরকে যাচাই-বাছাইয়ের পর মিয়ানমারে ফেরত নেবেন বলে বলেছেন। গভীর উদ্বেগ ও হতাশার সঙ্গে বিশ্ববাসী লক্ষ্য করেছে যে, মিয়ানমারের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী যেখানে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বই স্বীকার করা হয়নি সেখানে তাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে শনাক্ত করে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি সর্বাংশে নির্মম মুনাফিকির নামান্তর। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের মিথ্যাচারী ও অমানবিক অবস্থান ১৯৪৮ সালের বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের ঘোষণার প্রেক্ষিতে প্রত্যাখানীয়। এই ঘোষণাপত্রের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে পৃথিবীব্যাপী সকল মানুষের জীবন, স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তার অলঙ্ঘনীয় অধিকার রয়েছে। ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে কারও ওপর অত্যাচার বা নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অসম্মানজনক আচরণ বা শাস্তি আরোপ করা যাবে না। ১৫ আনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে প্রতিটি মানুষের জাতীয়তার (তথা রাষ্ট্রের নাগরিকত্বের) অধিকার আছে এবং কাউকেই স্বেচ্ছাচারিতার ভিত্তিতে তার জাতীয়তা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এবং ১৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে প্রতিটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে প্রতিজনের আবাস স্থাপন ও রক্ষাকরণের অধিকার রয়েছে। এর পরে ১৯৬৬ সালে জাতিসংঘের আওতায় সুশীল ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি বা কভেনেন্টে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার ঘোষণার অনুরণন করে বলা হয়েছে যে প্রতিটি শিশুর একটি জাতীয়তা (তথা রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব) অর্জন করার অধিকার আছে (অনুচ্ছেদ-২৪)। ঘোষণা করা হয়েছে যে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, রাজনৈতিক মতাদর্শ, জাতীয় বা সামাজিক উৎসারণ নির্বিশেষে সকলকে সমান আইনী প্রতিরক্ষণ দিতে হবে (অনুচ্ছেদ-২৬)। সুস্পষ্টভাবে এও বলা হয়েছে যে প্রত্যেক মানুষের সহজাত জীবনের অধিকার আছে এবং কাউকেই তার জীবন থেকে স্বেচ্ছাচারীভাবে বঞ্চিত করা যাবে না (অনুচ্ছেদ-৬)। এ সূত্রের বিস্তারণে বলা হয়েছে যে কাউকেই অত্যাচার, নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অপমানজনক আচরণের আওতায় আনা যাবে না (অনুচ্ছেদ-৭)। ঘোষণা করা হয়েছে যে প্রত্যেক মানুষের স্বাধীনতা ও ব্যক্তি-নিরাপত্তার অধিকার আছে (অনুচ্ছেদ-৯)। এও সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যেসব রাষ্ট্রে নৃতাত্ত্বিক, ধর্মীয় ও ভাষাভিত্তিক সংখ্যালঘিষ্ঠ জনগণ বিদ্যমান সেসব রাষ্ট্রে তাদের এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না (অনুচ্ছেদ-২১)। বাংলাদেশের সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মৌল নীতি হিসেবে ঘোষিত হয়েছে যে প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার বাংলাদেশ সমর্থন করবে (অনুচ্ছেদ- ২৫)। এ বলার অপেক্ষা রাখে না যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের প্রতি যে অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে এবং এভাবে চালিয়ে যাওয়ার ভিত্তি হিসেবে তাদের যেভাবে জাতীয়তা বা নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করেছে তা বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার ঘোষণা এবং সে ঘোষণা অনুসৃত ১৯৬৬ সালের সুশীল ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তির ঘৃণ্যতম লঙ্ঘন। জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রকে অলঙ্ঘনীয় মানবিক অধিকারের এই রূপ নিষ্ঠুর ও প্রকাশ্য লঙ্ঘনের প্রতিবাদ জানাতে হবে। এবং যে রাষ্ট্র বা কর্তৃপক্ষ এর জন্য দায়ী বিবেচিত হবে তাকে দেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত বিচারালয়ে অভিযুক্ত করতে হবে। এলক্ষ্যে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে পূর্ণাঙ্গ অভিযোগ দায়ের ও সাক্ষ্য-প্রমাণাদি সংগ্রহের কাজে এখনই হাতে নিতে হবে। এই প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আইনজ্ঞ হিসেবে স্বীকৃত ৫ সদস্যের একটি টিম বা দল আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক সত্বর গঠন করা লক্ষ্যানুগ হবে। এর বাইরে যুগপৎভাবে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয়প্রাপ্ত রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন দেশে অভিবাসনের সুযোগ দেয়া জাতিসংঘ কর্তৃক বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার বলবৎকরণ এবং তারই অংশ হিসেবে ১৯৬৬ সালে গৃহীত সুশীল ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তির অনুগামী পদক্ষেপ বলে জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে সকলকে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। উদাহরণত বাংলাদেশে আশ্রয়প্রাপ্ত রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১ লাখ, কানাডাতে ১ লাখ, অস্ট্রেলিয়াতে ৫০ হাজার, মালয়েশিয়ায় ৫০ হাজার, জার্মানিতে ৪০ হাজার, ফিনল্যান্ডে ২০ হাজার, সুইজারল্যান্ডে ২০ হাজার, নরওয়েতে ২০ হাজার, সৌদি আরবে ৫০ হাজার, ফ্রান্সে ৩০ হাজার, আইসল্যান্ডে ১০ হাজার, ব্রাজিলে ১০ হাজার রোহিঙ্গাকে পাঠানোর জন্য যথাযথ ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা কর্তৃক গ্রহণ করা সঙ্গত হবে। এই লক্ষ্যে জাতিসংঘের শরণার্থী সম্পর্কিত হাইকমিশন নিরাপত্তা কাউন্সিলের তরফ থেকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার সঙ্গে একযোগে কাজ করতে পারে। বলাবাহুল্য মোটা দাগে উপরোক্ত সংখ্যক রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন দেশে অভিবাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ বহুপাক্ষিক ও দ্বিপাক্ষিক আলোচনার প্রস্তাব দিতে পারে। এরূপ প্রস্তাব উত্থাপিত হলে এসব দেশ থেকেও বাংলাদেশে আশ্রয়প্রাপ্ত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাবি অধিকতর জোরালো হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আমাদের জাতীয় সংসদ ও অন্যান্য পর্যায়ের আলোচনার ভিত্তিতে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাব অনুযায়ী নি¤েœ উল্লেখিত পদক্ষেপগুলো একক ও সমষ্টিগতভাবে নিতে হবে বলে প্রতিভাত হয়: (১) বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া সকল রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে মিয়ানমার সরকার কর্তৃক তাদেরকে মিয়ানমারে বা রাখাইন রাজ্যে ফিরিয়ে নিতে হবে; (২) রাখাইন রাজ্যে গণহত্যাসম যে অত্যাচার, নিপীড়ন, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দ্বিধাহীনভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর করে যাচ্ছে তা এখনই বন্ধ করতে হবে; (৩) রাখাইনে কৃত অমানবিক অত্যাচার ও গণহত্যার জন্য মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সংশ্লিষ্ট অধিনায়ক ও অন্যান্য অফিসার ও সেনাদের আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে বিচারে সোপর্দ করতে হবে; (৪) রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ক্ষতিপূরণসহ পুনর্বাসনের জন্য মিয়ানমার সরকার কর্তৃক যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; এই লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কর্তৃক সহায়তা প্রদান লক্ষ্যানুগ হবে; (৫) মিয়ানমার সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের ওপর কৃত অত্যাচার, অবিচার, লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ ও সদস্য দেশ কর্তৃক প্রতিবাদ জানিয়ে যেতে হবে; (৬) মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে যে সব দেশ অস্ত্র সরবরাহ করেছে সে সব দেশ কর্তৃক তাদেরকে অধিকতর অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে হবে; (৭) মিয়ানমারের রাখাইন এলাকায় সুষ্ঠু পুনর্বাসনের জন্য এবং সকলকে মানবিক নিরাপত্তা প্রদানের লক্ষ্যে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সেখানে নিরাপদ এলাকা প্রতিষ্ঠিত ও প্রশাসিত করতে হবে; (৮) যতদিন পর্যন্ত এ নির্যাতন ও গণহত্যা বন্ধ না হয় ততদিন পর্যন্ত মিয়ানমারের প্রতিকূলে বাণিজ্য অবরোধ আরোপ করতে হবে; (৯) উপরোক্ত সকল পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিল কর্তৃক যথাপ্রয়োজন প্রত্যক্ষ পদক্ষেপ নিতে হবে; প্রয়োজনে রাখাইনের নিরাপদ এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলা ও মানবাধিকার রক্ষা করার জন্য আন্তর্জাতিক পুলিশ বাহিনী পাঠাতে হবে; এবং (১০) রাখাইন রাজ্যে ১৯৬২ থেকে এখন পর্যন্ত বসবাসরত সকল নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী ও জনগণকে মিয়ানমারের পূর্ণ নাগরিকত্ব ও মিয়ানমার সংসদে প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার দিতে হবে। এই লক্ষ্যে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনান কর্তৃক প্রণীত সুপারিশসমূহ পূর্ণাঙ্গ ও সময়বদ্ধভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। উপরোক্ত পদক্ষেপসমূহ নেয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশকে সারথির ভূমিকায় থাকতে হবে। এই ভূমিকা সফল করতে হলে প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক তৎপরতার সঙ্গে দেশের সকল রাজনৈতিক দলকে একনিষ্ঠভাবে এবং পূর্ণাঙ্গ আনুগত্যের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সমর্থন করা প্রত্যাশিত। মানবতাবিরোধী অপরাধ ও হত্যাযজ্ঞ বন্ধকরণের লক্ষ্যে আমাদের সংবিধানে প্রদত্ত রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য গৃহীত আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা, সংহতি উন্নয়ন ও প্রসারণকল্পে যে মৌল নীতি গ্রহণ করা হয়েছে তা অনুসরণ করে একনিষ্ঠভাবে দেশের প্রতি আনুগত্যবোধ ও মানবতা বোধকে আশ্রয় করে এগিয়ে যাওয়া হবে দেশের সকল নাগরিকদের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। (সমাপ্ত) লেখক : সাবেক সচিব ও মন্ত্রী
×