ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

১৫০ দেশের ৩০০ কোটি মানুষ ব্যবহার করছে পাম অয়েল

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

১৫০ দেশের ৩০০ কোটি মানুষ ব্যবহার করছে পাম অয়েল

কাওসার রহমান ॥ শতবর্ষে পা রাখা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ভোজ্যতেল পাম অয়েল। আফ্রিক থেকে কুড়িয়ে পাওয়া অয়েল পাম গাছ থেকে উৎপাদিত পাম তেল এই ১০০ বছরে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভোজ্যতেলে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশেও সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভোজ্যতেল এখন পাম অয়েল। তবে পাম তেলের এই ১০০ বছরের জার্নি সুখকর ছিল না। এই ১০০ বছরে ভোজ্যতেলের বাজারে শীর্ষে উঠে আসতে পাম তেলকে নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে হয়েছে। সেই প্রতিকূলতা অতিক্রম করেই বিশ্বের ১৭টি তেল ও চর্বির মধ্যে পাম তেল আজ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের ১৫০টি দেশের প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ ব্যবহার করছে ভিটামিন-ই সমৃদ্ধ এই ভোজ্যতেল। বর্তমানে প্রতি ১০টি খাদ্য পণ্যের মধ্যে একটিতে পাম তেলের উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। এই তেল খাদ্য ও খাদ্য-বহির্ভূত উভয় পণ্য তৈরিতেই ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশেও এক সময় ভোজ্যতেলের বাজারটি দখলে রেখেছেল দেশে উৎপাদিত সরিষার তেল। ক্রমান্বয়ে চাহিদা বৃদ্ধি এবং উৎপাদন হ্রাসের কারণে সেই স্থান দখল করে নেয় সয়াবিন তেল। আশির দশক থেকে সেই স্থানে ভাগ বসায় পাম তেল। দেশে পরিশোধন ব্যবস্থা চালুর পর দ্রুত বাড়তে থেকে পাম তেলের চাহিদা। ফলে ২০০৩ সালে এসে পাম তেল দেশের অন্যতম প্রধান ভোজ্যতেলের স্থান দখল করে নেয়। ২০১১ সালে দেশে পাম তেলের আমদানি বেড়ে দাঁড়ায় ৯ লাখ ৯১ হাজার টনে, যা মোট ভোজ্যতেল ও চর্বির প্রায় ৬৬ ভাগ। অন্যদিকে ২০১১ সালে দেশে সয়াবিন তেল ও সরিষার তেলের ব্যবহার ছিল যথাক্রমে ২৬ ভাগ ও ৮ ভাগ। ২০১৪ সালে দেশে রেকর্ড পরিমাণ ১৯ লাখ ৪৬ হাজার টন ভোজ্যতেল আমদানি হয়। এই আমদানির ৬৫ শতাংশই ছিল পাম তেল, বাকিটা সয়াবিন, সরিষা ও অন্যান্য তেল। মূলত, সয়াবিনের চেয়ে দাম কম থাকায় দেশে পাম তেলের চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। অয়েল পাম একটি পশ্চিম আফ্রিকান দেশীয় উদ্ভিদ যা এঙ্গোলা, গাম্বিয়া এবং এর মধ্যবর্তী এলাকায় দেখা যায়। প্রায় ৫ হাজার বছর আগে থেকে অয়েল পাম গাছ আবিষ্কার হলেও, ১৮৪৮ সালে ইন্দোনেশিয়ার বগর বোটানিক্যাল গার্ডেনে এই উদ্ভিদের চারা রোপণ করার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর সূচনা ঘটে। ১৮৭০-এর দশকে তৎকালীন মালয় প্রথম অয়েল পাম উদ্ভিদটি হাতে পায়। ইংল্যান্ডের কিউয়ে অবস্থিত রাজকীয় বোটানিক্যাল গার্ডেন থেকে উদ্ভিদটি এনে সিঙ্গাপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেনে রোপণ করা হয়। ওই সময় এটি শোভাবর্ধক গাছ হিসেবে প্রধান সড়কের পাশে, সরকারী দালানের সম্মুখে এবং পাবলিক পার্কসমূহে ব্যবহার হতো। উনিশ শতকে ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের সময় একজন ফরাসী যুবক হেনরি ফোকনারসহ আরও অনেক অল্প বয়সী উদ্যোক্তাদের তাদের ভাগ্য গড়ার জন্য দূর প্রাচ্যে ভ্রমণে উৎসাহ যোগায়। ১৯০৫ সালে ফোকনার মালয় দেশে আগমন করেন এবং বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে স্যালাঙ্গরের রন্তু পাঞ্জান এলাকায় একটি কফি বাগান প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১১ সালে তিনি সুমাত্রার ডেলী এলাকায় এনড্রেইন হালেটের অয়েল পাম উন্নয়ন কেন্দ্র পরিদর্শন করেন এবং উদ্ভিদটি দেখে অভিভূত হয়ে হ্যালেট থেকে কিছু অয়েল পাম চারা ক্রয় করে তার নিজ এস্টেটে গবেষণার জন্য নিয়ে আসেন। ১৯১২ সালে রাবার এবং কফির দাম পড়ে যেতে থাকলে তিনি সুমাত্রা হতে সংগৃহীত পাম বীজ সংগ্রহের মাধ্যমে ১৯১৭ সালে স্যালাঙ্গরের বার্জুন্টাই-এর বাতাং-এর তেন্নামারান এস্টেটে রোপণ করেন। এভাবে মালয়েশিয়ায় বাণিজ্যিকভাবে অয়েল পাম এস্টেট শিল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। ১৯৫৭ সালে মালয়েশিয়া স্বাধীনতা লাভের পর দেশটির সরকার অর্থনৈতিক সম্পদসমূহকে জনগণের মধ্যে পুনঃবণ্টন করা নিয়ে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। কারণ শহরবাসীদের উন্নত মানসম্পন্ন জীবন ব্যবস্থার বিপরীতে তখন গ্রামীণ এলাকায় ছিল প্রচ- দরিদ্রতা। এ সময় ধনী-দরিদ্র্যের মধ্যে ব্যবধান হ্রাস এবং গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের জীবন মান উন্নয়নের জন্য কৃষি সম্প্রসারণকে প্রধান অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনায় নেয়া হয়। এই কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার ‘ভূমিহীনদের ভূমি এবং চাকরিহীনদের চাকরি’ প্রদান করার নীতি গ্রহণ করে। প্রাথমিকভাবে ক্ষুদ্র চাষী জমি উন্নয়ন স্কিম রাবার উৎপাদনের মনোযোগী হয়। কিন্তু এর উন্নয়ন খুবই ধীরগতির এবং রাবারের দাম ছিল নিম্নগামী হওয়ায় দ্রুত শস্য বহুমুখীকরণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় ১৯৬১ সালে প্রত্যেক বসতকারী ৮ একর অয়েল পাম উদ্ভিদ রোপণকৃত জমি, ২ একর সাহায্যকারী উদ্ভিদ ও সাধারণত ফলের গাছ এবং এক-চতুর্থাংশ একর জমির ওপর একটি বাড়ি লাভ করে। ১৯৯০ সালে মোট ১,১২,৬৩৫ জন গ্রামীণ দরিদ্র মানুষ, যাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ ছিল অয়েল পামের ওপর নির্ভরশীল। ১৯৮১ সালের পূর্বে মালয়েশিয়াতে পাম গাছে পাম ফলের থোকার পরিমাণ ছিল খুব কম। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য হাত দ্বারা পরাগায়ন ঘটানোর প্রয়োজন হতো, কিন্তু এটা ছিল অনেক কষ্টসাধ্য এবং ব্যয়বহুল। এ কাজে এলাইডোবিয়াস ক্যামেরুনিকাস বা উইভিল পোকার প্রয়োগ ঘটানো হয়। এটি একটি পরাগায়নকারী পোকা, যা মালয়েশিয়ার পাম তেল শিল্পের একটি নতুন পরিবর্তনের সূচনা। বাগানে উইভিল পোকার ব্যবহার হেক্টরপ্রতি অয়েল পাম গাছের ফল উৎপাদনে নাটকীয়ভাবে উন্নতি সাধন করে। এক বছর পর পাম তেল ও পাম কার্নেলের উৎপাদন বৃদ্ধি মালয়েশিয়াতে যথাক্রমে ৪ লাখ টন এবং ৩ লাখ টন রেকর্ড করা হয়। এরপর থেকে পাম তেল এবং পাম কার্নেলের উৎপাদন বাড়তে শুরু করে এবং উইভিল পোকার দ্বারা পরাগায়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে পরাগায়ন খাতে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত ব্যয় সাশ্রয় হয়েছে। পাম তেলকে হাইড্রোজেনেটেড উদ্ভিজ্য তেলের আংশিক বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি মানব দেহের জন্য পুষ্টিকর ও উপাদেয় উপাদান হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা দ্বারা স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। এটা বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় উদ্ভিজ্য তেল, যা বাংলাদেশসহ ১৫০টিরও অধিক দেশে ৩০০ কোটিরও বেশি জনগণ ব্যবহার করছেন। একটি চমকপ্রদ তথ্য হলো, বিশ্বে সবচেয়ে কম জমি ব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয় পাম তেল। বিশ্বে মোট ২৫ কোটি ৮৯ লাখ হেক্টর জমিতে ভোজ্যতেল চাষ হয়। এর মধ্যে সয়াবিন তেল উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় ৪০ শতাংশ জমি, কটনসীড উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় প্রায় ১৪ শতাংশ জমি, সূর্যমুখী তেল উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় ১০ শতাংশ জমি, সরিষা উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় প্রায় ১৩ শতাংশ জমি এবং পাম তেল উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় মাত্র ৫.৫ শতাংশ জমি। আরও আশ্চর্যজনক তথ্য হলো, ১ টন সয়াবিন তেল উৎপাদনে যেখানে ২.২২ হেক্টর জমির প্রয়োজন, সেখানে পাম তেল উৎপাদনে প্রয়োজন মাত্র দশমিক ২৬ হেক্টর জমি। এছাড়া ১ টন সরিষার তেল উৎপাদনে প্রয়োজন ১.৫২ হেক্টর এবং সুর্যমুখী তেল উৎপাদনে প্রয়োজন ২ হেক্টর জমি। বিশ্বে প্রতিবছর ভোজ্যতেলের যোগান আসে ১৮ কোটি ৬৪ লাখ টন। এর মধ্যে ৩২ শতাংশ পাম তেল, ১৩ শতাংশ সয়াবিন তেল, ৮ শতাংশ সূর্যমুখী তেল, ৩ শতাংশ কটনসীড তেল এবং ২.২ শতাংশ বাদাম তেল। এছাড়া অন্যান্য তেলের যোগান আসে ১৯ শতাংশ। ভেজিটেবল তেল উৎপাদনেও পাম তেল এগিয়ে। বিশ্বেব মোট উৎপাদিত ভেজিটেবল তেলের মধ্যে পাম তেল হচ্ছে ৫৩.৬৭ শতাংশ, সয়াবিন তেল ৪১.৬৬ শতাংশ, সরিষার তেল ২৮.৪৮ শতাংশ, সূর্যমুখী তেল ১৪.৮০ শতাংশ এবং পাম কার্নেল ৫.৯২ শতাংশ। এছাড়া বাদাম তেল ৪ শতাংশ, কটনসীড তেল ৫ শতাংশ, অলিভ তেল ৩.৩৬ শতাংশ এবং নারকেল তেলের অংশ হচ্ছে ৩.২৪ শতাংশ। বিশ্বে মোট তেল বাণিজ্যের ৩২ শতাশই পাম তেলের দখলে, যার ৮৫ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া। অন্যদিকে বিশ্বে প্রতিবছর ১৮ কোটি ৩৬ লাখ টন ভোজ্যতেল ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে ৫৬ শতাংশই পাম তেল। আবার বিশ্বে মোট উৎপাদিত পাম তেলের মধ্যে ৪১ শতাংশ মালয়েশিয়া এবং ৪৬ শতাংশ ইন্দোনেশিয়া উৎপাদন করে। উল্লেখ্য, ২০১৬ সনে মালয়েশিয়া প্রায় ১ কোটি ৯৩ লাখ টন পাম ও পাম কার্নেল তেল উৎপাদন করে এবং প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ টন রফতানি করে। প্রধান আমদানিকারক দেশগুলো হলোÑ ভারত, চীন, নেদারল্যান্ডস, পাকিস্তান, তুরস্ক, ফিলিপাইন্স, যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম, জাপান এবং ইতালি। বিশ্বের পাম তেলের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। প্রতিবছর গড়ে এই বৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ। ১৯৯৭ সালে যেখানে এক কোটি ৭৭ লাখ টন পাম তেলের চাহিদা ছিল, সেখানে ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ কোটি ২১ লাখ টনে। ২০২০ সালে এই চাহিদা ৬ কোটি ৮০ লাখ টনে বেড়ে দাঁড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে। পাম তেলের সবচেয়ে বড় ভোক্তা হচ্ছে ভারত। দেশটি প্রতিবছর প্রায় ৭৬ লাখ টন পাম তেল ব্যবহার করে। এরপর চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবস্থান। উভয়ে প্রতিবছর প্রায় ৬১ লাখ টন করে পাম তেল ব্যবহার করে।
×