ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নথি ও মালামাল হারিয়ে যাচ্ছে ;###;ঠিকমতো পৌঁছায় না ডাক ;###;ক্ষতিপূরণ না পাওয়ার অভিযোগ

কুরিয়ার সার্ভিসে নেই নজরদারি, গ্রাহক ভোগান্তি বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৮ জুলাই ২০১৭

কুরিয়ার সার্ভিসে নেই নজরদারি, গ্রাহক ভোগান্তি বাড়ছে

এমদাদুল হক তুহিন ॥ ‘প্রথম সারির একটি কুরিয়ার সার্ভিসে জলছবি ম্যাগাজিনের ২০ টি পার্সেল পাঠাই। এর মধ্যে ৫ থেকে ৬ টি পার্সেলই মিসিং (লাপাত্তা)। তাদের কল করে বার বার তাগাদা দিয়েও লাভ হয়নি। এ কারণে দেশের কুরিয়ার সেবার প্রতি আমার কোন ভরসা নেই।’ কথাগুলো বলছিলেন লেখক ও প্রকাশক নাসির উদ্দীন কাবুল। একই ধরনের কথা বলেন ব্যাংকার কাজী ফাতেমা ছবি। তিনি বলেন, কুরিয়ারে বই পাঠানোর ক্ষেত্রে আমার বহু বই প্রাপকের ঠিকানায় পৌঁছেনি। আবার বইগুলো ফেরতও পাইনি। কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবহার করে দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে গুরুত্বপূর্ণ নথি বা মালামাল পাঠানো হলে এভাবেই খোয়া যাচ্ছে। শুধু বই নয়, কখনও কখনও হারিয়ে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ সার্টিফিকেটও। বহু চেষ্টা করে তা উদ্ধার করা সম্ভব হলেও মালামাল হারিয়ে গেলে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না গ্রাহক। সরকারী ডাক বিভাগ ছেড়ে যে কারণে গ্রাহক ঝুঁকেছে কুরিয়ারে, সেই কুরিয়ারের সেবাও মান্ধাতা আমলের। কেবল ঠিকসময়ে যথাস্থানে মালামাল না পৌঁছানোর অভিযোগই নয়, প্রাপকের পার্সেল কুরিয়ারে চলে আসার পরও যথাসময়ে তা প্রাপককে নিশ্চিত না করার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি গ্রাহক একাধিকবার কল করেও সেবাদাতা কর্মচারীদের কাছ থেকে তা নিশ্চিত হতে পারেন না। মালামাল পাঠানো সত্ত্বেও কল না আসার কারণে সেবা গ্রহীতাকে যেতে হয় কুরিয়ার অফিসে! তবে, সময় এখন গুরুত্বপূর্ণ। মিনিটের কাটা ধরে চলেন কেউ কেউ। শহরগুলোতে রয়েছে যানজট। অগ্রগতিতে দেশ হয়েছে ডিজিটাল। এই ডিজিটাল যুগেও প্রযুক্তিবান্ধব হয়ে উঠতে পারেনি কুরিয়ার সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের ছোট্ট অফিস ঘর মানুষের ভিড়ে ঠাসা হলেও সেবাদাতারা প্রযুক্তিবান্ধব নয়! বরং কুরিয়ার সেবা কোন কোন ক্ষেত্রে ডাক বিভাগের চেয়েও পিছিয়ে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনের আওতায় না আনায় সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে নেই নিয়মনীতির তোয়াক্কা। আর সরকারী বা প্রাতিষ্ঠানিক কড়া নজরদারি না থাকায় ক্রমেই বাড়ছে গ্রাহক ভোগান্তি। গত ১১ জুন সুন্দরবন কুরিয়ারে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট থেকে ঢাকায় আম পাঠান মোঃ কামরান। ঢাকার শ্যামলী অফিসে পাঠানো ৪ টি পার্সেলের মধ্যে ৩ টি পার্সেল প্রাপক পেয়ে গেলেও বাকি একটি পার্সেলের ক্ষেত্রে প্রাপককে মেসেজ কিংবা কল করে জানানো হয়নি। আর প্রাপক (০১৬৭৬৫১...) শ্যামলী অফিসে বার বার কল করেও তা নিশ্চিত হতে পারেননি। বরং তাকে যেতে হয়েছে শ্যামলী অফিসে। অবশ্য সেখান থেকে তিনি তার ঠিকানায় আসা আম সংগ্রহ করতে পেরেছেন। একই ধরনের বিড়ম্বনার শিকার অর্থনীতির শিক্ষক তা. শা. শামীম সিদ্দিকী বলেন, কুরিয়ার সার্ভিসে হোম ডেলিভারির ক্ষেত্রে সবসময় একটা গড়িমসি ভাব লক্ষ্য করা যায়। এ ধরনের সেবা ওরা দিতে চায় যখন পার্সেলের ওজন বেশি থাকে। আর ডেলিভারির ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ একটি সাধারণ ঘটনা। পার্সেল বা নথি হারিয়ে গেলে তার সমমূল্যের জরিমানা পাওয়া যায় না জানিয়ে ইশতিয়াক হোসাইন নামের এক গ্রাহক বলেন, ‘এস এ পরিবহনের কুরিয়ারে একটি পার্সেল পাঠালে তা হারিয়ে যায়। অভিযোগ করার পর পাঁচ-ছয়বার ঘুরিয়ে তারা ক্ষতিপূরণ দেয় মাত্র ৫০০ টাকা। অথচ ওই প্যাকেটে ২ হাজার টাকার মালামাল ছিল!’ করতোয়া কুরিয়ারের সেবা প্রসঙ্গে সাইফুর রহমান বাদশা বলেন, ঠাকুরগাঁও থেকে করতোয়া কুরিয়ার সার্ভিসে ঢাকায় একটা পার্সেল বা ডকুমেন্ট পাঠাতে ৩ থেকে ৪ দিন লেগে যায়। আর আম বা লিচু পাঠালে পচে যায়। অথচ ওরা ক্ষতিপূরণ দেয় না। দেশের কুরিয়ারের সেবা প্রসঙ্গে কথা হলে গণমাধ্যম কর্মী ফরহাদ হোসাইন বলেন, কুরিয়ার সার্ভিসের সেবার মান নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। যে কারণে মানুষ সরকারী ডাক বিভাগ ছেড়ে কুরিয়ারমুখী হয়েছিল, কিছু ক্ষেত্রে এখন কুরিয়ার সার্ভিস সেই ডাক বিভাগের মতো হয়ে গেছে। যূথিকা নামের এক তরুণী বলেন, কুরিয়ারগুলো ডেলিভারি দেয়ার ক্ষেত্রে সাধারণত ঝামেলা করে। একদিনের জায়গায় এক সপ্তাহও লাগে। আর গ্রামাঞ্চলে বুকিং কাউন্টারে ডেলিভারি দেয় না। যেতে হয় আরেক জায়গায়। গ্রামীণ ফোনে কর্মরত অপ্সরা জুহি বলেন, সুন্দরবন কুরিয়ারের সেবার মান যথেষ্ট খারাপ। ময়মনসিংহের বাসিন্দা আব্দুল করিম বলেন, সুন্দরবন মন্দের ভাল। ইসরাত জাকিয়া তাসনিম বলেন, কুরিয়ারে পার্সেল পাঠানোর ক্ষেত্রে রয়েছে খুবই বাজে অভিজ্ঞতা। এক প্রশ্নের জবাবে কন্টিনেন্টাল কুরিয়ার সার্ভিসের মহাব্যবস্থাপক উত্তম কুমার গুপ্ত জনকণ্ঠকে বলেন, কন্টিনেন্টাল উপজেলা পর্যায়েও এখন সেবা দিয়ে যাচ্ছে। উপজেলায় পার্সেল পাঠাতে কখনও কখনও ৩ দিন লেগে যায়। তবে জেলা পর্যায়ে ১ দিনেই আমরা যে কোন পণ্য পৌঁছে দিচ্ছি। তবে সমস্যার ক্ষেত্রে এক জায়গার পণ্য অন্য জায়গায় চলে যাওয়া অন্যতম। এক্ষেত্রে ওই পণ্যটি ওই স্থান থেকে এনে আবার নির্ধারিত স্থানে পাঠাতে হয়। এক্ষেত্রে সময় একটু বেশি লেগে যায়। এসব সমস্যা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে। কোন কারণে পণ্য নষ্ট বা হারিয়ে গেলে জরিমানাও দেয়া হয়। সেবার মান ও গ্রাহক ভোগান্তি প্রসঙ্গে সুন্দরবন কুরিয়ারের ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান পুলক জনকণ্ঠকে বলেন, পার্সেল বা পণ্য অফিসে এসে পৌঁছলে প্রাপক বা গ্রাহককে মেসেজ পাঠাতে সাধারণত ভুল হয় না। কখনও কখনও হতে পারে। তবে কল করেও তা নিশ্চিত হতে না পারার জন্য আমার দুঃখিত। এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পচনশীল পণ্য কোন কারণে নষ্ট হলে গ্রাহকের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে আমরা জরিমানা দিয়ে থাকি। পণ্যের দাম নির্ধারণ করে পার্সেল পাঠালে নির্ধারিত মূল্যের ৮০ থেকে ১০০ ভাগ পর্যন্ত অর্থ আমরা জরিমানা দিয়ে থাকি। আর দাম নির্ধারণ করে দেয়া না হলে ডকুমেন্টের ক্ষেত্রে ৩০০ টাকা দিয়ে থাকি। তিনি আরও বলেন, আমরা যুগোপযোগী সেবা দেয়ার চেষ্টা করছি। তারপরও কোন কারণে গ্রাহক ভোগান্তি হয়ে থাকতে পারে। আর ভোগান্তি নিরসনে অব্যাহতভাবে আমরা নানা পদক্ষেপ নিচ্ছি।
×