ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চরে বেঁচে থাকার সংগ্রাম

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১ জুলাই ২০১৭

চরে বেঁচে থাকার সংগ্রাম

বর্ষার জল সরিয়া গিয়াছে জাগিয়া উঠিয়াছে চর, গাঙ শালিকেরা গর্ত খুঁড়িয়া বাঁধিতেছে সুখের ঘর। ‘কী আশায় বাঁধি খেলাঘর বেদনার বালুচরে,’ ‘নদীর একূল ভাঙে ও কূল গড়ে এই তো নদীর খেলা, সকাল বেলা আমীর যে ভাই ফকির সন্ধ্যা বেলা,’Ñকবিতা ও গানের এ চরণগুলো চরবাসীর জীবনের সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। বর্ষার জল সরে গেলে এখন আর গাঙ শালিকেরা ঘর বাঁধে না। ঘর বাঁধে মাদারীপুরের বিচ্ছিন্ন জনপদ চরজানাজাত, কাঁঠালবাড়ি, মাদবরেরচর, বন্দরখোলা ও সন্ন্যাসীরচরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। ঝড়-বন্যা-ভাঙ্গনসহ নানা প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে সংগ্রাম করে যাদের বেঁচে থাকা। এখানে প্রতিদিন সভ্যতা ভাঙ্গে আর নতুন সভ্যতার জন্ম হয়। প্রতিনিয়ত যাদের ভাঙ্গা-গড়ার খেলায় সয়ে যাওয়া জীবনের স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। সেই সব অধিকার বঞ্চিত চরের মানুষের কাছে ভালবাসার কথা অচল-মানবতার কথা অর্থহীন। চরবাসীর সংসার ক্ষণে ভাঙ্গে-ক্ষণে গড়ে। তবুও থেমে নেই বানভাসি প্রান্তিক মানুষের জীবন-জীবিকা। তারা বার বার প্রত্যাশার বালুচরে ঘর বাঁধে, বুক বাঁধে নতুন প্রত্যয়ে। এক সময়ের বর্ধিষ্ণু জনপদ চরজানাজাত, কাঁঠালবাড়ি, মাদবরের চর, বন্দরখোলা ও সন্ন্যাসীরচরবাসী অর্থ বৈভব আর প্রাচুর্যে ভরপুর ছিল। অনেকের জমিদারি ছিল বাপ-দাদার আমলে। ছিল বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, খামারবাড়ি, বনেদি গেরস্থবাড়ি, দোতলা-তেতলা দালানসহ জীবনযাত্রার অফুরন্ত প্রাচুর্য। অভাব অনটন কি তা জানত না এসব চরের মানুষ। কিন্তু আজ সেসব ইতিহাসের পাতা থেকেও মুছে গেছে। এখন দারিদ্র্য আর অভাব চরবাসীর নিত্যসঙ্গী। সেদিনের চর আর আজকের চরের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। নিশ্চুপ হয়ে গেছে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ভরা মানুষের কলরব। এ হলো নিয়তির কাছে জীবনের পরাজয়। আজ থেকে ৬০-৬৫ বছর আগেও মূল ভূখ-ের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল শিবচরের চরজানাজাত, কাঁঠালবাড়ি, মাদবরেরচর, বন্দরখোলা ও সন্ন্যাসীরচর ইউনিয়ন। প্রায় প্রত্যেকটি ইউনিয়ন ছিল স্বনির্ভর। এই জনপদে যারা বসবাস করত, তাদের অধিকাংশ ছিল সচ্ছল। চৌধুরী আর মাদবররা ছিল এসব অঞ্চলের জমিদার। ধন-ধান্যে পরিপূর্ণ ছিল প্রতিটি কৃষকের ভাঁড়ার। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ছিল তাদের হাতের মুঠোয়। ছিল হাট-বাজার, বন্দর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ, বিনোদন কেন্দ্রসহ দুই শতাধিক আদর্শ কৃষি খামার। পদ্মা ও আড়িয়ালখাঁ নদের সঙ্গে ছিল এদের পরম সখ্য। জেলা সদর থেকে ৬৫ কিমি. উত্তরে পদ্মা নদী বেষ্টিত বিশাল বালুচরই আজকের চরজানাজাত। শিবচরের কাঁঠালবাড়ি, মাদবরেরচর, বন্দরখোলা ও সন্ন্যাসীরচর ইউনিয়নের আংশিক এর সঙ্গে যুক্ত হলেও চরজানাজাত নামেই এ চরের নামকরণ হয়েছে। শুধু তাই নয় এ চরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার দিয়াড়া নারিকেলবাড়ি ও চর নাসিরপুর ইউনিয়নের বড় অংশ। এসব ইউনিয়নের সমন্বয়ে জেগে ওঠা চরজানাজাত যেন দ্বীপ। প্রায় পনের বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই চরে রয়েছে দেড় শতাধিক ছোট ছোট গ্রাম। গ্রামগুলোর নামকরণ হয়েছে চরের প্রভাবশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নামে। যেমন সিরু চৌধুরী কান্দি, আলাউদ্দিন সরকার কান্দি, বজলু সরকারের কান্দি, মনরুদ্দিন বেপারি কান্দি, আবদুল মজিদ বেপারি কান্দি, সাবেরমিনা বেপারি কান্দি, সাদুল্যা বেপারি কান্দি, রহিমদ্দিন বেপারি কান্দি, রুস্তম বেপারি কান্দি, শিকদার কান্দি, মৃধা কান্দি, মাঝি কান্দি, গাছি কান্দি, ঢালী কান্দি, মোল্লা কান্দি, পোড়া কান্দি, মুন্সী রনাই হাওলাদার কান্দি, হাজি কান্দি, খোয়াজ ঢালীর কান্দি ইত্যাদি। রয়েছে চরচান্দ্র, চর তারপাশা, মাগুর খ-, কাউলীপাড়া, কাজির সুরার বড় বড় চর। এই বিশাল চরে প্রায় ৮০ হাজার মানুষের বসবাসের জন্য নেই রাস্তাঘাট, বিদ্যুত, পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার, চিকিৎসা সেবা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ মৌলিক অধিকারের কোন উপাদান। _সুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
×