ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আলম শাইন

গল্প ॥ সাঁঝের আতঙ্ক

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ৯ জুন ২০১৭

গল্প ॥ সাঁঝের আতঙ্ক

পরাগের নানাবাড়ি হিজলতলায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নানাবাড়ি থাকতে হচ্ছে ওকে। লেখাপড়ার অজুহাতে বাবা মঞ্জুর আহমেদ ছেলেকে হিজলতলায় থাকতে বাধ্য করেছেন। কেবল স্কুল ছুটি হলে তবে নিজ গাঁ রাজাপুকুর যাওয়া হয়। গাঁয়ে আসতে হলে অণুকে সঙ্গে আনতে হয়। অণু হচ্ছে পরাগের ছোট মামা। রাজাপুকুর আসতে হলে ছোট মামাকে পরাগের খুব প্রয়োজন পড়ে। অনেক কষ্টে রাজি করাতে হয় মামাকে। এবারও বহু কষ্টে রাজি করিয়েছেন। ছোট মামা কথা দিয়েছেন বাংলা নববর্ষের পর রাজাপুকুর যাবেন। প্রতিশ্রুতি মোতাবেক নববর্ষের দুই দিন বাদে অণুর সঙ্গে রাজাপুকুর এসেছে পরাগ। নিজ গাঁয়ে পা রাখতেই যেন একটা ধাক্কা খেল বালক। গাঁয়ের চারপাশটা কেমন জানি অপরিচিত অপরিচিত ঠেকছে। মাস দু’য়েকের মধ্যেই গাঁয়ের চেহারাটা বদলে গেছে এতখানি! এখন যেন চিনতেও কষ্ট হচ্ছে। হিজলতলায় যাওয়ার আগে গাছ-গাছালিগুলো অনেকটাই ন্যাড়া ছিল। ছিল না রাস্তাঘাটে এত ধূলাবালিও। পুকুর-কুয়া-ডোবার জল শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে এখন। ন্যাড়া গাছগুলোতে কচিপাতা লেগেছে। আমগাছে অসংখ্য কচি আম; ঝুলে মাটি ছুঁই ছুঁই করছে। থোকায় থোকায় ফুল ফুটেছে কৃষ্ণচূড়া, জারুল আর সোনালুর মাথায়। হলুদাভ কমলারূপ ধারণ করেছে খেজুরের ছড়াগুলো। তালপাতার ডগায় অসংখ্য বাবুই পাখি বাসা বেঁধেছে। বাসাগুলো লাউয়ের মতো ঝুলছে নিম্নমুখী হয়ে। তালের ক্রিমসাদা-সবুজ মিশ্রিত ক্ষুদ্র ফুলগুলো থেকে ম ম করে মিষ্টি সৌরভ ভেসে আসছে। সৌরভ ভেসে আসছে নিমফুল থেকেও। রাস্তার দুই ধারে অসংখ্য ছোট ছোট ভাঁটগাছ দাঁড়িয়ে আছে মাথাভর্তি দুধসাদা-গোলাপি ফুল ধারণ করে। ভাঁট ফুলের সৌরভও ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশে। বুনোফুলের রসপানে ব্যস্ত মৌমাছিরা। কেউ কেউ মধু আহরণ করে উড়ে যাচ্ছে মৌচাকে। নির্জনতা ভেঙ্গে খানিকটা পর পর ভেসে আসছে বসন্ত বউরি’র ‘টুক...টুক...টুক...’ আওয়াজ। আওয়াজটা দূর থেকে কামারের হাতুড়ি পেটানোর মতো শোনা যাচ্ছে। বাতাসে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকার অনবরত ঝিঁ..ঝিঁ..ঝিঁ.. সেøাগান। মনে হচ্ছে কোন এক স্বপ্নপুরীতে এসে পৌঁছেছে পরাগ। রাজাপুকুরের অমন রূপ আগে দেখেনি সে। অথচ এই রাজাপুকুরে পরাগের জন্ম! ভাবতেই যেন স্বর্গসুখ উপলব্ধি করল বালক। মাস দুয়েক পর নিজ বাড়িতে এসেছে পরাগ। মাকে দেখে কেন জানি খুশি হতে পারেনি আজ। হামিদা বেগম ছেলেকে জাপটে ধরলেও পরাগ আরেকদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। ছোট ভাই রিফাত কাছে এলেও আদর করার চেষ্টা করেনি। কী জানি কোন অভিমানে পরাগ মুখ ফিরিয়ে রেখেছে, মা তা বুঝতে সক্ষম হননি। ছেলের ঘর্মাক্ত মুখটা কাপড়ের আঁচল দিয়ে বারকয়েক মুছে দিয়েছে হামিদা বেগম। দুপুরের তপ্তরোদ মাথায় বয়ে অনেকখানি পথ হেঁটে আসায় বালকের রাঙা মুখটা আরও রঙিন হয়ে গোলাপরূপ ধারণ করেছে। কপাল থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। হামিদা বেগম বারবার মুছে দিচ্ছে ঘাম। শরীরে ধুলা-বালি লেগে থাকায় কলপাড়ে নিয়ে ছেলেকে ভাল করে ধুয়ে দিল। ঘরে এনে লেবুজলে চিনি গুলিয়ে শরবত বানিয়ে খেতে দিল। তৃষ্ণার্ত অণু ঢকঢক করে শরবত গিললেও পরাগ তা ছুঁয়ে দেখেনি। হামিদা বেগম বারবার চেষ্টা করেও শরবতের গ্লাসটা পরাগের হাতে দিতে পারেননি। পরিশেষে ব্যর্থ হয়ে হামিদা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে শরবত খাবি না?’ ‘না।’ ‘কী খাবি? পিডা খাবি? নাকি কুমড়া ফুলের বরা ভাইজ্যা দিমু?’ ‘কিচ্ছু খামু না।’ ‘আইচ্ছা আগে ভাত খাইয়া নে, হের বাদে শুকনা পিডা ভাইজ্যা দিমু।’ ‘না খামু না।’ ‘তোর না শুকনা পিডা খাওনের শখ।’ ‘কইলাম না কিচ্ছু খামু না।’ ‘ওম্মা পোলা দেহি কেবল রাগ দেহায়। কিছু না খাইলে বাড়ি আইলি ক্যান! আমারে দেখতে আইলি বুঝি বাপ?’ ‘না, তোমারে দেখতে আহি না। এহনি আবার চইলা যামু।’ ছেলের কথা শুনে হামিদা বেগম থতমত খেয়ে গেলেন। অণুর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘কিরে অণু অর কি হইছে? কিচ্ছু খাইব না আবার চইলা যাইতে চায় এহনি। কারণডা কিরে? তোরা বুঝি অনেক আদর-যতœ করস অরে?’ ‘বুবু পরাগ রাগ করছে। অনেকদিন থেইকা তোমারে দেহে নাই তো হের লাইগা অর রাগ জমছে। রাগ পড়লে ঠিক হইয়া যাইব।’ মা এতক্ষণে বিষয়টা বুঝতে পেরেছেন। চোখেরজল ছেড়ে দিলেন অমনিই। সেই সুযোগে ছেলে ঘর থেকে বেরিয়ে এক দৌড়ে হাজির খেলার মাঠে। বন্ধুরা ওখানে ফুটবল খেলছে। অনেকদিন পর এই মাঠে এসেছে পরাগ। ওকে দেখে উল্লাসে ফেটে পড়ল বন্ধুরা। সবাই খেলা থামিয়ে দিল। রাশেদ, কবির দৌড়ে কাছে এলো। বন্ধুর হাত ধরে রাশেদ জিজ্ঞেস করল, ‘কেমন আছসরে পরাগ?’ ‘ভালা আছি, তোরা কেমুন?’ ‘ভালা আছি। তুই এইবার কয়দিন থাকবি রে?’ ‘দুই সপ্তা থাকমু। কয়দিন পরে ইস্কুলে গরমের ছুটি পড়ব। পুরা ছুটিডা বাড়িতে কাটায়া যামু এবার।’ কবির জিজ্ঞেস করল, ‘কার লগে আইছস?’ ‘ছোট মামার লগে।’ ‘তোর মামাও কি তোর লগে থাকবো’? ‘জানি না।’ কুশলাদি শেষ। খেলা নতুন করে শুরু হবে। নতুন দল গঠন হবে। জানিয়ে দিল কবির। অনেকদিন পর বন্ধু এসেছে, ওর সৌজন্যে এই আয়োজন। পরাগকে বাড়ির আশপাশের ছেলেরা খুব খাতির-যতœ করে। থানা সদরের নামকরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র সে। অত্র এলাকার মধ্যে এ স্কুলটিই শ্রেষ্ঠ। সেই স্কুলের ছাত্র পরাগ; কম কথা নয়। তা ছাড়া ছাত্র হিসেবেও সে ভাল। আবার বাবা সৈনিকের চাকরি করেন। তার ওপর তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধাও। সেই সময় সৈনিকের চাকরি মানেই বিরাট কিছু। দু-চার গাঁয়ে একজন সৈনিক খুঁজে বের করা সত্যিই কঠিন ছিল। ইত্যাদি সব কারণে বন্ধুদের কাছে পরাগের কদর একটু বেশিই যেন। খেলাধুলা শেষ। গোধূলিলগ্নে বাড়ি ফিরেছে পরাগ। হামিদা বেগম ছেলের জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছেন। কত কী যে পিঠা বানিয়েছেন। এরই মধ্যে অণু বোনের কাছ থেকে পকেট খরচ পেয়ে দোকানে আড্ডা দিতে চলে গেছে। রাজাপুকুরে ওর মেলা বন্ধু-বান্ধব। বেশির ভাগই সিগারেট ফুঁকার দল। পরাগের বড় জেঠা অলি উল্ল্যা’র ছেলে নাজিম, শাহেদ আছে এই দলে। অণু এ বাড়ি এলে ওরা ভীষণ খুশি হয়। অণুকে নিয়ে দূর-দূরান্তে আড্ডায় যাওয়ার সুযোগ হয়। অন্য সময় এ ধরনের সুযোগ পায় না। অলি উল্ল্যা’র স্ত্রী বেঁচে নেই। তার পাঁচ ছেলে। ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয়বার বিয়েশাদি করেননি। সংসারের প্রতি তিনি ছিলেন বিরাগভাজন। ফলে তাদের সংসারের দায়িত্ব মঞ্জুর আহমেদের কাঁধে তুলে নেন, যা পরবর্তীতে হামিদা বেগমের কাঁধে বর্তায়। বাড়তি এই ছয়জনের ভরণপোষণের দায়িত্ব মঞ্জুর আহমেদ কাঁধে তুলে নিলেও হামিদা বেগমের তা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। তার নিজের এক সন্তান, বাড়তি ছয়জনের খাবার-দাবার, সংসার গোছানো, মহা এক ঝামেলার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরাগকে ওর নানাবাড়ি রেখে পড়ালেও ভাশুর ছেলেদের সামলানো কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠল। ওদের স্কুলে পাঠানো থেকে শুরু করে সব দায়িত্বই পালন করতে হয় হামিদা বেগমকে। সংসার সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে প্রায়ই রেগে যেতেন হামিদা বেগম। তখন আত্মীয়-স্বজনরা তাকে সান্ত¡না দিত, ‘পাঁচ পোলা বড় হইলে আফনার কোন দুঃখ থাকব না। অরা চাকরি-বাকরি করলে মাথায় তুইল্যা রাখব।’ হামিদা বেগম জানতেন এটি মিথ্যে আশ্বাস। ছেলেরা বড় কিছু হলে যে তার খবরও নিবে না তা ভাল করেই জানেন। তথাপি মুখ বুজে সংসারের সব কিছু সামলে নিচ্ছেন। পরাগের আগমনে জেঠাতো ভাইয়রা ভীষণ খুশি। অনেকদিন পর ভাই বাড়ি এসেছে। মেজ ভাই জুলফিকারের ইচ্ছা পরাগকে নিয়ে দোকানে যাওয়ার। বাড়ির পাশের দোকানগুলোতে তখনো শুভ হালখাতার রেশ রয়ে গেছে। দোকানিরা মাইকে পুরনো দিনের বাংলা-হিন্দি-যাত্রাপালার গান বাজিয়ে উৎসব পালন করছে। বাকি দেয়া টাকাটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তুলে নিতে এত এত আয়োজন। রাতের আঁধার ঘনিয়ে আসার আগেই জুলফিকার পরাগকে নিয়ে কাজিম উদ্দিনের দোকানে এসেছে। এই দোকানে পরিবারের লোকজন বাকি-টাকি খায়। বেশ কিছু টাকা দোকানির পাওনা হয়েছে। যার অর্ধেকটা গতকাল জুলফিকারের বাবা শোধ করে গেছেন। কাজেই ছোট ভাইকে এ দোকানে নিয়ে আসাই বুদ্ধিমানের কাজ, তাতে ইজ্জত বাঁচবে। কাজিম উদ্দিন অন্যসব দোকানিদের তুলনায় ভাল প্রকৃতির মানুষ। জুলফিকারের বিশ্বাস ভাইকে দেখলে দোকানি অন্তত হাতে একটা জিলাপি তুলে দিবেন। মূলত ওই বিশ্বাসেই পরাগকে দোকানে নিয়ে আসা। জুলফিকারের হাত আঁকড়ে ধরা নাদুস-নুদুস ফুটফুটে ছেলেটিকে দেখে দোকানি ইশারায় কাছে ডাকল। জুলফিকার এটাই চেয়েছে এতক্ষণ। পরাগ কাছে যেতেই দোকানি ওর থুঁতনিতে হাত দিয়ে আদর করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার নাম কি?’ ‘পরাগ।’ ‘কই থাহ বাবা? টাউনে থাহ বুঝি?’ ‘নানাবাড়ি থাহি।’ ‘এই জুলফিকার, রাজপুত্রডা কে রে? টাউনের পোলাপানের মতো দেহা যায়।’ দোকানির প্রশ্নে জুলফিকার গর্বিত হলো। ঝটফট জবাব দিল, ‘আমার ভাই, ছোড চাচার বড় ছেলে। লেখাপড়ায় ভালা। আগে চাচা-চাচির লগে ঢাকায় থাকত। চাচা বদলি অওনের পর গেরামে চইল্যা আইছে। এহন অর নানাবাড়ি থাইক্যা পড়ে। বাড়ি আইছে দুপুর বেলায়। হালখাতা দেখাইতে দোকানে নিয়া আইলাম এহন।’ ‘ভালা করছো। হালখাতা দেহুক আবার গেরামের মাইনষেরও চিনুক। ধরো বাবা, জিলাফি দুইডা ধরো।’ পরাগের দিকে জিলাপি দুটি বাড়িয়ে দিলেন দোকানি। পরাগ হাত বাড়িয়ে জিলাপি দুটি নিল। এতক্ষণ দোকানিকে ভালমতো দেখতে পায়নি। হ্যারিকেনের বিপরীত দিকটায় পাতলা কাগজ গুঁজে দেয়াতে অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকায় লোকটিকে দেখা যায়নি। এবার ঠিক ঠিক দেখতে পেয়েছে। ঘাড়টানা দিয়ে পরাগের দিকে ঝুঁকে জিলাপি দেয়ার সময় ভালমতো দেখেছে। লোকটিকে এ গাঁয়ে আর দেখেনি। এ প্রথম দেখেছে। মনে হচ্ছে লোকটি ওর বাবার বয়সী। কথাবার্তা শুনে গাঁয়ের অন্যদের চেয়ে একটু আলাদাই মনে হলো দোকানিকে। দোকানের সামনে কিছুক্ষণ থেকে পরাগকে নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়াল জুলফিকার। আঁধারে পরাগ ভয় পেতে পারে ভেবে ওর হাতের কব্জি শক্ত করে ধরল। হাঁটতে হাঁটতে দুই ভাই এটা-সেটা বলে এগুতে লাগল। কথা প্রসঙ্গে জুলফিকার জিজ্ঞেস করল, ‘নানাবাড়ি ক্যামন লাগেরে পরাগ?’ ‘ভা-লা।’ ‘ভা-লা কথাটা যে কইলি, তা কিন্তুক আমার কাছে ভালা মনে হইল না। তুই হাচা কইরা ক’ কেমন লাগে ওই বাড়িতে?’ ‘না, ভালা-ই।’ ‘দেখ তুই আমার লগে চালাকি করিস না, আমি কিন্তুক হগলই বুঝি। আমি কাউরেই কিচ্ছু কমু না, আমারে সব খুইলা ক।’ পরাগ কী যেন চেপে যাচ্ছে। টের পাচ্ছেন জুলফিকার। সে নিজেও মেধাবী ছাত্র। বয়স একুশ। মেট্রিকে ভাল রেজাল্ট করেছে। এখন চট্টগ্রামে ডাক্তারি পড়ছে। বছর খানেক আগে পরাগকে ওর কলেজ ছাত্রাবাসে নিয়ে গেছে একবার। দু’দিন নিজের কাছে রেখে পরে চাচার কাছে পৌঁছে দিয়েছে। মঞ্জুর আহমেদ তখন হালিশহরে থাকতেন। সে সুবাদে বালকের চট্টগ্রাম বেড়ানোর সুযোগ হয়। বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কারণে মেজ ভাইকে ওর খুব পছন্দ। জুলফিকার বেশ বুদ্ধিমান। ছোট ভাইয়ের মনোভাব বুঝার মতো জ্ঞান তার ঠিকই হয়েছে। পরাগ যখন মাস দুয়েক আগে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে হিজলতলায় যায় তখন ওকে আরও প্রাণবন্ত দেখাচ্ছিল। দেখতেও বেশ নাদুস-নুদুস ছিল। অথচ এ ক’দিনে কেমন শীর্ণ হয়ে গেছে। আগের মতো চঞ্চলতাও নেই ওর মধ্যে। আগে ভাইদের দেখলে জড়িয়ে ধরত, চুলটেনে দিত, হাঁটার সময় কত কথা জিজ্ঞেস করত। আজ কেমন জানি চুপসে আছে পরাগ। জুলফিকার পরিস্থিতি গুমোট হতে দিচ্ছে না। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিল। ‘পরাগ, ওই যে সামনে তেঁতুল গাছটা দেহস, ওইডা কিন্তুুক ভালা না, ওইখানে...।’ কথা শেষ করার প্রয়োজন পড়েনি আর। পরাগ বুঝে ফেলেছে সব। মেজ ভাইয়ের গায়ের সঙ্গে নিজের গা’টা লাগিয়ে হাঁটছে। গাছটায় কাদের বাস, তা গাঁয়ের সবারই জানা। অধিক রাত হলে কেউ সহজে তেঁতুলতলা দিয়ে যাতায়াত করে না। শুধু রাতেই নয়, তিনসন্ধ্যেও কেউ তেঁতুলতলায় আসে না। এখানে যাদের বাস তেনাদের নাম মুখে নিতে নেই। যে কোন সময় ক্ষতি করতে পারে। গাঁয়ের মমিন মিয়া সেটা বিশ্বাস করেনি। মশকারা করেছে, ব্যস্ বেচারি একেবারেই গাছের নিচেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। নাকেমুখে রক্ত বেরিয়ে নির্মমভাবে মরেছে। পুরো এলাকা চাউর হয়ে যাওয়ার পর থেকে আর কেউ-ই তেনাদের নাম মুখে নেয় না। তেঁতুলগাছের প্রায় কাছাকাছি এসেছে দুই ভাই। পরাগ মনে মনে দোয়া-দুরুদ পড়ছে। জুলফিকার নিজেও কী যেন সব দোয়া-টোয়া পড়ছে। শোনে পরাগ আরও ভয় পেয়ে গেছে। ভাইয়ের হাতটা খামছে ধরেছে। ভাই ওকে জাপটে ধরে হাঁটছে। আহ! কত ¯েœহ যে করেন ভাইয়েরা। অথচ নানাবাড়ির সবাই জেঠাতো ভাইদের বদনাম দেয়। জুলফিকারের হাত আঁকড়ে ধরে চোখ বুজে হাঁটছে পরাগ। রাস্তাটা ফাঁকা। রাস্তার দুই ধারে অল্প-বিস্তর ঝোঁপজঙ্গল, পাশেই খোলাবিল। জলশূন্য বিলে এখন ফসলাদি নেই। নেই জন-মানবের আনাগোনাও। দুইভাই ছাড়া আর কোন পথিকের যাতায়াত নেই পথটায়। একাকী বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছে ওরা। ওদের সঙ্গী এখন একমাত্র জোনাকি পোকাগুলো। জোনাকিরা সামনাসামনি উড়ছে আর উড়োজাহাজের সাংকেতিক বাতির মতো যৎকিঞ্চিত আলো জ্বালিয়ে পথ দেখাতে সাহায্য করছে। রাস্তার আশপাশে অবস্থান নিয়ে রাতচরা পোকারা প্রাণপণে ডেকেই চলছে; কোনরকম বিরতি না দিয়েই। মাথার ওপর দিয়ে পতপত করে ডানা ঝাঁপটিয়ে উড়ে গেল দুই-তিনটা কলাবাদুড়। বিলের দক্ষিণপ্রান্তে থেকে ভেসে আসছে খেঁকশিয়ালের উল্লাস। শেয়ালের উল্লাসে বালকের কলজে কেঁপে উঠলেও তেঁতুলগাছ আতঙ্কের চেয়ে বেশি ভয় পায়নি। তবে কানের দু’পাশ কেটে বৈশাখী তপ্তহাওয়া বয়ে যাওয়ায় ভয়টা ঝাঁকিয়ে ধরেছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন সাবধান করছে ফিসফিস করে কিছু একটা বলে। বৈশাখী হাওয়ার গতিবিধি দেখে ঝড়ের আবাসও টের পাওয়া যাচ্ছে। কাল বৈশাখী ঝড় বইতে পারে যে কোন সময়। কাজেই দ্রুত বাড়ি ফিরতে হবে। সমস্যা এখন একটাই, আর সেটি হচ্ছে তেঁতুলগাছটা পেরুনো। সন্ধ্যার পর পর সাধারণত এ পথ কেউ মাড়ায় না। তখন নাকি তেনাদের ঘুম ভাঙ্গে। এ সময় বিরক্ত করলে মাইন্ড করে, ফলে রেগে কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলতে পারে। এখন সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি! এ মুহূর্তে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকাটাও সমীচীন নয়। একমাত্র ভরসা যদি দু’একজন হাঁটুরে মিলে যায়, তাহলে এ যাত্রায় রক্ষা হয়। জুলফিকার নিজেও যে ভয় পেয়েছে তা স্পষ্ট, তার আচরণে টের পাওয়া যাচ্ছে। সে সামনে অগ্রসর হতে চাচ্ছে না, কথা থামিয়ে দিয়েছে হঠাৎ করেই। পেছন ফিরে যাবে ভাবছে, অমনি পেছন থেকে এলো গাঁয়ের আরও দুই যুবক। মোট চারজন এখন, এবার ভয় নেই। তেঁতুলতলা দিয়ে যাওয়া যেতে পারে। যুবকেরা কোরাস গাচ্ছে। জুলফিকার দু’একবার তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছে পর্যন্ত। তেঁতুলতলা পেরুতেই যেন সবাই বীর বাহাদুর হয়ে উঠল। আহ! কী তেজ একেকজনের। এতক্ষণ জিভ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে সবার। স্বয়ং জুলফিকার পর্যন্ত ঘেমে-নেয়ে অস্থির হয়ে গেছে। সেটি টের পেয়ে বালক মনে মনে দিব্যি কেটেছে আর কখনও রাত-বিরাতে তেঁতুলতলা দিয়ে যাতায়াত করবে না। ঘরে পা রাখতেই পরাগের বুক হাঁপরের মতো ওঠানামা করতে লাগল। হামিদা বেগম লক্ষ্য করলেন ছেলের দু’চোখ টকটকে লাল আর মুখটা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। কারণটা জানতে চাইলে তেঁতুলতলার ঘটানাটা পুরোপুরি জানাল পরাগ। সব শুনে হামিদা বেগম ক্ষেপে গেলেন জুলফিকারের ওপর। এতটুকু ছেলেকে নিয়ে কী প্রয়োজন ছিল রাত-বিরাতে বেরুনোর। যেতে হয় একাই যাও। পরাগকে নিয়ে কেন! এখন তো ছেলে ভয়ে অস্থির। হামিদা বেগম নিজেও ভয় পেয়ে গেছেন। লবণ ছেঁকে ছেলের মুখে দিচ্ছে। ঘরে ফকিরের ফুঁ দেয়া একবোতল জল ছিল; বোতলের ছিপি খুলে সেই জল ছিটিয়ে দিল ছেলের গায়ে। বিষয়টা জটিল হতেই জুলফিকার ইতস্ততবোধ করতে লাগল। পরাগকে যে জিলাপি খাওয়াতে নিয়ে গেছে, এখন বলা যাবে না। কাকিমা আরও রেগে যেতে পারেন তাহলে। রাগ পড়ে গেলে না হয় পরে সব খুলে বলবে। জুলফিকার জানে কাকিমা মানুষ হিসেবে মন্দ নন। ভালদের কাতারেই পড়েন। একটু সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ। যে যাই-ই বুঝায়, তাই-ই বুঝেন তিনি। বাড়ির অন্যরা তেঁতুলগাছ আতঙ্কে আতঙ্কিত করেছেন। কাজেই আপাতত রেগে থাকাটাই স্বাভাবিক। তার ওপর নিজ ছেলে বলে কথা। একটু রাগ হতেই পারেন। তবে ভুলটা তার নিজেরই। পরাগকে আগে বারণ করে দিলেই পারত। অথবা আতঙ্ক কেটে গেলে ঘরে ফিরলে ভাল হতো। দু’টির একটিও যখন করেনি তখন একটু বকাঝকা হজম করতেই হবে। রাগ পড়ে গেলে কাকিমা নিজেই অনুতপ্ত হয়ে পড়বেন। জুলফিকারের ধরণাটা অবশ্য অল্প সময়ের মধ্যেই প্রমাণিত হয়েছেও। হামিদা বেগমের সেই কঠিন রাগ নিমেষেই নেমে গেছে কাল বৈশাখীর তা-বে। বিনা নোটিসে কাল বৈশাখী ঝড় বইতে শুরু করায় ঘরের দরজা-জানালার খিড়কি লাগাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে গেছেন হামিদা বেগম। তার ওপর বজ্রের ভীমগর্জন আর শোঁ শোঁ বাতাসের ঝাঁপটানির সঙ্গে শীলের তা-বে ভয়ে গুটিয়ে গেছেন তিনি। ভুলে গেছেন পেছনের ঘটনাটি মুহূর্তেই।
×