ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ মামুন রশীদ

জেডের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার গল্প

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ৭ জুন ২০১৭

জেডের ক্রিকেটার হয়ে ওঠার গল্প

প্রতি পদেই একটা অস্বস্তি, ভীতি- নিঃসঙ্কোচে বেড়ে উঠতে পারেননি জেড রদ্রিগুয়েজ। ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রে জন্ম নেয়ার পর লন্ডনে বেড়ে ওঠেন তিনি। ১০ বছর বয়সে পেরুতে আসেন এ নারী ক্রিকেটার মায়ের সঙ্গে। সেটি ২০১০ সালের কথা। এরপর সেখানে প্রতিটা মুহূর্তে শাসানো হয়েছে, স্কুলে-রাস্তায় আলাদা চেহারার জন্য হতে হয়েছে নিগ্রহের শিকার। তবে এর মধ্যেই ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসার জন্য নিজেকে আত্মনিয়োগের মাধ্যমে এখন পুরোদস্তুর ক্রিকেটার হয়ে উঠেছেন। মাত্র ১১ বছর বয়সেই তিনি পেরু জাতীয় ক্রিকেট দলের হয়ে খেলে চমক সৃষ্টি করেন। বর্তমানে ১৭ বছর বয়সী এ কিশোরী আশায় আছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ মহিলা জাতীয় দলের হয়ে খেলার। সেই লক্ষ্যে অনুশীলন করে যাচ্ছেন অবিরাম। জেডের ক্রিকেটার হয়ে বেড়ে ওঠার গল্পটাও বেশ চমকপ্রদ- ৯ বছর বয়সে জেড তার প্রথম ক্রিকেট ম্যাচ দেখেন কেনিংটন ওভালে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও অস্ট্রেলিয়ার সে ম্যাচে ক্যারিবীয় হ্যাট ও জার্সি গায়ে উপস্থিত ছিলেন জেড। কিছু বুঝে উঠতে না পারলেও ম্যাচটা দেখে বারবার আনন্দে লাফিয়ে উঠছিলেন, কারণ খুবই ভাল লাগছিল খেলাটি। লন্ডনে যে বাড়িতে বেড়ে উঠেছেন জেড সেখানে প্রায় প্রাত্যহিক আলোচনার বিষয় ছিল স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস ও গ্যারি সোবার্সের। জেডের মা ত্রিনিদাদের মেয়ে। তিনি লন্ডনে পড়াশোনার সময় কিংবদন্তি ক্যারিবীয় ক্রিকেটার ক্লাইভ লয়েডের মেয়ের সঙ্গে একই কক্ষে থেকেছেন। ওই সময় বেশ কয়েকটি টুর্নামেন্টে ক্যারিবীয় ক্রিকেট দল যখন হোটেলে থাকত তাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থাপনায় ছিলেন। এ কারণে ক্রিকেট সম্পর্কে আলোচনা জেডকে শুনতেই হতো ছোটবেলা থেকে। তবে তিনি ক্রিকেট বুঝতেন না। ওভালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ দেখার পর থেকে তিনি এ বিষয়ে কিছুটা আগ্রহ বোধ করেন। ১০ বছর বয়সে প্রথম ক্রিকেট বল ধরা ও খেলার সুযোগ হয় জেডের। তখন ২০১০ সাল, জাতিসংঘের চাকরি নিয়ে জেডের মা জুলিয়েট সলোমন পেরুর রাজধানী লিমায় তখন। তিনি সেখানে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ক্রিকেট ম্যাচের স্কোরার হিসেবেও মাঝে মাঝে দায়িত্ব পালন করতেন। সেই সুবাদেই জেডের ক্রিকেট বল ধরার সুযোগ হয়। তাকে মাঠের বাইরে বসিয়ে রেখে মা চাইতেন খেলা দেখুক জেড। কিন্তু জেড নিজে চাইতেন মাঠে খেলতে। অধিকাংশ ছেলেমেয়ে ছোটবেলা হতে স্বপ্ন দেখে ব্যাটসম্যান হয়ে ওঠার। কিন্তু কার্টলি এ্যামব্রোসকে দেখার পর থেকেই জেড মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন একজন পেসার হয়ে উঠতে। আশির দশকে এ্যামব্রোসকে নিয়ে নির্মিত হয়েছিল ‘ফায়ার ইন ব্যাবিলন’ নামের একটি তথ্যচিত্র। সেটাতে এ্যামব্রোসকে দেখার পর জেডের মনে হয়েছে একজন পেস বোলার হতে পারাটা অনেক বড় মর্যাদার। এরপর থেকেই অনুশীলন শুরু। তার বাবা হেক্টর রড্রিগুয়েজ লন্ডনেই থেকে যান। আর এদিকে একাকী অনেক প্রতিকূলতাকে সঙ্গী করে বড় হতে থাকেন জেড। স্কুলে সবাই তাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করত, রাস্তায় চলার সময় কখনও কখনও অন্য ছেলেমেয়েরা তাকে মারতো, ব্যাগ ধরে টানাটানি করত এবং বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখাত। জিমে গিয়ে অনুশীলন করবেন সেজন্য কোন গ্লাভসও ছিল না। সবসময় শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার ভয় নিয়ে চলাচল করতেন, স্কুলের শিক্ষকরা তাই তাকে জিমে গিয়ে অনুশীলনের সুযোগ দেন। মাঝে মাঝে আক্ষেপে দেয়ালেও ঘুষি মারতেন জেড। পরের বছরই পেরুভিয়ান মহিলা জাতীয় দলের হয়ে দক্ষিণ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপসে খেলেন তিনি। তার মা সলোমন দলটি গঠন করেছিলেন। ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত হয় টুর্নামেন্টটি। মাত্র ১১ বছর বয়সে খেলে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে জাতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করার রেকর্ড গড়েন তিনি। তখনকার চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে একটি দুর্দান্ত উইকেটও শিকার করেন। আরও উচ্চপর্যায়ের ক্রিকেট খেলার প্রত্যাশা তখন জেডের মনে। ছেলেদের ক্রিকেট অনুশীলনের সময় তাকে মাঠের বাইরে বসে তা দেখার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল। এরই মধ্যে কোচ জুলিয়ান ওয়াল্টার তাকে ছেলেদের সঙ্গেই বোলিংয়ের জন্য ডাকেন। ২০১৩ সালে তিনি সাউথ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপের দলে সুযোগ করে নেন। ওই টুর্নামেন্টে জেডই ছিলেন একমাত্র মহিলা ক্রিকেটার। সলোমন বলেন, ‘সে যখন প্রথম আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে পেরুর হয়ে ব্রাজিলে খেলেছিল খারাপ ক্রিকেটারদের মধ্যে সেই ছিল সেরা।’ ওই সময় তিনি ক্যানএ্যাম ইউনাইটেড উইমেন্স ক্রিকেট এ্যাসোসিয়েশন সম্পর্কে জানতে পারেন। পেরুতে অনুশীলন করার সময় এটা সম্পর্কে জেনে ক্যানএ্যামে প্রবেশের আগ্রহ চাপে জেডের। ক্যানএ্যামের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে কথাও বলেন খেলার সুযোগ পাওয়ার জন্য। কিন্তু পড়াশোনার চাপে এক বছর বিরতি দিতে হয় ক্রিকেটে। কারণ ভাল ফলাফল করছিলেন তার শিক্ষাগত দিক থেকেও। ২০১৫ সালে এক বছর বিরতি শেষে প্রথম কোন আসরে খেলেন উত্তর আমেরিকায় আয়োজিত এক টি-২০ টুর্নামেন্টে। ওই আসরে ভাল পারফর্মেন্সের পর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় জেডের। তিনি ভাবতে থাকেন পেরুর বাইরেও উচ্চপর্যায়ের ক্রিকেট আসরে খেলার। এরপর ক্যানএ্যামের হয়ে গত বছরে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে খেলার সুযোগ হয় জেডের। গত বছরই লর্ডসে মায়ের সঙ্গে এসেছিলেন জেড। ৯ বছর বয়সে প্রথমবার যে ম্যাচটি দেখেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে- তারপর এটিই ছিল তার প্রথম ইংল্যান্ডে আসা। এ বছর মে মাসে ক্যানএ্যামের ১৪ সদস্যের দলে সুযোগ করে নেন তিনি। ২৫তম বার্ষিক ফিলাডেলফিয়া আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফেস্টিভ্যালে ১৭টি পুরুষ দলের প্রতিযোগিতায় তিনি ক্যানএ্যামের হয়ে খেলেন। মে মাসের শেষদিকে বার্বাডোজে ফ্র্যাঙ্কলিন স্টিফেনসন একাডেমিতে অনুশীলন শুরু করেছেন তিনি। মূলত এখান থেকেই সেরাদের বাছাই করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দলে সুযোগ দেয়া হয়। পানামায় হাইস্কুল ডিগ্রী নেয়ার পরই তিনি এ সিদ্ধান্ত নেন। মা সলোমনের সঙ্গে পানামায় ২০১৫ সালেই গিয়েছিলেন জেড। এখন তার লক্ষ্য প্রথমে বার্বাডোসের হয়ে খেলা। এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজ জাতীয় দলে জায়গা করে নেয়া। এ বিষয়ে জেড বলেন,‘যখন একাডেমির হয়ে আমরা টুর্নামেন্ট খেলার সুযোগ পেয়েছি, সেখানে বার্বাডোসের কোচ আছেন এবং উইন্ডিজ বোর্ডের অনেক কর্মকর্তাও আছেন। আমি যদি ভাল পারফর্ম করতে পারি সেক্ষেত্রে অবশ্যই তাদের নজরে আসব। আমার কোচেরাও ক্যানএ্যামের হয়ে যে নৈপুণ্য সেটার দিকে নজর রেখেছেন।’ উল্লেখ্য, প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা করে অনুশীলন করেন জেড। এর মধ্যে তিন ঘণ্টা নিজের কোচ আমাল নাথানিয়েলের সঙ্গে এবং ৫ ঘণ্টা একাডেমিতে। এখন ব্যাটিংয়ের দিকেও মনোযোগ দিয়েছেন অনুশীলনে। লক্ষ্য অলরাউন্ডার হওয়া যাতে করে দ্রুতই স্বপ্নটা পূরণ হয়। স্বপ্নটা ওয়েস্ট ইন্ডিজ জাতীয় মহিলা দলে জায়গা পাওয়ার। সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছেন জেড।
×