ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রবীর বিকাশ সরকার

প্রবাসীদের প্রকাশনার সংগ্রহশালা

প্রকাশিত: ০৭:২৫, ২ জুন ২০১৭

প্রবাসীদের প্রকাশনার সংগ্রহশালা

১৯৯১ সালে কতিপয় প্রবাসী বাংলাদেশী তরুণ ছাত্র-শ্রমিক মিলে হাতে লিখে একটি জার্নাল প্রকাশ করে কিছুদিন বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেন। অ-৪ সাইজের ৮ পৃষ্ঠার সাদাকালো পাক্ষিক ‘সোচ্চার’ হস্তলিখিত ফটো-কপিয়ার মেশিনে মুদ্রিত। কাগজটির বিষয়বস্তু অধিকাংশই রাজনীতি সম্পর্কিত। এরশাদীয় স্বৈরাচারী শাসন, রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থা, সামাজিক অস্থিতরতা, মহান মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা এবং পাকিস্তানপন্থী মৌলবাদী তৎপরতার সমালোচনাই বেশির ভাগ লেখার বিষয়বস্তু ছিল। সম্পাদক ছিলেন মাহাবুবুর রহমান, নির্বাহী সম্পাদক নাজিম, সার্বিক তত্ত্বাবধানে মোঃ নূরুল আমিন, সহযোগিতায় নিজাম, তাহের, মাসুদ, সার্দ্দুল, মনি ও মুরাদ। ১৯৯১ সালের মার্চ মাসে আমি প্রকাশ করি ‘মানচিত্র’ ট্যাবলয়েডÑ এটাই জাপানের প্রথম বাংলা মুদ্রিত কাগজ। প্রথম সংখ্যা ৮ পৃষ্ঠা সাদাকালো। এরপর অনিয়মিতভাবে ৭-৮টি সংখ্যা প্রকাশ করি প্রথম ও শেষ পৃষ্ঠা চার এবং ভেতর এক রঙে দ্বিগুণ পৃষ্ঠায়। ক্রমে একদিন মাসিক ম্যাগাজিনে রূপান্তরিত হয় মানচিত্র। ১৯৯৫ সাল থেকে ঢাকা থেকে মুদ্রিত হয়ে জাপানে আসত। ৫২ পৃষ্ঠার এই ম্যাগাজিনের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন লেখক মঞ্জুরুল আজিম পলাশ ও কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল। তখন জাপানে বাংলা পত্রপত্রিকা আসত না ফলে ‘মানচিত্র’ই ছিল বেশ কয়েক বছর ধরে প্রবাসীদের একমাত্র নিয়মিত কাগজ। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং গবেষকদের বহু লেখা ও সাক্ষাতকার প্রকাশিত হয়েছে তাতে। তথ্য, সংবাদ, ফিচার ছাড়াই প্রচ্ছদ প্রতিবেদন, বিশেষ প্রতিবেদন, প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এক হাজারের বেশি, দেশী-বিদেশী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাতকার প্রকাশিত হয়েছে ১৩০ জনের। ছড়া, কবিতা ও গল্প অসংখ্য। ‘মানচিত্র’ জাপান তো বটেই বাংলাদেশ, ভারত, বৃটেন ও আমেরিকাসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও প্রেরিত হতো এবং ব্যাপক পাঠকপ্রিয়কতা অর্জন করেছিল। উল্লেখ্য যে, মানচিত্রের উপদেষ্টা ছিলেন কবি শামসুর রাহমান ও অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন। ২০০২ সালে নানাবিধ কারণে প্রকাশনা স্থগিত করতে বাধ্য হই। ২০০৭ সালে তবুও দুটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল সম্পূর্ণ চার রঙে, সম্ভবত ৫২ পৃষ্ঠার সম্পূর্ণ রঙিন কোন বাংলা কাগজ ‘মানচিত্রে’র আগে বহির্বিশ্বে প্রকাশিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ‘মানচিত্র’ প্রকাশের পরপরই আরও একাধিক মাসিক কাগজ জাপান থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। জাপানে তখন প্রবাসীর সংখ্যা ৩০ থেকে কমে ২০ হাজার। প্রায় সব কাগজই বাংলাদেশ থেকে মুদ্রিত হয়ে জাপানে আসত। ১৯৯২ সালে কবি ও লেখক এমএইচ কবীর প্রকাশ করেন ‘অবয়ব’, ৪৮ পৃষ্ঠার এই কাগজটিতে দেশের বরেণ্য কবি, সাংবাদিক, লেখকরা লিখেছেন। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় ‘বাংলার মুখ’ চার রঙা প্রচ্ছদসহ ৩৬ পৃষ্ঠার সাদাকালো কাগজ। সম্পাদক অপু সারোয়ার। ‘বাংলার মুখে’র বাংলাদেশ ব্যুরো প্রধান ছিলেন কবি মোহন রায়হান। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘চেতনা’, সম্পাদক নূরুল আবেদীন। এর উদ্বোধনী সংখ্যাতে বিশিষ্ট লেখকরা লিখেছেন যেমন, কবীর চৌধুরী, ফয়েজ আহমেদ, ব’নজীর আহমদ, খান আতাউর রহমান, শামসুজ্জামান খান, সুকুমার বড়ুয়া, পান্না কায়সার, মুনতাসীর মামুন, সুশান্ত মজুমদার, জুয়েল আইচ, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, বিরূপাক্ষ পাল, খোশনূর আলমগীর, আসলাম সানী, মোঃ আব্দুল আজিজ ও মনিরুদ্দিন ইউসুফ। প্রত্যেকটি প্রবন্ধই তথ্যসমৃদ্ধ এবং মূল্যবান। ১৯৯৪ সালে জাপানে আমরা কয়েকজন মিলে গঠন করি ‘আড্ডা টোকিও’ নামে একটি সৃজনশীল পাঠচক্র। এর মুখপত্র ছিল অনিয়মিত ট্যাবলয়েড ‘আড্ডা টোকিও’। সম্পাদনা করেছিলাম আমি, প্রকাশ করেছিল বন্ধুবর কবি মোতালেব শাহ্ আইউব। আড্ডা টোকিও পাঠচক্র জাপানসহ অন্যান্য দেশেও বেশ আলোড়ন তুলেছিল। ২০০৩ সালে কবি নির্মলেন্দু গুণ এবং পরবর্তী বছরে কবি সমুদ্র গুপ্তকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম যথাক্রমে প্রথম বাংলা কবিতা উৎসব এবং জাপান-বাংলা কবিতা উৎসবে। সংগ্রহে থাকা দুটি সংখ্যায় লিখেছিলেন নির্মল সেন, পিআরপ্ল্যাসিড, নিয়াজ আহমেদ জুয়েল, হারুনূর রশীদ, সজল বড়ুয়া, বাবলু রহমান, মাসুদুর রহমান, হরিপদ রায়, বেলাল বেগ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখ। ১৯৯৬ সালে পর পর আত্মপ্রকাশ করে চারটি কাগজ। ‘শাপলা’, ‘সময়’, ‘প্রবাহ’ ও ‘মাকু’। ‘শাপলা’র সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন মোল্লা জাহাঙ্গীর আলম। মূলত আওয়ামী ঘরানার এই কাগজটির ১ম বর্ষ ৪র্থ সংখ্যায় তৎকালীন দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ থাকলেও সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীর দুটি নিবন্ধ মূল্যবান। ‘সময়’ এর সম্পাদক গাজীউর রহমান চৌধুরী। ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যায় কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসানের রাজনৈতিক নিবন্ধটি তাৎপর্যপূর্ণ। গল্প লিখেছেন মাহমুদ উল্লাহ। ক্রিকেট নিয়ে লিখেছেন দুলাল মাহমুদ। সংবাদ পাঠিকা রুখসানা আনোয়ারের সাক্ষাতকার আজ বিস্মৃত সময়ের স্মৃতিই বটে। বাংলা-ইংরেজী দ্বিভাষিক ‘প্রবাহে’র ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য কিছু লেখা রয়েছে যেমন, ‘সংসদ নির্বাচন ’৯৬’ নিয়ে লিখেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক মোস্তফা হোসেইন, সঙ্গে শিল্পী মাসুক হেলালের ইলাস্ট্রেশনগুলো অর্থবহ, চমৎকার। অর্থনীতি নিয়ে লিখেছেন বিরূপাক্ষ পাল। নিয়ামত হোসেনের প্যারোডি, পপসাহিত্য নিয়ে লিখেছেন মাহমুদ শামসুল হক, মুগ্ধকর ভ্রমণ কথা লিখেছেন ড. আশরাফ সিদ্দিকী। ‘মাকু’র প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন আলোকচিত্র গ্রাহক মশিউর রহমান পারভেজ। ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যাটির প্রচ্ছদ ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয় মডেল বিবি রাসেলকে নিয়ে। প্রচ্ছদ প্রতিবেদন গ্রামীণ চেক কাপড় নিয়ে। সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান লিখেছেন গুরুত্বপূর্ণ দুটি নিবন্ধ। ঐতিহ্যবাহী ফুলচর্চা ‘ইকেবানা’ ফিচার, উমা মিত্রের গল্প এবং সাংবাদিক শাহজাহান সরদারের জাপান ভ্রমণ হৃদয়গ্রাহী। নারীবাদী নেত্রী পান্না কায়সারের সাক্ষাতকার একটি ঐতিহাসিক দলিল। এই চারটি কাগজই কালার প্রচ্ছদ এবং ভেতর সাদাকালো, পৃষ্ঠা ৩৬ থেকে ৫২। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয় এসএইচএম তসলিম উদ্দিন সম্পাদিত ‘নিউ অয়ন’Ñ কালার প্রচ্ছদ, ভেতর সাদাকালো ৩৪ পৃষ্ঠার ১ম সংখ্যায় কয়েকটি মূল্যবান রচনা রয়েছে যেমন, সদ্যপ্রয়াত মহান মানবসেবিকা মাদার তেরেসা স্মরণে লিখেছেন ফারুক হোসেন ভুঁইয়া, নাচোল-তেভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তি নেত্রী ইলা বসুকে নিয়ে লিখেছেন রেহানা পারভীন, ‘আমার বাড়ী ফেনী’ লিখেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক এবিএম মুসা; শতাব্দীর মহানায়ক সূর্য সেনকে নিয়ে লিখিত প্রবন্ধটি তথ্যসমৃদ্ধ। সম্পাদক আওয়ামীপন্থী বলেই বাঙালী জাতীয়তাবাদ কাজ করেছে তার মনে বলে মনে হয়। ১৯৯৮ সালে লেখক পিআরপ্ল্যাসিড প্রকাশ করেন বাংলা-ইংরেজী দ্বিমাসিক ‘বিবেকবার্তা’ মূলত সংবাদভিত্তিক কাগজ। ৩য় বর্ষ ১ম সংখ্যায় রয়েছে দেশ-বিদেশের অসংখ্য সংবাদ, ফিচার এবং প্রবন্ধ। প্রচ্ছদ চাররঙা ভেতর একরঙা সর্বমোট ৩২ পৃষ্ঠা। কাগজটি বেশ কয়েক বছর প্রকাশিত হওয়ার পর কিছুদিন বুকলেট হিসেবে প্রকাশিত হয়। এখন প্রকাশনা বন্ধ থাকলেও অনলাইন হিসেবে প্রকাশমান। শোনা যাচ্ছে ট্যাবলয়েড হিসেবে আবার প্রকাশিত হবে শীঘ্রই। ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় মোঃ আসাদুজ্জামান সম্পাদিত ‘প্রবাসী’, ই-৫ সাইজের সম্পূর্ণ চাররঙা সর্বমোট ২০ পৃষ্ঠার এই কাগজটিতে রয়েছে তথ্যনির্ভর অনেক ছোট-বড় সংবাদ। যেমন ২০০০-১ অর্থবাজেট, মানব জেনোম, জাপানের নির্বাচন, জাপানিভাষা শেখা, একজন জাপানি প্রতিবন্ধী তরুণের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা, বাস্কেটবল খেলোয়াড় হওয়াÑ অবিশ্বাস্য রকম উৎসাহব্যঞ্জক অথচ যার দেহের ৫টি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ৪টিই নেই! বিশ্ববিখ্যাত জাপানি কোম্পানি ‘সোনি’র পরিচিতিমূলক ফিচার সোনি: উন্নতির পটভূমি, সত্যি চমৎকার লেখা। ২০০২ সালে ‘প্রবাসের ডাক’ নামে একটি বিএনপিপন্থী ত্রৈমাসিক কাগজ প্রকাশিত হয় এমডি আলাউদ্দিন সম্পাদিত। ইফতেখার রসুল জর্জ হচ্ছেন সমন্বয় সম্পাদক। চাররঙা প্রচ্ছদ, ভেতর একরঙা অত্যন্ত সস্তা কাগজে মুদ্রিত হলেও কিছু লেখা ভাল আছে। লিখেছেন ফরিদ কবীর, গাজীউল হাসান খান, ইফতেখার রসুল জর্জ, শুভ রহমান। কবিতা লিখেছেন আল মাহমুদ, দাউদ হায়দার, শাকিল রিয়াজ, মঞ্জুষদাশ গুপ্ত প্রমুখ। ২০০৩ সালে লেখক কাজী ইনসান প্রকাশ করেন দ্বিমাসিক কাগজ ‘পরবাস’, প্রচ্ছদ চাররঙা, ভেতর একরঙা লিথোগ্রাফ মেশিনে মুদ্রিত ১ম সংখ্যাটি দ্রুত প্রবাসী পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। প্রচ্ছদসহ ৩৬ পৃষ্ঠার এই সংখ্যায় ‘মানচিত্র’র এক যুগ পূর্তি উপলক্ষে একটি বিশেষ নিবন্ধ লিখি আমি, সাংবাদিক মনজুরুল হক জাপানি সাংবাদিক নাওআকি উসুই এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে লিখেন মূল্যবান একটি নিবন্ধ, ‘লালসালু’ নির্মাতা চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মেলের মিনি সাক্ষাতকারটি উল্লেখযোগ্য। বর্তমানে জাপানেই কিছু পৃষ্ঠা চাররঙা ও বাকি পৃষ্ঠা একরঙা পরবাস গ্লোসি কাগজে মুদ্রিত হচ্ছে, প্রবাসীরা লিখছেন তাঁদের মূল্যবান অভিজ্ঞতা ও স্বদেশ ভাবনা নিয়ে। আপাতশেষ কাগজটি প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালে ত্রৈমাসিক হিসেবে ‘পূর্বদিগন্ত’ নামে, সম্পাদক ড. এমএএম মিলন। প্রচ্ছদ ও সেন্টারপেইজ চাররঙা এবং ভেতর একরঙা ৪৪ পৃষ্ঠার কাগজটি গ্লোসি পেপারে ঝকঝকে ছাপা ঢাকায়। ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যায় জাপানের বিভিন্ন তথ্যাদি নিয়ে চমৎকার একটি নিবন্ধ লিখেছেন মনজুরুল হক, ধ্যান নিয়ে লিখেছেন চমন আরা যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, মানুষ ও কম্পিউটার সম্পর্ক নিয়ে ড. মোস্তাফা আল মাসুমের লেখাটি মূল্যবান, সুনামি (জলোচ্ছ্বাস) নিয়ে লিখেছেন শহিদুল ইসলাম বাবু। এই সংখ্যার খুবই শিক্ষণীয় একটি বিষয় হলো : মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১টি সেক্টরের অবস্থান মানচিত্রে ব্যাখ্যার তথ্যচিত্রটি, যা সত্যি সংরক্ষণযোগ্য। এসব ছাড়া আরও দুটি কাগজ মাসিক ‘বক্তব্য’ ও ‘টোকিও সংবাদ’ প্রকাশিত হয়েছিল যার কপি এখন খুবই দু®প্রাপ্য। ‘বক্তব্য’ যথেষ্ট শক্তিশালী কাগজ ছিল। বেশ কিছুদিন প্রকাশিত হয়েছিল। এর প্রধান সম্পাদক ছিলেন নূর হোসেন দর্পন আর সম্পাদক ছিলেন কবি বিপুল কৃষ্ণ দাস। টোকিও সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন বর্তমানে জে-টিভি’র কর্ণধার মাসুদ আহমেদ। উল্লেখ্য, একমাত্র দীর্ঘায়ুপ্রাপ্ত ‘মানচিত্র’ এবং ‘পরবাস’কে বাদ দিলে আর সব কাগজই ছিল স্বল্পায়ু। অধিকাংশই এক বছরও টিকেনি, কোন-কোনটি প্রথম সংখ্যার পরই মিলিয়ে গেছে। প্রকাশিত কাগজগুলো এখন নেই বললেই চলে। অথচ এই কাগজগুলো নানাদিক দিয়েই আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এবং অমূল্য সম্পদ। যদিওবা এগুলো পেশাদারী সাংবাদিক বা লেখকদের দ্বারা সুসম্পাদিত নয়, নয় তেমন আকর্ষণীয়, কিন্তু এগুলোতে ছিল বৈচিত্র্যময় বিস্তর তথ্য-উপাত্ত; প্রতিষ্ঠিত লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক তথা বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্বপূর্ণ রচনা। ৯০ দশকের এই সময়ে বিশ্বের আর কোন দেশে প্রবাসী বাঙালীরা এত বেশি কাগজ প্রকাশ করেছেন বলে জানা যায় না। মূলত অনাত্মীয় পরিবেশে প্রবল জাতীয়তাবোধ এগুলো প্রকাশের পেছনে কাজ করেছে। ব্যয় হয়েছে প্রচুর মেধা, সময় এবং অর্থ। বাংলাদেশ থেকে মুদ্রিত হয়ে আসত বলে স্বদেশের আর্থিক খাতেও তাঁরা প্রচুর অবদান রেখেছেন এসব কাগজের প্রকাশকরা। কাজেই তাঁদের সৃষ্ট এই সাংস্কৃতিক সম্পদগুলো বাংলা একাডেমির সংগ্রহ করা উচিত বলে আমরা মনে করি। সেইসঙ্গে একাডেমি প্রতিষ্ঠা করতে পারে একটি ‘প্রবাসী সাহিত্য-সংস্কৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্র।’ প্রতিবছর বইমেলায় এগুলো প্রদর্শন করা গেলে দেশবাসী জানতে পারবেন যে মাতৃভাষা বাংলার চর্চায় প্রবাসীরা কতখানি নিবেদিতপ্রাণ। শুধু কাগজই নয়, অনেক প্রবাসী দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে থেকে অনেক মূল্যবান গ্রন্থ লিখেছেন, লিখছেন সেগুলোকেও একাডেমি সংগ্রহ করতে পারে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য। পুরস্কার দিয়েও উৎসাহিত, মূল্যায়ন করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এগুলো জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলা একাডেমির জাতীয় দায়িত্ব বলেই বিশ্বাস করি, কেননা ভবিষ্যত গবেষণার কাজে এগুলো হবে অসামান্য তথ্যের উৎস। ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি জাপানে এসেছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক স্বনামধন্য লোকগবেষক শামসুজ্জামান খান। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করে আমি এই প্রস্তাবগুলো করেছিলাম। তিনি সঙ্গে-সঙ্গে বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলেছিলেন। আশা করেছিলাম তাঁর সহৃদয় চেষ্টার ফলে অচিরেই এই প্রস্তাবের বাস্তবায়ন দেখতে পাব। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই বিষয়ে কোন পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেননি। বাংলা একাডেমিতে প্রবাসীদের সাহিত্যমূল্য নির্ধারণে একটি সংগ্রহশালা গড়ে তোলা যেতেই পারে। এটা সময়ের দাবি। একে অবহেলা করার কোন সুযোগ নেই।
×