ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগানোর সক্ষমতা অর্জন করতে হবে আওয়ামী লীগকে -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ১ জুন ২০১৭

শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগানোর সক্ষমতা অর্জন করতে হবে আওয়ামী লীগকে -স্বদেশ রায়

ভুপিন্দর ইয়াদব। ভারতীয় জনতা পার্টির অন্যতম জেনারেল সেক্রেটারি ও ইনচার্জ নির্বাচন ম্যানেজমেন্ট কমিটি। ভারতের সুপ্রীমকোর্টের এই আইনজীবী ২০১২ সাল থেকে ওই দেশের রাজ্যসভার সদস্য। পরিবেশবাদী এই আইনজীবী একজন সুলেখকও। শেখ হাসিনার সঙ্গে দিল্লী গিয়ে এয়ারপোর্টে নেমেই গাড়িতে বসে মোটামুটি ঠিক করে নেই, কখন তাঁর সঙ্গে দেখা হবে। তাঁর দিল্লীর বাস ভবনে ৯ এপ্রিল বিকেলে প্রায় তিন ঘণ্টা নানা বিষয়ে ইন্টারেকশন হয়। ভদ্রলোক পরিমিতভাষী। যে কোন বিষয়ের গভীরে যাওয়া পছন্দ করেন। আলোচনাকে নানা বিষয়ে নিয়ে আকর্ষণীয় করে তোলার গুণাবলী রয়েছে তাঁর। একজন সাংবাদিক হিসেবে তাঁর সঙ্গে আলোচনার সময় আমার উদ্দেশ্য ছিল, সম্প্রতি তিনি যে সে দেশের উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে তাঁর দলকে জিতিয়েছেন সে নির্বাচন জেতায় তাঁর কৌশল কী কী ছিল। দিল্লীতে নেমেই যেমন বুঝতে পারি তেমনি তার মাত্র কিছুদিন আগেও ইন্ডিয়া গেছিÑ সব মিলে বুঝতে কষ্ট হয় না, ভারতে এ মুহূর্তে গড়ে ষাট শতাংশের ওপর জনপ্রিয়তা ভোগ করছেন ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। স্বাভাবিকই আমার জানার ইচ্ছা ছিল, শুধু কি নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তায় উত্তর প্রদেশের বিধান সভায় বিজেপি অত বড় জয় পেয়েছে? ভারতের এক শ্রেণীর পত্রিকা পড়লে মনে হতো ওই নির্বাচনের আগে, মুসলিম ইস্যু ও গরু এই দুটিকে কেন্দ্র করেই বিজেপি জয় পেয়েছে। একজন ছোটখাটো রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে কখনও মনে হয়নি, ওই দুই ইস্যু বিজেপির নির্বাচনে জেতার মূল কারণ। কিছুটা কাজ করেছে এটা সত্য। তবে তা অনেক ফ্যাক্টরের মধ্যে দুটি মাত্র। তাও অতি ক্ষুদ্র হবে। এ জন্যই জমকালো ডিনারের থেকে একজন সাংবাদিক হিসেবে আমার ইচ্ছা ছিল ভুপিন্দর ইয়াদবের সঙ্গে কথা বলা। ভুপিন্দর ইয়াদব গরু ও মুসলিম ইস্যুকে অস্বীকার করেননি। তবে দেখলাম আমার বিশ্লেষণ তাঁর তথ্যের সঙ্গে অনেকখানি মিলে যায়। গরু অবশ্যই তাদের একটা ইস্যু। তবে তাঁর মতে সেটা বড় কোন ইস্যু নয়। আর ওই অর্থে কোন মুসলিম বিদ্বেষ তাঁরা নির্বাচনে কাজে লাগাননি। বরং নির্বাচনের ভেতর দিয়ে তাঁরা চেষ্টা করেছেন বিজেপিকে আরও বেশি ইনক্লুসিভ পার্টি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। তাছাড়া ভুপিন্দর ইয়াদবের অন্য কথার ভেতর দিয়েও তা বের হয়ে আসে। তিনি বলেন, ভারতীয় জনতা পার্টি এ মুহূর্তে ভারতে সব থেকে বড় রাজনৈতিক দল। তাই এ ধরনের কোন দল কখনই কোন গোষ্ঠী, গোত্র বা ধর্ম মতাবলম্বীদের তাদের দলের বাইরে রাখবে না। অতীতের যে কোন কিছুকে ঝেড়ে ফেলে তারা সকলের জন্য একটা দল করবে। আর আধুনিক নির্বাচন অনেক বেশি ক্যালকুলেটিভ ও বিজ্ঞানভিত্তিক, যা উত্তর প্রদেশের নির্বাচনী ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে থাকাকালীন ভুপিন্দর ইয়াদব দেখিয়েছেন। প্রথমত তাঁকে মোদির জনপ্রিয়তার প্রতীক জনবান্ধব কাজের একটি বাস্তবরূপ নিয়ে যেতে হয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে। দরিদ্রের জন্য ইন্সুরেন্স কার্ড ছিল যার অন্যতম। এ ছাড়া তিনি যেভাবে নির্বাচনী টিম নানা ভাগে ভাগ করে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর দল আবার সাধারণ দলের ভেতর অনেকগুলো ভাগ করে তৈরি করেছিলেন- তা আমেরিকার নির্বাচনেও দেখা যায়নি। ভুপিন্দর যেভাবে এই কাজ করেন তা বিস্তারিত লিখতে গেলে দীর্ঘ হবে এ লেখা এবং লেখা ভুপিন্দরকেন্দ্রিকই থাকবে। প্রায় তিন ঘণ্টা আলোচনার বেশি সময় এগুলোই বোঝার ও তথ্য জানার চেষ্টা করি। ভুপিন্দর অনেক বেশি বিনয়ী ও ভদ্র। আমাকে গাড়িতে তুলে দেয়ার পরও তিনি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁর কাছ থেকে বিদায় নেয়ার পরে গাড়ি মোড় নিতেই ভাবি, নরেন্দ্র মোদির থেকে শেখ হাসিনা কোন মতেই কম জনপ্রিয় নন আমাদের দেশে। শেখ হাসিনা এ মুহূর্তে এককভাবে বাংলাদেশে ষাট ভাগেরও অনেক বেশি জনপ্রিয়তা ভোগ করছেন। তার পরেও কেন মাঝে মাঝে তাঁর কিছু সমর্থক, কিছু নেতার ভেতর এক ধরনের হতাশা দেখি। কেন তারা মনে করেন শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে পারবেন কি তারা আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে? আগামী ২০১৯-এর নির্বাচনে বাস্তবে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার বিজয় অর্জনটা খুব শক্ত কিছু নয়। তবে যে কোন নির্বাচনে বিজয়ী হতে গেলে তার জন্য পরিকল্পিত পদ্ধতিতে এগুতে হয়। নির্বাচন যত ছোট বা বড় হোক, নির্বাচন একটি গেম। এটা সম্পূর্ণরূপে একটা টিম ওয়ার্ক। এখানে একজন শেখ হাসিনা বাস্তবে একজন রোনাল্ডো বা একজন সাকিব। তিনিই শেষ অবধি গেম জেতাবেন এবং দলে তাঁর উপস্থিতিই অন্য দলের সঙ্গে ভারসাম্যের পার্থক্য করে ফেলে। শেখ হাসিনাসহ তাঁর জোট বর্তমানে বাংলাদেশে অন্য জোটের সঙ্গে মূলত ৭০:৩০। তার পরেও রোনাল্ডোর সঙ্গে বাকি দশজনকে যোগ্যতার সঙ্গে খেলতে হবে। মোদি বিজেপির রোনাল্ডো। তবে মোদির সঙ্গে কিন্তু ভুপিন্দরের মতো এমনি অনেক শান্ত মাথার খেলোয়াড় আছেন। সর্বোপরি আছে তাদের চমৎকার গেম প্ল্যান। উত্তর প্রদেশ নির্বাচনটি ছিল- স্টেটসম্যানের সাবেক সম্পাদক মানস ঘোষের ভাষায়, এটা ভারতের আগামী নির্বাচনের সেমিফাইনাল। আর এ নির্বাচন জেতার পরে মানস দা আমাকে ফোন করে বলেন, বিজেপি তাদের সেমিফাইনালে জিতে গেল। মানস দার কথারই প্রতিধ্বনি শুনি দিল্লীর সাংবাদিক ও ডিফেন্স এ্যান্ড ফরেন স্ট্র্যাটেজিক রাজীব শর্মার গলায়। তাঁর সঙ্গেও এ নির্বাচনের রেজাল্ট নিয়ে আলাপ করি সে সময়ে টেলিফোনে। রাজীবও আমাকে বলে, স্বদেশ, তুমি মনে করতে পার বিজেপি তাদের আগামী নির্বাচনের জয়ের বড় একটি ধাপ এগিয়ে গেল। রাজীবও মনে করেনি, মুসলিম বা গরু এখানে মূল ইস্যু। তাঁর মতে স্ট্র্যাটেজিক দিক থেকে বিজেপি অনেক বেশি এগিয়ে ছিল কংগ্রেস জোটের থেকে। রাজীব খুবই সোজা কথা বলা সাংবাদিক। সব সময়ই তথ্যকে সঠিক এনালিসিস করে ও। যেমন এবার দিল্লী যাওয়ার আগে জানতে পারি, ওর সঙ্গে দেখা হবে না। কারণ, যেদিন আমি নামব ওইদিন বিকেলে তাঁর ফ্লাইট। বিকেল অবধি আমি আগের থেকে এত টাইট প্রোগ্রাম রেখেছিলাম যে কারণে আর দেখা হওয়ার কোন চান্স থাকে না। তাই তাকে টেলিফোনেই ঢাকা থেকে জিজ্ঞেস করি, আচ্ছা শেষ মুহূর্তে মমতা যাচ্ছে, তিস্তার কি কোন সম্ভবনা আছে? রাজীবের সোজাসুজি উত্তর, জিরো। যাহোক, বিজেপি এই সেমিফাইনালটি খেলেছে এক বছরের প্রস্তুতি ও গেম প্ল্যানে। এখন তাদের হাতে ফাইনাল খেলার জন্য আমাদের থেকে কম সময় আছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি, তারা এখন যার যার অবস্থান থেকে ফাইনাল খেলায় কন্ট্রিবিউট করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আওয়ামী লীগেরও ফাইনাল খেলার জন্য সময় আছে দেড় বছর। দেড় বছর সময় আছে বলে হাতে খুব কম সময় বলার কোন সুযোগ থাকে না। কারণ, যে বছরই একটি দল পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় আসে ওই বছর থেকে সে আগামী নির্বাচনের গেম প্ল্যান তৈরি করতে পারে না। কিছুটা কাজ করতে পারে। গেম প্ল্যানটি তাকে করতে হয় শেষ বছরে। কারণ, ততদিনে তার সব কিছু ম্যাচিউর করে গেছে। তখন সে বুঝতে পারে, কোন্ দিক থেকে সে খেলাটা সাজাবে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নির্বাচন করা উচিত ১৯ এর মার্চ মাসে। ১৮ এর ডিসেম্বরে নয়। যদিও বিষয়টি খুব ছোট তার পরেও তাদের প্রমাণ করতে হবে, আওয়ামী লীগ সংসদীয় গণতন্ত্র অনুযায়ী এবারও পাঁচ বছর পূর্ণ করেছে। আর এই দেড় বছরে তাকে ভুপিন্দর ইয়াদবের মতো এমনই একজন বা কয়েকজন গেম প্ল্যানারকে কাজে লাগাতে হবে এখন থেকেই- যারা দ্রুত চিহ্নিত করবেন, শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তার কোন্ দিকগুলোকে জনগোষ্ঠীর কোন্ শ্রেণীর কাছে কীভাবে নিয়ে যাবে। তাছাড়া তাদেরকে এখনই গড়তে হবে নির্বাচনের বিভিন্ন কাজের বাহিনীগুলো। যে বাহিনীগুলোকে হতে হবে ভুপিন্দরের বাহিনীর মতো প্রশিক্ষিত। এখন থেকে কাজে নেমে পড়লে এ কাজ করা আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন কিছু নয়। আওয়ামী লীগের কিছু ভীত ও সুবিধাভোগী ইতোমধ্যে বিএনপির ওখানে পা রাখার জন্য সেখানে একটা ইট রাখার চেষ্টা করছে। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় সেগুলো দেখা গেছে। কিন্তু নির্বাচনের ছয় থেকে সাত মাস আগে যখনই স্পষ্ট হয়ে যাবে, শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তায় আওয়ামী লীগ ২০১৯-এর নির্বাচনে আবারও বিজয়ী হতে যাচ্ছে, তখন এই সব সুবিধাভোগীরা আবার ওই পা টেনে নিয়ে আসার চেষ্টা করবে। তারা এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের ভেতর মানসিক দুর্বলতা ছড়িয়ে বেশ ক্ষতি করছে। তবে এগুলো বাস্তবে রাজনীতিতে কিছুই নয়; কারণ, এরা অতি মাত্রায় শহরকেন্দ্রিক। তাছাড়া সব থেকে বড় দিক হলো, শেখ হাসিনা আগুন নিয়ে খেলেও রাজনীতিতে এমন বড় একটি কার্ড খেলেছেন যার ফলে আগামী দেড় বছর দেশের রাজপথ তিনি শান্ত রাখার ব্যবস্থা করেছেন। তাই তাঁর দল ও দলের বাইরে তাঁর সমর্থকদের মধ্যে যে সব ভুপিন্দর আছেন তাদের নিয়ে তিনি আগামী দেড় বছর নির্বাচনী গেমকে এগিয়ে নেয়ার নিরুপদ্রব পরিবেশ পাচ্ছেন। এই নিরুপদ্রব পরিবেশে শেখ হাসিনাকে আরও বেশি ইনক্লুসিভ জোট হিসেবেই এগুতে হবে। কারণ, তাঁকে অনেক বেশি ভোটে ও অনেক বেশি সিটে আগামী ২০১৯ এর নির্বাচনে জিততে হবে। ওই জয়লাভ ও তাঁর ক্ষমতার ওই পাঁচ বছরের ভেতরই তিনি তখন তৈরি করে দিতে পারবেন আধুনিক ও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ। রাজনীতিক মানেই কয়লাখনির শ্রমিক। তাকে নিজের শরীরে কখনও কখনও কালি লাগিয়ে সোনা আহরণ করতে হয়। এ নিয়ে যারা চিৎকার করে তারা অতি মাত্রায় অস্থির বা আল্ট্রা-প্রোগ্রেসিভ। তাই এ সবে কান দেয়ার সময় এখন তাঁর হাতে নেই, আওয়ামী লীগেরও হাতে নেই। আওয়ামী লীগকে এখন পাড়া-মহল্লা সর্বত্র নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে হবে, সত্যিকার অর্থে সোলজার হতে হবে যাতে আগামী দেড় বছর শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে তারা নির্বাচনী ফসল ঘরে তুলতে পারে। কিছু কিছু বিএনপি সমর্থক এখনও একটি মিথ্যা আশায় আছে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলে খালেদা জিতবে। খালেদাকে মানুষ কেন ভোট দেবে? তাঁর কি বর্তমান পৃথিবীর কোন কাজ করার যোগ্যতা আছে? তিনি এখন বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অতীত ঘটনা মাত্র। [email protected]
×