ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

॥ মিলন কান্তি দে ॥

সময়ের অনন্য এক নাট্য উপাখ্যান ‘সাঁঝবেলার বিলাপ’

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ২৩ মে ২০১৭

সময়ের অনন্য এক নাট্য উপাখ্যান ‘সাঁঝবেলার বিলাপ’

নাট্য প্রদর্শনী চলছে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। আমরা তাড়িত হচ্ছি কিংবা শিহরিত ও রোমাঞ্চিত। প্রায়ই উচ্চারিত হয় ভাল নাটক কই? হলেও সংখ্যায় খুব কম। সচেতন দর্শকের মনোজগতে এমনি যখন অতৃপ্তি ও অস্থিরতার সংঘাত, ঠিক এ সময়েই ফ্রান্সের জ্যাঁ রাতিনের ধ্রুপদী নাটক ‘ফ্রেইডা’র অসিত কুমার কৃত বাংলা অনুবাদ অবলম্বনে ‘সাঁঝবেলার বিলাপ’ আমাদের শোনালেন অধ্যাপক ড. ইসরাফিল শাহীন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের এমএ শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে এ নাটকের পর পর তিনটি (১৬, ১৭, ১৮ মে) প্রদর্শনী হয়ে গেল নাটম-ল মিলনায়তনে। রাজনৈতিক টানাপোড়েন, সামাজিক দ্বন্দ্ব সংঘাতের মধ্যে এক নারীর হৃদয়ঘটিত অসম্ভব উচ্চাভিলাষ নির্দেশক ইসলাফিল শাহীনের প্রয়োগ কুশলতায় যেভাবে তরঙ্গে বিভঙ্গে একের পর নাটকীয় উৎকণ্ঠার (ক্লাইমেক্স) জন্ম দিয়েছে, তাকেই তো সোভিয়েত পরিচালক আলেকজান্ডার ইয়াকোভলেভিচ তাইরভ (১৮৮৫-১৯৫০) বলেছেন ‘ওমট্ট্যালেনি’, রাশিয়ান ভাষায় যার অর্থ ‘অদ্ভুত’। অনেক ধরনের থিয়েটার আছে। যেমন রিয়ালিস্টিক থিয়েটার, ন্যাচারালিস্টিক থিয়েটার, পপুলার থিয়েটার, চিকানো থিয়েটার, এপিক থিয়েটার, ব্রডওয়ে থিয়েটার, রেপার্টরী থিয়েটার, সিনথেটিক থিয়েটার-এমনি ৪৪টি নাম পাওয়া যায়। ‘ফ্রেইডা’কে নিয়ে ইসরাফিল শাহীনের কর্মযজ্ঞকে আমরা কোন থিয়েটারের অঙ্গীভূত করব? একেবারে সোজা সাপটা উত্তর: সিনেথেটিক থিয়েটার। কারণ এ ধরনের থিয়েটারের রূপকল্প হচ্ছে শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যম বা আঙ্গিকের সম্মিলন ঘটানো। ১৯১৪-১৯৩৬ এই সময়কালে সিনথেটিক থিয়েটারের ব্যাপক প্রচলন ছিল। এর জনক একটু আগে যার নাম উল্লেখিত হয়েছে-আলেকজান্ডার তাইরভ। যিনি স্তানি সøাভস্কি, মেয়ারহোলদের মতাদর্শ থেকে বেরিয়ে গড়ে তোলেন সিনথেটিক থিয়েটার। এতে সমন্বয় ঘটানো হয়েছিল অপেরা, সার্কাস, ব্যালে, নৃত্য, কমিকস সঙ্গীত-এসবের। রাতিনের ‘ফ্রেইডা’ ১৯২২ সালে সিনথেটিকের আদলে মঞ্চে নিয়ে আসেন তাইরভ। সেই স্তানি সøাভস্কির যুগেও দর্শক দেখলেন নতুন নাট্যভাষা, মঞ্চে অভিনেতা অভিনেত্রীদের বাক্ভঙ্গি, অঙ্গভঙ্গি, চলন-সবটাতে এক নতুন রূপছন্দ। তাইরভের প্রযোজনার ৯৫ বছর পর ইসরাফিল শাহীনের নির্দেশনায় ঢাকায় যখন আমরা নাটকটি দেখছি, বেশ লক্ষ্য করছিলাম সিনথেটিক থিয়েটারের সমস্ত উপাদান দিয়ে অর্থাৎ দেশজ আঙ্গিকের বিভিন্ন ধারা, যেমন-পালাগান, পুঁথি পাঠ, যাত্রা, কথক, ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র ও আবেগাশ্রয়ী আবহসঙ্গীতের সুর মূর্ছনায় এক চিরায়ত নাট্যসাহিত্য উন্মোচিত হলো যেন। নাট্য কাহিনীতে দেখা যায়, এথেন্সের রাজা থিসিয়াসের ঔরসজাত পুত্র হিপোলিটাসকে গভীরভাবে ভালবাসে তার সৎমা রানী ফ্রেইডা। কিন্তু হিপোলিটাসের মন পড়ে আছে এরিসিয়াসের দিকে। যাকে সবাই রাজবংশের শত্রু পক্ষীয় উত্তরাধিকারী বলে জানে। এদিকে দীর্ঘদিন রাজা থিসিয়াস রাজ্যে অনুপস্থিত। রাজনীতির কোলাহল আর বিদ্বেষের হলাহলে প্রজারা আকণ্ঠ নিমজ্জিত। একসময় রাজার প্রত্যাবর্তন ঘটে। সৎপুত্রের প্রতি তার বিবাহিত স্ত্রীর প্রগাঢ় ভালবাসা দেখে হিপোলিটাসকে অভিশাপ দিতে উদ্যত হলে ফ্রেইডা বিবেকের তাড়নায় তাকে বাঁচাতে আসে। ঘটনার চরম মুহূর্তে ফ্রেইডা যখন জানতে পারল হিপোলিটাস এরিসিয়াকে বিয়ে করতে চায় তখনই সে আত্মহত্যা করে এবং বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর আগে হিপোলিটাসকে এক ‘অপাপবিদ্ধ মন’ বলে স্বীকারোক্তি দিয়ে যায় ফ্রেইডা। একেবারে শেষে অর্থাৎ যবনিকা মুহূর্তে কোরাসের মধ্য দিয়ে কুশীলবদের বয়ানে রাধাকৃষ্ণের প্রসঙ্গ উঠে আসে। বিষয়টি নিয়ে অবশ্য কেউ কেউ ভিন্নমত পোষণ করেন। তবে মনে হয়, বিয়োগান্তক পরিণতিতে মানব-মানবীর প্রেমানুভূতির চিরন্তন সৌন্দর্য শ্যাম-রাাধিকার মধ্য দিয়ে নির্দেশক হৃদয়ে ধারণ করেছেন। যাই হোক, ‘সাঁঝবেলার বিলাপ’ নাটকটিতে নির্দেশকের শিল্পচাতুর্যের প্রকাশ ঘটেছে বলা যায়। এটি এ সময়ের এক অনন্য নাট্য প্রয়াস বলেও অভিহিত হতে পারে। এটি একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রযোজনা। মূলধারার বাইরে এমএ সমাপনী পরীক্ষার শিক্ষার্থীরা এতে অভিনয় করেছেন। বলা চলে এটি পরীক্ষামূলক। তবে মূলধারার নতুন প্রজন্ম এই প্রযোজনা দেখলে উপকৃত হবেন। কেননা শিক্ষাপ্রণালীর বাইরেও নির্দেশকের বহুমাত্রিক অভিনয়ের কনসেপ্ট ছাত্রছাত্রীরা অনুসরণ করার চেষ্টা করেছেন। এ নাটকের কুশীলবরা হলেনÑ ফ্রেইডা-আফরিন তোড়া, হিপোলিটাস-ধীমান বর্মণ, থিসিয়াস-ইশতিয়াক পাঠান, এরিসিয়া-নাসির, ইনোন-সওগাতুন ইসলাম হিমেল, টেলোপি-সাফওয়ান এবং শিক্ষাগুরু থেরামেনেস ও বর্ণনাকারী ছিলেন ইলিয়াস। শাহমান মৈশানের গীত রচনা ও ড্রামাতুর্গ, সাইদুর রহমান লিপন ও কাজী তামান্না হক সিগমার সঙ্গীত ও সুর এবং অমিত চৌধুরীর দেহ বিন্যাস এ নাটকের আবেদন বিস্তৃত করেছে। তবে দু’একটি বিচ্যুতি যে নেই, এটা বলা যাবে না। সামান্য ত্রুটিগুলো মঞ্চায়ন অব্যাহত থাকলে কেটে যাবে।
×