ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

তারুণ্যের হাতে ফ্রান্সের নেতৃত্ব

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ১০ মে ২০১৭

তারুণ্যের হাতে  ফ্রান্সের নেতৃত্ব

অনেকটা যেন রূপকথার মতোই। এলেন দেখলেন জয় করলেন। কথাটি সত্যিকার অর্থেই প্রযোজ্য সাবেক ব্যাংকার সদ্য নির্বাচিত ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর ক্ষেত্রে। মাত্র ৩৯ বছরের ফ্রান্সের সবচেয়ে কম বয়সী প্রেসিডেন্ট। সম্প্রতি তার হাতেই ন্যস্ত হয়েছে ফ্যান্সের ভাগ্য। তিনি অবশ্য ফ্রান্সকে নতুন পথ দেখাবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। সন্ত্রান নির্মূলসহ যে কোন অশুভ শক্তি ঠেকাতে তিনি সোচ্চার থাকবেন। তিনি বলেন, যেসব শক্তি ফ্রান্সকে বিভক্ত করে অবদমিত করে, তার বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশের জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে ওঠার আশা প্রকাশ করেছেন ম্যাক্রোঁ। নির্বাচনের প্রাথমিক ফলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরই প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামের সামনের সমাবেশে বিভক্তির রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা, জনগণের শঙ্কা দূর করে তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সবাইকে হওয়ার ঘোষণা দেন ম্যাক্রোঁ। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে ম্যাক্রোঁ পান ৬৬ দশমিক ১ শতাংশ এবং তার প্রতিপক্ষ লো পেন পান ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট। আর এতেই বিভক্তি ঘটে যায় দুই দলের মধ্যে। নাম লেখান নতুন এক ইতিহাসের পাতায়। ফ্রান্সবাসী এর আগে এত কম বয়সী প্রেসিডেন্ট দেখেনি। ম্যাক্রোঁ বলেন, তিনি জনগণের ক্ষোভ, হতাশা এবং উদ্বেগের বিষয়টি বোঝেন এবং তিনি মনে করেন এ সবের কারণেই ভোটাররা কট্টরপন্থী প্রার্থীকে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। এ হুজুগ তিনি থামাতে চান। ওদিকে, বিভক্তি দূর করে ঐক্য গড়ার প্রশ্নে ম্যাক্রোঁ বলেন, ‘আমি আপনাদের ক্ষোভ, উৎকণ্ঠা, শংসয়ের কথা শুনেছি। যেসব শক্তি ফ্রান্সকে বিভক্ত করে অবদমিত করতে চায়, আমি সেই সব শক্তির বিরুদ্ধে লড়ব। আমি জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা... এবং ইউরোপের সুরক্ষারও নিশ্চয়তা দেব।’ রবিবার ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ম্যাক্রোঁ শপথ নেবেন বলে জানিয়েছেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁন্দ। সমর্থকদের উদ্দেশে বিজয়ী ভাষণে ম্যাক্রোঁ বলেছেন, ‘ফ্রান্সের মানুষ আমাকে বিশ্বাস করে নির্বাচিত করেছে। এটি অনেক সম্মানের। আজ আপনারা জিতেছেন, ফ্রান্স জিতেছে। সবাই আমাদের বলছিল এটি অসম্ভব। কিন্তু তারা ফ্রান্সকে জানে না’ ভাষণে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কোন কিছুতেই আমাদের সামর্থ্য, শক্তি কিংবা আন্তরিকতা বিসর্জন দেব না।’ মাত্র এক বছর আগে সরকারী পদ ছেড়ে নিজের রাজনৈতিক দল ‘এন মার্চ’ বা ‘এগিয়ে যাও’ গঠন করেই বাজিমাত করেন ম্যাক্রোঁ। সাবেক ব্যাংকার ম্যাক্রোঁ ফরাসী রাজনীতির প্রজন্ম বদলের দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়েছেন। যে রাজনীতিতে বছরের পর পর বছর ধরে কতগুলো পরিচিত মুখই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেছে। ম্যাক্রোঁর জয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) চালকের আসনে যারা আছেন তারা। কারণ ম্যাক্রোঁর প্রতিপক্ষ লো পেন নির্বাচিত হলে ব্রেক্সিটের পর ইইউ নাজুক পরিস্থিতিতে নতুন করে তার কট্টর নীতির মুখে পড়ত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এর আগে এক টুইটে লো পেনের প্রশংসা করলেও পরে ম্যাক্রোঁর বিপুল জয়কে অভিনন্দন জানান এবং তার সঙ্গে কাজ করার অপেক্ষায় আছেন বলেও জানিয়েছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বলেছেন, ‘সন্ত্রাস এবং সহিংস চরমপন্থার ক্রমবর্ধমান হুমকির মধ্যে আন্তর্জাতিক তার প্রথম চ্যালেঞ্জই হবে ফ্রান্সে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। ম্যাক্রোঁ একটি বিভক্ত জাতির দেশে জয় হাসিল করেছেন। যেখানে অর্ধেক ভোটারই কট্টরপন্থী প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে। ম্যাক্রোঁ নিজেও জানেন যে, অনেক ভোটারই কেবল লো পেনের বিজয় ঠেকাতে তার পক্ষে ভোট দিয়েছে। ফলে সামনের দিনে পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভোটারদের এ সমর্থন ম্যাক্রোঁ নাও পেতে পারেন। ১১ এবং ১৮ জুনে অনুষ্ঠিত হবে ফ্রান্সের পার্লামেন্ট নির্বাচন। ম্যাক্রোঁকে এখন তার উত্থানকে পার্লামেন্টে তার দলের শক্তিশালী উপস্থিতির জন্য কাজে লাগানোর কাজ করতে হবে। এ জন্য দলের পক্ষ থেকে জোরেশোরে প্রচার চালাতে হবে তাকে। কারণ, খুব অল্প দিন হলো গড়ে ওঠা ম্যাক্রোঁর দলের এখনও পার্লামেন্টে উপস্থিতি নেই। দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারলে মাক্রোঁকে জোট গড়ার পথে যেতে হতে পারে। এ ছাড়াও আছে ম্যাক্রোঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণের নানা চ্যালেঞ্জ। সরকার ব্যয় কমানো, বেকারত্ব কমানো ছাড়াও শ্রম আইন শিথিল করা এবং স্বকর্মে নিয়োজতদের নতুন করে সুরক্ষা দেয়ার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করতে হবে তাকে। ফ্রান্সের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল বামপন্থী সমাজতান্ত্রিক ও মধ্যডানপন্থী রিপাবলিকান দলের প্রার্থীকে হারিয়ে এবং রান অফে কট্টর ডানপন্থী প্রার্থীর চাইতে অনেক বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন ম্যাক্রোঁ। প্রাথমিকভাবে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন মধ্যডানপন্থী রিপাবলিকান প্রার্থী ফ্রাঁসোয়া ফিয়োঁ। কিন্তু নির্বাচনের মাত্র মাস দুয়েক আগে তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ এবং তা নিয়ে তদন্ত শুরু হওয়ায় বেকায়দায় পড়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ফিয়োঁ। ফিয়োঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী স্বামীর প্রভাব খাটিয়ে পার্লামেন্টারি এ্যাসিস্ট্যান্স হিসেবে কাজ না করেই বেতন তোলার অভিযোগ উঠেছে। পাদিস বলেন, ‘তিনি (ম্যাক্রোঁ) খুবই ভাগ্যবান, তিনি এমন একটি পরিস্থিতিতে লড়াই করেছেন যা ফ্রান্সের রাজনীতিতে পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত।’ তবে ভাগ্যই সব ছিল না। ম্যাক্রোঁ নিজেও গুরুত্বপূর্ণ সময়ে খুব কৌশলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি চাইলে সমাজতান্ত্রিক পার্টি থেকেও প্রার্থী হতে পারতেন। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা দলটির জনপ্রিয়তা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। বিশ্লেষক পাদি বলেন, ‘তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, যখন কাউকে দিয়েই কাজ হচ্ছে না তখন (নতুনরা) সুযোগ পাবে।’ তাছাড়া, ম্যাক্রোঁ যখন রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তখন ইউরোপের দেশগুলোতে রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। ২০১৬ সালের এপ্রিলে ‘এগিয়ে যাও’ নামে একটি আন্দোলনের সূচনা করে ফ্রান্সের জনগণকে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন ম্যাক্রোঁ। ওই আন্দোলন শুরুর মাত্র চার মাস পর প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁন্দ সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। ‘এন মার্স’ (এগিয়ে যাও) আন্দোলনের মাধ্যমে একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে ভোটারদের কাছাকাছি গিয়ে দেশের রাজনীতি সম্পর্কে তাদের মতামত জানেন ম্যাক্রোঁ। প্যারিসভিত্তিক এক সাংবাদিক বলেন, ‘তিনি তার স্বেচ্ছাসেবক দলকে দেশজুড়ে প্রায় তিন লাখ পরিবারের দরজায় পাঠান।’ ‘পরবর্তীতে নির্বাচনী প্রচারের কৌশল ঠিক করতে যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।’ প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া অলন্দের কাছে পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া ‘নবাগত’ ম্যাক্রোঁ ব্যাংকার থেকে ওলাঁন্দ সরকারের অর্থমন্ত্রী বনে যান।নিজের আন্দোলন চালিয়ে নিতে ক্ষমতাশালী ওই পদ থেকে সরে দাঁড়ান ম্যাক্রোঁ। রান অফ প্রতিদ্বন্দ্বী মাঁরিয়ে লো পেন তার গায়ে ওলাঁন্দের মতো অভিজাতদের নেতা তকমা লাগানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ম্যাক্রোঁ খুবই সফলভাবে নিজের গায়ে আরেকজন ওলাঁন্দের তকমা লাগতে দেননি। বরং দেশবাসীকে সফলভাবে নতুন কিছু আগমনের স্বপ্ন দেখান তিনি। চলমান ডেস্ক সূত্র : বিবিসি
×