ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সব্যসাচী দাশ

প্রাণ ভরিয়ে...

প্রকাশিত: ০৭:০২, ৫ মে ২০১৭

প্রাণ ভরিয়ে...

মাস কয়েক আগের ঘটনা। এক দম্পতি, বয়স ষাটোর্ধ। নিয়মিত প্রাতঃভ্রমণে বের হন। সাধারণ আর পাঁচটা ভোরের মতোই তাঁরা বের হয়েছেন। তবে অন্যদিনের থেকে একটু আগে। শেষ রাতের ঘুম এ্যালার্ম বাজার আগেই ভেঙ্গে যায়, বিছানায় অলস না থেকে ওই দিন একটু আগেই তারা বেরিয়ে পরে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে তাঁরা বুঝতে পারে, পৃথিবীতে সূর্যের আলো পৌঁছাতে এখনও বেশ দেরি। এ জন্য কোন বিরক্তি তাদের ছিল না। নির্ঘুম বিছানায় গড়াগড়ির থেকে ভোরের পূর্ব ভাগ উপভোগ করা ভাল। এই ভেবে জোর কদমে আবছা আঁধরের চাদর সরিয়ে দম্পতি হাঁটতে শুরু করলেন। ক্ষাণিক বাদে তারা পৌঁছে গেলেন ভ্রমণের পিঠ পার্কের উদ্যানে। এর মধ্যে রবী কিরণ বৃক্ষরাজির উচ্চদেশে অপরিষ্কার চাদর মেলেছে। পাখিকুল ঘুম থেকে জেগে নিজেদের সাংসারিক আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে। পার্কের যে কোনায় একাধিক বৃক্ষরাজির সমাবেশ সেখানে নির্ভয়ের আবছা অন্ধকার তখন বর্তমান। এমনি আলো আঁধারির বিশুদ্ধ ক্ষণে দূর থেকে ভেসে এলোÑ ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা... পরের লাইন ছিল গায়কের মতো রুগ্ন। গায়ক উনিশ-কুড়ি বছরের যুবক। শেষ রাতে পার্কের মাঠে, গাছের গোড়ায় এবং বেঞ্চের ওপর ভ্রমণকারীদের ফেলে যাওয়া পানির বোতল কুড়াতে বেড়িয়েছে। রাত্রির গর্ভে নতুন ভোরের জন্মক্ষণে নামহীন, পরিচয়হীন এক যুবকের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের দেশের গান ভাবনার সুমুদ্রে ফেলে দেয়, হাঁটতে আসা দম্পতিকে। ওই মুহূর্তে তারা বিস্ময়ের কোন কিনারা পায় না। এই ছিন্নমূল মানুষটির কাছে রবীন্দ্রনাথ পৌঁছাল কি করে? ভাঁজ পড়া চিন্তার রেখা তাদের কপালে। যাই হোক রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টি নিয়ে কারও কাছে দ্বারস্থ হননি। মানুষই অজন্ম তৃষ্ণা নিয়ে যুগে যুগে তাঁর সৃষ্ট অমিয় সুধা পান করেছে। নিশ্চই তিনি অমরত্বের অমৃত পান করেছিলেন! যে কারণে তার নিজের প্রতি বিশ্বাস ছিল অবিনশ্বর আত্মা হতে প্রাপ্ত। তিনি জানতেন যা তিনি রেখে যাচ্ছেন তার পানে মনুষ্যজাতকে ফিরতেই হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৃষ্ট শিল্প সাহিত্যের সব শাখায় সকলকে দ্বারস্থ না হলেও তাঁর সঙ্গীতের দরজায় সকলকে দাঁড়াতে হবে। প্রবেশ করতে হবে তাঁর মনোমুগ্ধকর অমিয় সুর ও বাণীতে। সমগ্র মানবজাতির কথা বাদ দিলাম। পৃথিবীতে যত সংখ্যক বাংলা ভাষাভাষী মানুষ রয়েছে, সকলেই জীবনের কোন না কোন ভাগে তাঁর গান শুনেছেন কিংবা মনের অজান্তে বেসুরে ক্ষাণিক গেয়েছেন। জীবদ্দশায় সুরের কি এক অমৃত সুধা ঢেলে গিয়েছেন যা আজও আমরা আকণ্ঠ পান করছি। কী দর্শন তাঁর সৃষ্ট সুর ও কথায় যা আমরা সকলেই ধারণ করে চলেছি। রবীন্দ্রনাথের দর্শনে স্রষ্টার অরূপ সব সময় বর্তমান। তার মননে মানুষ হচ্ছে সেই অরূপের আংশিক অবয়ব। তাঁর লেখা সহস্র গানের (১৯১৫) ভিন্ন ভিন্ন সংজ্ঞা থাকলেও বেশির ভাগ তিনি লিখেছেন স্রষ্টাকে উদ্দেশ করে। কখনও কমল সুরে, কখনও অভিমানের সুরে, কখনও নিজেকে গানের মধ্যে বিলিনের চেষ্টায়। কোথা থেকে এলো তার এই সুর সৃষ্টির বাণী? মহেঞ্জোদাড়ো সভ্যতায় সঙ্গীতবিদ্যার চিহ্ন স্পষ্ট ছিল। সেদিক থেকে প্রাগ-ঐতিহাসিক যুগে উপমহাদেশে যে সঙ্গীতের চর্চা হতো তা স্পষ্ট। আধুনিক বাঙালী পরিবারগুলোর মধ্যে ঠাকুর পরিবার অন্যতম। শিক্ষা দীক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে এবং একেঈশ্বর চিন্তাধারায় এই পরিবারটি ছিল অদ্বিতীয়। পরিবারটিতে দুইটি সাংস্কৃতিক প্রচলন ছিল। একটি রামমোহনী বা ব্রাহ্মধারা, দুই পাশ্চাত ধারা। এর মধ্যে ব্রাহ্মধারার সঙ্গে ফিউসন ঘটিয়ে পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারের মুখ সব থেকে উজ্জ্বল করেছেন। এই রবীন্দ্রনাথ জ্ঞান অর্জনের জন্য কখনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের চেষ্টা করেও গ্রহণ করতে পারেননি। এ কথা সকলেই জানে। বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ভ্রমণপিপাসু। বাবার সেই ভ্রমণপিপাসা রবীন্দ্রনাথকেও পেয়ে বসেছিল। যার ফলে পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত তিনি সমানে চষে বেড়িয়েছেন। তার সুর সৃষ্টির তৃষ্ণা মূলত পৃথিবীর তাবত সঙ্গীতের সঙ্গে সখ্যর ফল। সঙ্গীতের বেশির ভাগ উৎকৃষ্ট সুর তিনি সংগ্রহ করেছেন ইউরোপীয় সঙ্গীতের সকল রসভোগ থেকে। এ প্রসঙ্গে তাঁর জীবনস্মৃতি গ্রন্থে আত্মস্বীকৃতি আছে ‘আমি যথার্থই ইউরোপীয় সঙ্গীতের রসভোগ করিয়াছি তখনই বারম্বার মনের মধ্যে বলিয়াছি ইহা রোমান্টিক, ইহা মানবজীবনের বিচিত্রতাকে গানের সুরে আনুবাদ করিয়া প্রকাশ করিতেছে। আমাদের সঙ্গীতে কোথাও কোথাও সে চেষ্টা নাই যে তাহা নহে, কিন্তু সে চেষ্টা প্রবল ও সফল হইতে পারে নাই।’ এহেন তাঁর সঞ্চিত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি থেকে মানবজীবনের বিচিত্রতা নিজেস্ব ধারায় রচিত করেছেন, সঙ্গে আধ্যাত্মবাদের চেতনা। তাঁর লেখা গানে প্রেম, পূজা, প্রকৃতি ও স্বদেশ প্রেম আলাদা আলাদাভাবে উপস্থিত থাকলেও জগদ্বীশ্বরের লীলা সব সময় লক্ষণীয়। এ কাথা তাঁর সকল গানে স্পষ্ট প্রতীয়মান। বাঙালীর সকল কাজে রবীন্দ্রনাথ আপাদমস্তক বিরাজিত। যে, কারণে বুঝে না বুঝে কখন যে তাকে ধারণ করছি, আর কেনই বা ধারণ করছি সে উত্তর পাওয়া আমাদের পক্ষে সত্যই কঠিন! সব থেকে তাঁর গানই আমাদের, তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। পরিচয় করিয়ে দেয় আধ্যাত্মবাদ দর্শনের সঙ্গে, যে দর্শন তাঁর অন্যান্য কীর্তি থেকে পরিষ্কার। সেই গান-ই আমরা দিন দিন শুনে চলেছি, অজান্তে গেয়ে চলেছি, সমাজের মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত। উচ্চবিত্তের ক্ষেত্রে বিষয়টা সংকীর্ণ বলা যায়! তাই তো ভোরের চতলা আঁধারে আমাদের মধ্যবিত্ত শুনেছে একেবারে নিম্নবিত্তের কণ্ঠে তারই গানের কথা। যে কারণে প্রথমে বিস্মিত হলেও পরে বিষয়টা তাদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো এটাই চেয়েছিলেন! সঙ্গীতের মাধ্যমে স্রষ্টার সান্নিধ্য তুমি যদি না দেখা দাও, করো আমায় হেলা, কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল বেলা। মানব জীবনে সুখ, দঃখ আনন্দ-বেদনা কিংবা এর বাইরেও যত রকম অনুভূতি আছে হয়ত সবই রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছেন! মনুষ্য জীবনের বিচিত্র অনুভূতিকে ঠাঁই দিয়েছেন তার সৃষ্টিকর্মে। তাঁর লেখা গানে এমন দৃষ্টান্ত সব সময় স্পষ্ট। সমাজ ও সংসারে মিছে সব/মিছে এ জীবনের কলরব/কেবলই আঁখি দিয়ে আঁখিরও সুধা পিয়ে/হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব। গানের এই অংশে তাঁর ধারণ করা দর্শনের এক রকম পরিষ্কার সংজ্ঞাই বলা চলে। হৃদয় দিয়ে হৃদয় অনুভব অর্থাৎ নিজেকে জানার নিরন্তর চেষ্টা। মানবজীবনের গভীর পরিমিতিবোধ সঙ্গীতিক রসচেতনায় তিনি জানিয়েছেন। সুখে ছিলেম আপন মনে/মেঘ ছিল না গগন কোণে-লাগবে তরী কুসুম বনে/ছিলেম সেই আশায়... আশা মানুষের আয়ুষ্কাল দীর্ঘ করে, আশার তরী বেয়ে মানুষ যে, একদিন কুসুম বনে ঠাঁই পাবে , সাধারণের মতো তিনিও সেই আশাই ব্যক্ত করেছেন। মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না/ কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে, তোমারে দেখিতে দেয় না। মানব মন ক্ষণিকে পুলকিত হয়, আবার ক্ষণিকে অস্তমিত! সংশয়ের কালো মেঘ, মোহের কালো ছায়া সত্যকে ঢেকে রাখে। স্রষ্টার আশীষ ছাড়া এই মেঘ সরানো সম্ভব নয়। যদি না স্রষ্টা চান! তাই তো লিখেছেন তোমায় নতুন করে পাবো বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ ও মোর ভালবাসার ধন..ঈশ্বর বন্দনায় লিখেছেন তোমার আলোয় নাই তো ছায়া, আমার মাঝে পায় সে কায়া,/হয় সে আমার অশ্রুজলে সুন্দরবিধুর/আমার মধ্যে তোমার শোভা এমন সুমধুর। নিজেকে সমর্পণ করেছেন হার মানা-হার পরাবো তোমার গলে-দূরে রবো কত আপনো বলের ছলে। যে বলেই আমরা দূরে থাকি না কেন, দিন শেষে তাঁর শ্রী চরণে আমাদের লুটাতেই হবে। আধ্যাত্মবাদের সব উপলব্ধি পূর্ণ করে লিখেছেন আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে/দেখতে আমি পাইনি তোমায়। তেমনি করে আমার মাথা নত করে দেও হে তোমার/ চরণধুলার তলে.. নিরাকারের সঙ্গে বিলীন হওয়ার এমন বহু গান তিনি অন্তর থেকে তুলে এনে আমাদের শুনিয়েছেন। স্পষ্ট করেছেন তাঁর আধ্যাত্মবাদের চেতনা। এছাড়া প্রেম, পূজা, প্রকৃতি ও স্বদেশ প্রেম অর্থৎ মানবজীবনের সকল রূপই তিনি সঙ্গীতে প্রকাশ করেছেন। যে কারণে তিনি বেঁচে আছেন, আমাদের সকল প্রয়োজনে। তাঁর প্রয়োজনে নয়।
×