ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পেখম মেলা বৈশাখী ঝড়ে বাড়ি ফেরা

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ২৮ এপ্রিল ২০১৭

পেখম মেলা বৈশাখী ঝড়ে বাড়ি ফেরা

কবির কাছে তার প্রথম গ্রন্থ উপাদেয় হয়ে ওঠে, সম্ভবত পরবর্তী গ্রন্থ প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত। নিজেকে প্রতিমুহূর্তে অতিক্রম করা কবির আরাধ্য। ‘হাঁড়ির একটি ভাত টিপলে যেমন বোঝা যায় সিদ্ধ হয়েছে কিনা’Ñ তেমনি প্রথম গ্রন্থেই স্পষ্ট হয়ে যায় কবির পথ রেখার দৃশ্যাবলী। কিংবা কবি হয়ে ওঠার রথযাত্রায় আরোহী হয়ে উঠছেন কিনা। কারও কবিতা পরিপত্র চমক জাগায়, আশাবাদ তৈরি করে প্রথম গ্রন্থেই। বোদ্ধার মননকে নাড়া দিয়ে যায়। বিশ্বাস বোধে মারে টান। চিন্তার দিগন্তকে করে প্রসারিত। বিস্তৃত করে ভাবনার জগতকে। সে রকম কবিতার স্বাদাস্বাদন একালে তেমন মেলে আর কই? কিন্তু তারপরও উঁকি দেয় ভবিষ্যতের কবির কাব্যবোধের সম্ভাবনাকে। চলতি প্রজন্মের কবিদের দৃষ্টি ও ভাবনার জগত পূর্বসূরিদের ধারাবাহিকতাকে ধারণ করে নতুন মাত্রা প্রদানে পিছপা নয়। এক অনিবার্য সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে এই প্রজন্ম। দাঁড়াচ্ছে তাদের ভার্চুয়াল জীবন। তথাপিও কবিতার পঙ্ক্তিতে উঁকি দেয় গনগনে আগুনের আঁচ। বৃষ্টির কলরোল, জীবনের সারাৎসার। কোন কোন কবির স্বর একেবারেই স্বতন্ত্র। নিজস্ব একটা ধারাকেও তুলে আনতে চায়। ফর্ম যা-ই হোক। ‘মৌনতায় লালফড়িং’ কবি নিয়াজ সজীবের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। একটি ভিন্ন স্বর ও মাত্রাকে ধারণ এবং দার্শনিক চেতনার স্তরকে উন্মিলিত করে অনবদ্য সৃষ্টি প্রকাশ পেয়েছে গ্রন্থের কবিতাবলীতে। অভাবিত যে, গ্রন্থভুক্ত বিয়াল্লিশটি কবিতাই নামহীন। প্রতিটি কবিতাই পৃথক, স্বতন্ত্র এবং প্রতিটিই এক একটি দর্শনকে ধারণ করে আছে। আয়তনে হ্রাস কবিতার মধ্যে একটা বিরাট প্রশ্নকে যেমন সামনে মেলে ধরে, তেমনি গাণিতিক সূত্রকে ধারণ করে জীবন বিপাকে প্রকটিত করেছেন ফরিদপুরে জন্মজাত কবি নিয়াজ সজীব। ফরিদপুর বংশজাত আরেক কবি বিনয় মজুমদার তাকে স্পর্শ করে গাণিতিক নিয়মেই সম্ভবত। সজীবের কবিতা যেন এক দীর্ঘ স্রোত থেকে হ্রাস ঢেউয়ের মধ্যে কলরোল তোলে শব্দহীন। তার কবিতাসমূহের ভাব ও অর্থের মধ্যে কবির জীবনের সঙ্গেই জড়ানো প্রাণের মহত্ত্বপূর্ণ শক্তির পরিচয় নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে। বলেছেনও অবলীলায়। ‘নিঃশব্দ শিকারির চেয়ে আর কে বেশি চেনে মানুষকে?’ এমনকি কথকের বর্ণিত কাব্যবস্তুতে ব্যক্তিগত আবেগের চেয়েও মহাজীবনের গতিবেগই প্রাধান্য পেয়েছে। ফলে তার কবিতা ঈষৎ ভারে আক্রান্ত। ‘এখানে দ্রুতির চেয়ে মননের দীপ্তি বেশি’ বলে কবি লিখতে পারেন ‘একটা অর্থহীন লকলকে বাতাস আটকে থাকা মনুষ্যকানন।’ তার এই কাননে ‘ভাত একমাত্র মৌলিক বিশ্বাস।’ এই বিশ্বাসবোধে আপ্লুত মানুষ খোঁজে দু’বেলা দু’মুঠো। যদিও কবি মনে করেন ‘মানুষের কোন বিধিবদ্ধ স্বভাব থাকতে নেই।’Ñ নিয়াজ সজীবের কবিতা পাঠে মনে হয় জগত ও জীবন সম্পর্কে তার এক নিজস্ব স্পষ্ট দর্শন রয়েছে। সুস্পষ্ট কিছু চিত্র পাওয়া তিনি পরিপ্রেক্ষিতটিকে স্বচ্ছন্দে সাজাতে জানেন। তার কবিতায় একটি দুটি তিনটিসহ সব কণ্ঠই তার স্বরারোপে একাকার রূপ ধারণ করে। নিত্য নবায়নমান সত্যে তার প্রত্যয় নেই। ‘মনুষ্য স্বত্ব দরকার আছে কী? বলে অনায়াসে প্রশ্ন তোলেন তিনি। তাই তার কবিতা কখনও দ্বিধায় বিভক্ত নয়। দীর্ণ নয় স্ববিরোধে। বলেনও ‘প্রতœ পালকে শহরে আমরাই শেষ রক্তের বিশ্রামাগারে।’ কবি নিয়াজ বিশ্বাস করেন কবিতার কাজ সমবেদনা জানানো বা মুক্তির পথ প্রদর্শন নয়। বরং মানুষ যে অবস্থায় আছে, তারই অকপটে প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। ‘পাওয়ার মহোৎসবে সৃষ্টিকর্তা থাকে না’ বলে কবির আক্ষেপের একটা কারণ অবশ্যই রয়েছে। যেহেতু ‘চাঁদ ও সূর্য প্রতিদিন মরে পরজন্মের আশ্বাসে’Ñ তাই কবি দেখেন ‘চমৎকার বাঁচা-মরা খেলা।’ কবিতায় সজীবের উদ্বেলিত বোধও নিজেকে উন্মোচনের আয়াস পাওয়া যায়। প্রাণের মহত্ত্বপূর্ণ শক্তির প্রকাশ, জগত ও জীবন সম্পর্কে নিজস্ব দর্শন, তাৎক্ষণিক ঘটনা এবং তার প্রতিক্রিয়ার আবেগ গ্রন্থে বিধৃত। মন ও মননের যুগ্ম সংবেগে নিয়াজের কবিতায় উঠে এসেছে বৈচিত্র্যময়তা। এমন বৈচিত্র্য ও দার্শনিকতার দৃশ্যপট দৃশ্যমান হয়। প্রশ্ন জাগে কবিরও, ‘সাদা হয় না কোন জাক রং।’ কিংবা ‘শূন্যতার যোগফল একাধিক হতে পারে।’ এখানেই কবিকে পাওয়া যায় চেতন-অবচেতনের মধ্যে থাকা জগতে। এই জগত প্রসারিত হয় যখন তিনি লেখেন। পাখিরাই প্রথম ঠোঁটের ব্যবহার শেখানো পুরুষ। শব্দ ব্যবহারে অনুভূতির প্রাণ প্রতিষ্ঠায় নিয়াজ সজীব নির্লিপ্ত এবং অন্তর্মুখী আবরণেরও আশ্রয় নিয়েছেন, ঋজুভঙ্গিমায় উচ্চারণ করেন সখেদে। ‘এত জেরা করতে জানো, অথচ সিরিয়াল অনুযায়ী কখন কোথায় হাত দিতে হয় জান নাÑ’ এখানেই নিয়াজ সজীব নিজস্ব বলয় তৈরি করে একটি স্বতন্ত্র কণ্ঠে পরিণত হয়েছেন। পেশায় টেলিভিশন সাংবাদিক নিয়াজ এক সময় ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতিতেও সক্রিয় ছিলেন। তাই কবিতায় ক্ষোভ-বিক্ষোভেরাও নড়াচড়া করে। লালফড়িংয়ের পিছু পিছু ছুটে চলা কিশোর থেকে তরুণে পরিণত হওয়া কবির কাছে সেই ফড়িং এখন মৌনতার সুতো বোনে। চিন্তা-চেতনার ভেতর উচ্চমার্গীয় ধারণা বসবাস করে বলেই নিয়াজ সজীব নতুন চিন্তা-চেতনা ও মননের দিগন্ত উন্মোচন করে নিজের শক্তিমত্তা ও কাব্যবোধকে সঞ্চারিত করেছেন পাঠকের মননেও। গ্রাম ও নগর তাঁর কাছে প্রতিভাত হয় এক অনন্যবোধে। যেখানে ‘পড়ন্ত বিকেল মেঘে নিজের সঙ্গে পুষ্পের বিনিময়’ করেন। কিংবা স্বপ্নের পেখমমেলা বৈশাখী ঝড়ের বাড়ি ফেরার জন্য অপেক্ষায় থাকেন। প্রথম গ্রন্থেই তিনি পাঠককে আশাবাদী করে তুলেছেন একজন শক্তিশালী কবির প্রারম্ভিকতার কাব্যবোধেই। শূন্য দশকের কবি নিয়াজ সজীব আরও উপাদেয় এবং মননশীল কবিতার ভা-ার নিয়ে পাঠক দরবারে হাজির হবেন, এমন প্রত্যয় জাগে।
×