ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

একটি ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বাড়ি

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ২১ এপ্রিল ২০১৭

একটি ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বাড়ি

আগেই জানতাম এই অঞ্চলে অনেক মাজার, মন্দির, হেরিটেজ এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন আছে। সময় বের করে, ওগুলো দেখতে হবে। এক সময়, একজন ভাল গাইডও পেয়ে গেলাম। স্থানীয় একটি কলেজের পরিসংখ্যানের শিক্ষক। ঢাকায় এবং রাজশাহীতে পড়াশোনা করেছেন। বয়সে তরুণ। বেশ প্রাণবন্ত। তার সঙ্গে হোন্ডায় করে বিভিন্ন মাজার, মন্দির এবং ঐতিহাসিক জায়গাগুলো পরিদর্শন করতে শুরু করি। ঢাকার বাইরে যে বিশাল বাংলাদেশ, তার পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক নিদর্শন, হেরিটেজ, মাজার এবং মন্দির। এসব অঞ্চলে একদিন ধর্ম প্রচারকরা এসেছিলেন। তারপর এখানেই তাদের জীবনাবসান ঘটেছে। কালক্রমে তাদের স্মৃতিকে এলাকাবাসী অমর করে রেখেছেন। গড়ে উঠেছে মাজার। বছরের একটি বিশেষ দিনে ‘উরস’ অনুষ্ঠিত হয়, তখন দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তেরা এসে জড়ো হয়। সেখানে তখন মেলা বসে। গানবাজনার আয়োজন করা হয়। আধ্যাত্মিক গান, লালনের গান, ভক্তিগান সারারাত ধরে গাইতে থাকে শিল্পীরা। এসব শিল্পী ঢাকা থেকে আসেন গান গাইতে। আলোকরশ্মিতে ভরে ওঠে সমস্ত এলাকা। তিন থেকে সাতদিন এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। গেরুয়া পড়া সন্ন্যাসীরা এবং বাউলরা আসেন। নাঙ্গা ফকিরাও সমবেত হন। পুরু এলাকার চেহারা তখন বদলে যায়। এই এলাকায় বেশকিছু জমিদার বাড়িও আছে। এগুলো এখন প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। অট্টালিকা ধসে পড়েছে। দেয়ালে আগাছা আর শ্যাওলা জমেছে। লাল ইট দাঁত বের করে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। একদিন গাইড এ রকম একটি জমিদার বাড়িতে নিয়ে গেলেন। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আছি, সেখান থেকে হাঁটাপথে বিশ/পঁচিশ মিনিটের পথ। প্রবেশ পথে দেখলাম অবলুপ্তপ্রায় একটা বাউন্ডারি দেয়াল। একটা কারুকার্যময় তোরণ। কিন্তু সময়ের নিষ্ঠুর আঘাতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। গাইড আমাকে প্রবেশ পথের ভেতর দিয়ে মূল বিল্ডিংয়ে নিয়ে এলো। বিশাল অন্ধকার এক অট্টালিকার সামনে এসে দাঁড়ালাম। আমাদের অস্তিত্ব জানতে পেরে কয়েকটা কবুতর পাখাঝাপ্টে উড়ে গেল। একটা বাদুর অকারণে পাখা ঝাপ্টাল। গাইড হাঁকডাক দিল একজন যুবতী বের হয়ে এলো। নিচতলার ঘরের দরজা উন্মুক্ত। অট্টালিকাটি দোতলা। মেয়েটি গাইডের ছাত্রী। বললেন, স্যার আপনি এসেছেন? একটু খবর দিয়ে এলে ভাল হতো না।’ গাইড বলল, সঙ্গে অতিথি আছে। মেয়েটি সালাম দিয়ে ঘরে যেতে অমন্ত্রণী জানাল আমাদের। চারদিকে ভৌতিক পরিবেশ। ভাঙ্গা দেয়াল। ধ্বংসপ্রাপ্ত বিল্ডিং। ইলেকট্রিসিটি চলে গেছে। এ অঞ্চলে নিরন্তর বিদ্যুত চলে যায়। আমরা সে ঘরে গিয়ে বসলাম, সেখানে দেয়ালঘেঁষে একটি পড়ার টেবিল। দুটো চেয়ার। একটি চেয়ার টেনে বসতে দিল আমাকে। গাইড কালো অন্য নড়বড়ে চেয়ারে। গাইড বলল, নাবিলা তুমি পরীক্ষার ফরমফিলাপ করেছ? নাবিলা মাথা নিচু করল। বুঝতে আমার অসুবিধা হলো না, তার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। গাইডকে জিজ্ঞেস করলাম, ফরমফিলাপ করতে, কত লাগে? বেশি নয়, পাঁচ হাজার টাকা। বললেন, গাইড ও নাবিলার শিক্ষক। এককালের জমিদার, আজ তার বংশধর কী অর্থকষ্টে দিনযাপন করছে। পরীক্ষার ফি জমা দেয়ার টাকা নেই। আমার মনের ভেতর তখন গুঞ্জরণ হচ্ছে বন্ধু কবি আবুল হাসানের ‘রাজা যায় রাজা আসে।’ এই হচ্ছে মানুষের নিয়তি, এই মানুষের জীবন। চিরদিন মানুষের সময় একরকম যায় না। আজ যে রাজা, কাল সে পথের ভিখিরি। ইতিহাসে ভূরি ভূরি সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে। আমাকে আনমনা দেখে গাইড বললেন, স্যার আপনি কি যেন ভাবছেন? আমি বললাম, ভাবছি অনেক কিছু। ইতোমধ্যে চা-বিস্কিট এনে টেবিলে হাজির করল নাবিলা। ওর মা ভেতরের ঘরে ছিলেন, তিনি এসে বসলেন বিছানার ওপর। একটা কবুতর শব্দ করে পাশের কক্ষ থেকে উড়ে গেল বাইরে। চারদিকে কী রকম গা শিউড়ে ওঠা ছমছমে পরিবেশ। দিনের আলো নিভে আসছে ক্রমশ! নাবিলার মা গাইডকে বললেন, স্যার আপনি এসেছেন খুশি হলাম। আমার শরীরটা ক’দিন ধরে ভাল যাচ্ছে না। পায়ের ব্যথাটা আবার বেড়ে গেছে। গাইড বললেন, নাবিলা উপরের ঘরগুলো একটু ঘুরে দেখব। নাবিলা দ্রুত পাশের ঘর থেকে চাবি নিয়ে এলো। উঁচুখাড়া সিঁড়ি দিয়ে গাইডের পেছনে পেছনে তাকে অনুসরণ করে উঠতে লাগলাম। বেশ বড় ঘর। মেঝেতে খাই পাতা। কাঠের খরম দেখলাম। গাইড নাবিলাকে জিজ্ঞেস করল, চাচারা আসে? খুব কম। বছরে দু’-একবার আসে ঢাকা থেকে। বড় বড় তিনটি ঘর। সব ঘরে খাট ও বিছানা পাতা। ঢাকা থেকে জমিদারের শেষ বংশধরের কেউ এলে এখানে অবস্থান করেন। ঘরের দরজা বন্ধ করে পুরনো তালা লাগিয়ে দিল নাবিলা। হঠাৎ বিদ্যুত ফিরে এলে সবকিছু কী রকম যেন অপার্থিব মনে হয়। পুরু বিল্ডিংটার আশপাশে গাছপালা। অযতেœ বেড়ে উঠেছে সবুজ আগাছা। একটু দূরে বেশ বড় শান বাঁধানো পুকুর। ভাঙ্গা সিঁড়ি। সেখানে জমে আছে শ্যাওলা। পুকুরের পানি অস্বচ্ছ। সেখানে জমে আছে অসংখ্য কচুরিপানা। একটা বনজ গন্ধ ভেসে আসছে। একটু দূরে বেশ ক’টা বাঁধানো কবর দেখতে পেলাম। সেখানেও জমে আছে শ্যাওলা। কবরগুলোর চারদিকে শ্যাওলা এবং বন্য গাছপালায় ছেয়ে আছে। কবরগুলোর গায়ে কালো দাগ পড়েছে। অসংখ্য পাখির কলকাকলীতে চারদিক মুখব হয়ে উঠেছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাখির কলতান শুনলাম। পাখিরা নিড়ে ফিরে আসছে। দিন শেষ হয়ে এলো। অন্ধকার গ্রাস করছে পৃথিবীকে। আমরা ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরি হলাম। নাবিলার মা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সামনে এলেন। আমরা তার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। নাবিলাকে বললাম, তুমি লেখাপড়া চালিয়ে যেও। তোমার ফরমফিলাপের ব্যাপারটা আমি দেখছি। আমার আশ্বাস পেয়ে শ্যামল মেয়েটির চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার অসুস্থ মা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। আমরা মাটির রাস্তা ছেড়ে পিচঢালা রাস্তায় এসে পৌঁছলাম। গাইড বললেন, এই জমিদার বাড়িকে ঘিরে একটি কিংবদন্তি আছে। আমি আখ্যানটি শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলাম। গাইড বলতে শুরু করলেন : অনেক দিন আগে, তখন জমিদার বেঁচে ছিলেন। ঢাকার নবাব সৌজন্য সাক্ষাত করতে কার্তিকপুর এলেন। খাবারের আয়োজন করা হলো। বারান্দায় মেয়েরা লেবু কাটছে। নবাব বললেন, লেবু দিলেন না! জমিদার বললেন, লেবু আমরা খাবারের সঙ্গে খাই না। লেবুর গন্ধ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সৌরভ ছড়াই। সেই গন্ধ শুঁকে আমরা খাই। নবাব মুগ্ধ হলেন। কথিত আছে এই বাড়ির একটি মেয়েকে পরে নবাব বিয়ে করেন।
×