ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

ব্যবসায়ীরা কী বিদেশেই বিনিয়োগ করতে থাকবেন?

প্রকাশিত: ০৫:১০, ২৪ মার্চ ২০১৭

ব্যবসায়ীরা কী বিদেশেই বিনিয়োগ করতে থাকবেন?

প্রাক- বাজেট আলোচনায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অংশগ্রহণ করে নানা তথ্য-উপাত্ত ও পরামর্শ সংগ্রহ করছেন। সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে তার মতামতও প্রকাশ করছেন। এই তো গেল সপ্তাহে এক সভায় তিনি বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, তথ্য-বিভ্রাটের কারণে বাজেট করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। একেক উৎসের তথ্য একেক রকম, কোথাও সমন্বয় নেই। গ্রামাঞ্চলের জমি রক্ষার জন্য তিনি সেখানে বহুতল দালানের পক্ষপাতী বলে অর্থমন্ত্রী বলেন। শস্যবীমার ক্ষেত্রটি এখনও অবহেলিত বলে তিনি চিহ্নিত করেন। জমি ব্যবস্থাপনার বিষয়টিতে তিনি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন বলে উল্লেখ করেন। আবার জেলা বাজেটেও তিনি ব্যর্থ। তিনি বলেন, এটি করতে হলে প্রশাসনিক সংস্কার দরকার। অর্থমন্ত্রী আরও নানা বিষয়ে কথা বলেন। তবে এর মধ্যে আমার মতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা তিনি বলেছেন দুটো ক্ষেত্রে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে বিনিয়োগ। বেসরকারী বিনিয়োগের গন্তব্যস্থল একটি প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। তার মতে, এটা কালো টাকার উপস্থিতির কারণে। বেসরকারী বিনিয়োগকারীরা তাদের টাকা-পয়সা বিদেশে বিনিয়োগ করছেন। আরেকটি বিষয়ে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, যা আমার কাছে অনধিক গুরুত্বপূর্ণ। তার মতে অর্থনীতিতে আগামী দিনগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ, সারাবিশ্বে এখন ‘সংরক্ষণবাদ’ (প্রটেকশনইজম) মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আগে উল্লিখিত বিষয়গুলো আপাতত বাদ দিয়ে শেষের দুটো বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায়। বিশেষ করে বিনিয়োগের বিষয়টি। বিনিয়োগ মানে সরকারী বিনিয়োগ নয়। এ ক্ষেত্রে সরকার যথেষ্ট করছে। কথা হচ্ছে বেসরকারী বিনিয়োগ নিয়ে। এ ক্ষেত্রে কোন অগ্রগতি নেই। বরং দেখা যাচ্ছে উল্টো। বেসরকারী বিনিয়োগ দেশ ছেড়ে বিদেশে যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী দুঃখের সঙ্গে এ কথাই উল্লেখ করেছেন। তিনি নতুন কোন কথা বলেননি। এটাই বাজারের তথ্য, সবার জানা তথ্য। বাংলাদেশের বড় ব্যববাসীদের মধ্যে কার কার কোথায় বিনিয়োগ আছে তা ইন্ডাস্ট্রি সার্কেলে বহুল আলোচিত বিষয়। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বেসরকারী বিনিয়োগকারীরা এ কাজটি করে উল্টো সরকারের কাছে নানা দাবি তুলে ধরছেন। তারা বলছেন বিদ্যুত নেই, গ্যাস নেই, অতএব শিল্প হবে কোত্থেকে? এত ‘ইন্টারেস্ট’ দিয়ে কী শিল্প করা যায়? জমি নেই। জমি পাওয়া যায় না। জমির যা দাম তা দিয়ে শিল্প করলে এটা লোকসানী কারবার হবে। একদিকে তারা এসব বলছেন, অন্যদিকে তাদের অনেকেই বিদেশে বিনিয়োগ করে বসে আছেন। এদিকে আবার তাদের অনেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দরখাস্ত করে যাচ্ছেন অনুমতির জন্য। তারা বিদেশে বিনিয়োগ করতে চান। সিঙ্গাপুরে, মালয়েশিয়ায়, আফ্রিকায় তারা বিনিয়োগ করতে চান। খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশ ব্যাংক তাদেরকে অনুমতি দিচ্ছে না। বলছে নতুনভাবে উদ্ভূত পরিস্থিতির কথা। রেমিটেন্স কম আসছে। রফতানির পরিমাণ অর্থাৎ প্রবৃদ্ধির পরিমাণ কম। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ চাপের মধ্যে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক বড়জোর ‘রিটেনশন কোটায়’ কিছু পরিবর্তন আনতে পারে। এখানে বোঝার বিষয় একটা, দেখা যাচ্ছে দেশে বিনিয়োগ না করে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী বিভিন্ন কায়দায় বিদেশে বিনিয়োগ করছে। আবার তাদেরই কেউ কেউ বিনিয়োগ না হওয়ার জন্য নানা কারণকে চিহ্নিত করছে। এখন আবার তারা বিদেশের ‘কালো’ টাকা বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুবিধা চাইছেন। অথচ দেশে বেশকিছু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এসবের দিকে বিনিয়োগকারীদের কোন ভ্রƒপেক্ষ নেই। যেমন ব্যাংকে বিনিয়োগযোগ্য অর্থের হার এখন প্রায় এক অঙ্কে নেমে এসেছে। ব্যবসায়ীদের দাবি মোতাবেক ‘প্রাইভেটাইজেশন বোর্ড’ এবং ‘বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্ট (বি ও আই) কে একত্রিত করে ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অর্থরিটি’ (বিডা) তৈরির করা হয়েছে। বিনিয়োগকে ত্বরান্বিত করার জন্য। ‘একশত অর্থনৈতিক জোন’ তৈরির কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে জমি ‘এ্যালটমেন্ট’ও শুরু হওয়ার কথা যা জমির সমস্যা দূরীভূত করবে। বিদ্যুতের অবস্থা নিশ্চয়ই আগের মতো নেই। সবাই বিদ্যুত পাচ্ছেন। গ্যাসের সমস্যা কিছুটা আছে। তা সমাধানে সরকারকে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাতে দেখা যাচ্ছে। ‘গ্রাউন্ড লেভেলে’ এসব পরিবর্তন সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা এগিয়ে আসছেন না। বেসরকারী বিনিয়োগ স্থবিরাবস্থায় এক দশক ধরে। প্রকৃত বিচারে তারা বিদেশের মাটিকেই যে বেছে নিয়েছেন এখন একথা খোলাখুলি বলাই দরকার। অর্থমন্ত্রী তাই এ কথা আলোচনা সভায় বলেই ফেলেছেন। তাকে সেজন্য ধন্যবাদ। আমার নিজের ধারণা বেসরকারী খাতের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা এখন আরও বেশি সতর্ক হবেন দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে। আমাদের শিল্পায়নের কৌশল রফতানিমুখী। শিল্পায়ন ‘ব্যাংক-ফিন্যান্স’ নির্ভর। কী রফতানি, কী রেমিটেন্স দুটোই বিদেশের বাজারের ওপর নির্ভরশীল। এবং দুটোই অবাধ বাণিজ্য নীতির ‘বেনিফিশিয়ারি’। একথা স্বীকার করতেই হবে রফতানির বাজার আমাদের অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেখানে এখন নতুন বাধা ‘নতুন জাতীয়তাবাদ’ নতুন সংরক্ষণবাদ। এই ‘সংরক্ষণবাদের’ নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এটা অবাক বিস্ময়ের ঘটনা। যে আমেরিকা সারাবিশ্বে অবাধ বিশ্ববাণিজ্যের প্রবক্তা, বাজার অর্থনীতির প্রবক্তা, তারা আজ সংরক্ষণবাদী বাণিজ্যনীতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। নিক, সেটা তারা পারে, তাদের সেটা অধিকার। কিন্তু প্রশ্ন অন্যত্র। বিশ্ব ইতোমধ্যেই বাণিজ্যজালে আবদ্ধ। এক দেশ অন্যদেশের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধনে আবদ্ধ। যেমন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ রফতানি বাণিজ্য হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ইতোমধ্যে বেরিয়ে গেছে ইংল্যান্ড। ইউরোপে এখন একই আওয়াজ। এ অবস্থা যদি তারা মৃদু পরিমাণেও সংরক্ষণবাদী হয়, আর বলে তোমাদের মাল নেব, কিন্তু আমাদের মালও নিতে হবে। কারণ তোমাদের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। আসলে এই সমস্যাই চীন ও মেক্সিকোর সঙ্গে। এদের সঙ্গে মার্কিনীদের ‘ট্রেড ডেফিসিট’। ট্রাম্প এর বিরুদ্ধে। ট্রাম্পের এই অবস্থানের কারণে সারাবিশ্ব আজ এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সম্মুখীন। বলা বাহুল্য এতে আমাদেরও নানা ঝুঁকি রয়েছে। কারণ, আমরা সম্পূর্ণই রফতানির ওপর নির্ভরশীল। আমার মনে পড়ে বহু উপলক্ষের কথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন যাবত বলে আসছেন রফতানির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে। রফতানির বৈচিত্র্যকরণের কথাও তিনি বহুবার বলেছেন। বলেছেন অভ্যন্তরীণ বাজারের কথা, তা সম্প্রসারণের কথা। শিল্পায়নের কথা বলতে গিয়ে তিনি বহুবার বলেছেন, ‘লেবার ইনটেনসিভ’ শিল্প করতে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আজ এসব বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এর ইঙ্গিতই, এর ঝুঁকির কথাই উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী। দেখা যাচ্ছে আমাদের ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার দারুণ। প্রতিবেশীদের তুলনায় ঈর্ষণীয়। সাত শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধির হার। কিন্তু আমরা মার খাচ্ছি অন্যত্র। মার খাচ্ছি কোথায়? ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে সত্য, কিন্তু কর্মসংস্থান হচ্ছে কম। কর্মসংস্থান কম হলে অভ্যন্তরীণ বাজার আসবে কোত্থেকে যা চাইছেন প্রধানমন্ত্রী। সাম্প্রতিক এক সেমিনারে এই বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। সেমিনারে প্রদত্ত তথ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে ২০০৫-’১০ সময়কালে ‘এক দশমিক ৮’ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি দিয়ে এক শতাংশ চাকরি সংস্থান হয়েছে। পরবর্তীকালে একই পরিমাণ কর্মসংস্থানের জন্য ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধি লেগেছে অনেক বেশি। ২০১০-২০১৩ সময়কালে লেগেছে দুই দশমিক ৬ শতাংশ ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধি। এই তথ্য খুবই দুশ্চিন্তার। যদি এই তথ্য সত্য হয়, তাহলে ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির হার ৮ বা ৯ শতাংশ করেও তো প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা পূরণ হবে না। প্রবৃদ্ধি হবে কিন্তু লোকের কর্মসংস্থান হবে না। ইতোমধ্যে খারাপ খবর আসছে পোশাক খাত থেকে। এই খাতটিতেই প্রায় ৪০ লাখ নারী-পুরুষের চাকরি হয়েছে বিগত কয়েক বছরে। সর্বশেষ তথ্যে দেখা যাচ্ছে এই খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ স্থবিরাবস্থায়। ২০১৩-২০১৬ সময়ে এই খাতে নতুন কর্মসংস্থান হয়নি। পোশাক খাতের বহু কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কারণ, ক্রেতাদের চাহিদা মোতাবেক তারা কারখানার পরিবেশ গড়ে তুলতে পারেনি। দেখা যাচ্ছে পোশাক কারখানার সংখ্যা ৫ হাজার ৬৩ থেকে ৪ হাজার ৩২৩ এ হ্রাস পেয়েছে। অপরদিকে বহু কারখানা আধুনিক যন্ত্রপাতি লাগাচ্ছে, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি লাগাচ্ছে। প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়েই তারা তা করছে। এসব ঘটনা আগামী দিনের ঝুঁকির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। আমাদের উচিত ঝুঁকি নিরূপণে অবিলম্বে কাজ শুরু করা। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×