ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কলাপাড়া প্রফুল্ল মন ভৌমিক স্বীকৃতি পাননি

প্রকাশিত: ০৬:২০, ১১ মার্চ ২০১৭

কলাপাড়া প্রফুল্ল মন ভৌমিক স্বীকৃতি পাননি

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত চিঠিটি ছিল তাঁর সম্বল। আর ওই চিঠির মাধ্যমে প্রাপ্ত দুই হাজার টাকার চেকটি ছিল স্বামী হারানোর একমাত্র সান্ত¡না। এই চিঠিটি জীবদ্দশায় প্রতিনিয়ত পড়তেন সীতালক্ষ্মী ভৌমিক। তিনিও ২০১৫ সালে ইহলোক ছেড়েছেন। দেশের জন্য স্বামীর আত্মত্যাগের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি শহীদ পরিবারটির কপালে জোটেনি। ২০০৪ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতা এবং বিজয় দিবসে উপজেলা সদরে আমন্ত্রণ জানানো হতো। শহীদ পরিবারের সম্মান দেখানো হতো। কিছু একটা উপঢৌকন হাতে ধরিয়ে দেয়া হতো। এখন আর তাও জোটে না। মহান মুক্তিযুদ্ধে কলাপাড়ার প্রথম তালিকায় তিন শহীদের নামের মধ্যে দ্বিতীয় নামটি তাঁর। শহীদ প্রফুল্ল মন ভৌমিক। অন্য দু’টি নাম হলো বিনোদ বিহারি দত্ত ও সুরেন্দ্র মোহন চৌধুরী। পরবর্তীতে তালিকা আরও দীর্ঘ হয়েছে। দেশের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার দায়ে ১৯৭১ সালের ১৬ মে শেষ রাতে পাখিমারার বাড়ি থেকে পাকিস্তানী হায়েনারা ধরে দানবীর প্রফুল্ল মন ভৌমিককে। স্থানীয় রাজাকাররা বাড়িসহ তাঁকে চিনিয়ে দেয়। সঙ্গে ছিল ওই ইউনিয়নের আরেক রাজাকার। পরদিন ১৭ মে। সকালে কলাপাড়া শহরের খেপুপাড়া হাইস্কুল মাঠে নদীর পাড়ে নিয়ে গুলি করে মেরে ফেলা হয় তাঁকে। আন্ধারমানিক নদীর পাড়ে বিভিন্ন স্থানে মৃতদেহ ভেসে থাকার খবর আসে। কিন্তু জীবনের ভয়ে লাশ তুলতে যায়নি স্বজনরা। এসব কথা বলতে গিয়ে দু’চোখ ছল ছল করে ওঠে শহীদ প্রফুল্লের বড় সন্তান প্রদীপ ভৌমিকের। বাবা নিজের জীবন দিয়ে দেশের প্রদীপ জ্বালিয়ে গেছেন। কিন্তু ছেলে প্রদীপ আর নিজেকে জ্বালাতে পারেননি। প্রদীপে এখন আর সংসারে আলো দিতে পারে না। নেই উজ্জ্বল রং। ধূসর। বিবর্ণ সব। প্রদীপ জানান, তখন তাঁর বয়স ১০ কী ১১ বছর। সব মনে আছে। জীবদ্দশায় দেশের জন্য জীবনত্যাগী তাঁর বাবা নিজের অজস্র সম্পত্তি, জমিজমা দান করেছেন। নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়তেই গড়েছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আজকের প্রফুল্ল মন ভৌমিক মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় দিয়েছেন ৬৬ শতক জমি। এছাড়া নীলগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের জন্য এক একর, স্বাস্থ্য ক্লিনিকের জন্য ১০ শতক এবং সমাজকল্যাণের স্থাপনার জন্য দিয়েছেন ১০ শতক জমি। সবশেষে উৎসর্গ করেছেন জীবন-যৌবন। জমিজমা এরপরও যা ছিল তা পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তাদের তিন একর জমি গেছে সেখানে। মাত্র ৩১শ’ টাকায় কড়া। তাও অফিস খরচ বাবদ কেটে রাখার পর দুই ভাই হাতে পেয়েছেন এক লাখ কুড়ি হাজার টাকা। কেউ দয়া দেখায়নি শহীদ এ পরিবারটির প্রতি। যাঁর বাবার ছিল কেবলই ত্যাগ আর উৎসর্গ। তাঁর সন্তানদের কাছ থেকে উল্টো কালো হাতের থাবায় চলে গেছে অধিগ্রহণের অনেক টাকা। এ পরিবারটি ’৯৬ সালের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন করে অনুদান পেয়েছে দশ হাজার টাকা। এখন নিজেদের জমিতে গড়ে ওঠা পাট গবেষণায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন প্রদীপ। ছোট ভাই অসিত বেকার। দুই ভাইয়ের আট জনের সংসার। চলতে চলতে কখনও থেমে যায়, আর চলতে চায় না। আবার ধাক্কা দিতে হয়। তবুও দিন তো থেমে থাকে না। প্রদীপ অশ্রুসজল চোখে কান্না জড়িত কণ্ঠে বললেন, শুনেছি বাবায় পানি খাইতে চাইছে মরার আগে, দেয় নাই। বলেই নীরব। নিথর। আবার সম্বিত ফেরে ডাক দেয়ায়। কতবার শহীদ পরিবার হিসেবে ভাতা কিংবা আর্থিক সহায়তার জন্য ইঁদুর দৌড় দৌড়েছেন। কিন্তু কারও মন গলেনি। প্রদীপ দেখালেন, তার মাকে উদ্দেশ্য করে বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত চিঠিতে লেখা রয়েছে, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনার সুযোগ্য স্বামী আত্মোৎসর্গ করেছেন। আপনাকে আমি গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক সমবেদনা। আপনার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি রইল আমার প্রাণঢালা সহানুভূতি। এমন নিঃস্বার্থ মহান দেশপ্রেমিকের স্ত্রী হওয়ার গৌরব লাভ করে সত্যি আপনি ধন্য হয়েছেন। ১৯৭২ সালের ৬ অক্টোবর লেখা বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত চিঠিটি প্রদীপ ভৌমিক লেমিনেটিং করে রেখেছেন। সঙ্গে শহীদ পরিবারের কয়েকটি তালিকা। এছাড়া ২০১২ সালের ২০ মার্চ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, গণভবন কমপ্লেক্স, শেরেবাংলা নগর, ঢাকার লাইব্রেরিয়ান মনিবুর রহমান এক চিঠিতে জানান, কলাপাড়া উপজেলায় স্মরণীয় যারা, তাদের উদ্দেশ্যে প্রকাশিত বইয়ে প্রফুল্ল মন ভৌমিককে মুক্তিযোদ্ধা অভিহিত করেছেন। তিনি এ সংক্রান্ত চিঠিও শহীদ প্রফুল্ল ভৌমিকের ভাই প্রশান্ত ভৌমিককে দিয়েছেন। প্রদীপও এখন বার্ধক্যের গ-ি পেরোচ্ছেন। শুধু নীরবে তার বাবার গৌরবগাথা কীর্তির স্মৃতিচারণ করেন আর হিসাব মেলান তার বাবা ভুল করেছেন, না ঠিক করেছিলেন। কিন্তু হিসেব মেলাতে পারেন না। যখন দেখতে পান ওই রাজাকাররা এখনও বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায় তাদের বাড়ির সামনের সড়ক দিয়ে। যখন দেখেন সংসার চালানোর জন্য পাট গবেষণায় শ্রমিকের কাজ করতে হয়। যখন ভাবেন, কম্পিউটার বিষয়ে চার বছরের ডিপ্লোমা নিয়েও কপালে জোটে না সরকারি চাকরি। এমনকি বাবার প্রতিষ্ঠিত স্কুলটিতেও নয়। এ শহীদ পরিবারটি সর্বশেষ মুক্তিযোদ্ধা বাছাইয়ের তালিকায় আবেদন করে সাক্ষাতকারে অংশ নিয়েছে। কিন্তু কোন ফলাফল জোটেনি। আক্ষেপ, কত ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে তালিকায়। নিচ্ছে ভাতা। বাদ যায়নি রাজাকারের সন্তানেরাও। শুধু আফসোস। বাবার স্বীকৃতি মা দেখে যেতে পারেননি। তিনিও পারবেন কী দেখতে? Ñমেজবাহউদ্দিন মাননু, কলাপাড়া থেকে
×