ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

রূপালী ব্যাংকের বার্ষিক ব্যবসায়িক সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির

নিয়ম মেনে ব্যবসা করুন

প্রকাশিত: ০৪:০০, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

নিয়ম মেনে ব্যবসা করুন

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির বলেছেন, ব্যাংকিং খাতের জন্য সুশাসন ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়া জরুরী। ব্যাংকগুলোর মূল কাজ ঋণ বিতরণের মাধ্যমে ব্যবসা করা। নিয়ম মেনে ব্যবসা করতে হবে। তাহলে দুর্নীতি দমন কমিশন বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষকে ভয় পেতে হবে না। শনিবার রাজধানীর খামারবাড়ি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে রূপালী ব্যাংকের বার্ষিক ব্যবসায়িক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ইউনুসুর রহমান। সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আতাউর রহমান প্রধান। এ সময় আরও বক্তব্য রাখেন ব্যাংকের চেয়ারম্যান মনজুর হোসেন, পরিচালক ড. মোঃ হাসিবুর রশীদ, অরিজিৎ চৌধুরী ও আব্দুল বাসেত খান প্রমুখ। গবর্নর বলেন, দেশের ব্যাংকিং খাতে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক ২৬ শতাংশ আমানত ও ১৭ শতাংশ ঋণ নিয়ন্ত্রণ করছে। তাদের শাখা রয়েছে ৩ হাজার ৬০৩টি শাখা। এই বিশাল নেটওয়ার্ক সরকারের অগ্রাধিকার খাতে লেন্ডিং সুবিধা নিশ্চিত করাসহ সকল সেফটিনেট প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তাছাড়া ব্যবসা, বাণিজ্য, শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা আহরণসহ সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে এই ব্যাংকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে এই ব্যাংকগুলোর মন্দদিকও রয়েছে। ব্যাংকিং খাতের মোট খেলাপী ঋণের উল্লেখযোগ্য অংশই এই চার ব্যাংকের। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপী ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২২ হাজার ২৮৭ কোটি বা ৩৩ দশমিক ৯০ শতাংশই রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের। এ সময়ে সোনালী ব্যাংকের ২৭, রূপালীর ১৮.৭০, অগ্রণীর ২৫.৬২ ও জনতার রয়েছে ১৪ দশমিক ৭১ শতাংশ। বর্তমানে রূপালী ব্যাংকের ঋণের ৩০ শতাংশ শীর্ষ খেলাপী গ্রহীতার অনুকূলে কেন্দ্রীভূত রয়েছে। এ বিষয়ে গবর্নর বলেন, এ বিষয়টিকে নিবিড়ভাবে দেখতে হবে। আইনের মধ্যে থেকে যা যা করা দরকার সেটা করতে হবে। মূলধন বাড়াতে রূপালী ব্যাংকের বন্ড চাওয়ার প্রস্তাবের বিষয়ে তিনি বলেন, এটা সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়। সরকার বিষয়টি পর্যালোচনা করছে। ঋণ বিতরণে এসএমই খাতকে প্রাধান্য দেয়ার আহ্বান জানিয়ে গবর্নর বলেন, এসএমই ঋণের প্রতি ফোকাস থাকতে হবে। বিশেষ করে ম্যানুফ্যাকচারিং ফোকাস এসএমই ঋণ দিতে হবে। কারণ এখানেই কর্মসংস্থান সবচেয়ে বেশি হয়। তবে কর্মসংস্থান মানেই পড়ালেখা শেষ করে একটা চাকরি পাওয়া তা নয়। বরং কাউকে স্বনির্ভরশীল করে তোলা। এসইএমই ঋণ দিয়ে চাকরি প্রত্যাশীদের স্বনির্ভরশীল করে তুলতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের বড় সমস্যা কর্মসংস্থান। প্রতিবছর ১৮ থেকে ২০ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে আসে। সরকার ও অটোনোমাস বডি মিলে ১৫ লাখের মতো চাকরি দিতে পারে। তাই অধিক কর্মসংস্থান ও মানুষকে স্বনির্ভর করার স্বার্থে জামানতবিহীন ঋণ দেয়া যায় কিনা সেটি ব্যাংকগুলোকে বিবেচনায় নেয়ার আহ্বান জানান গবর্নর। তিনি বলেন, ভোক্তা ঋণে কোন জামানতের প্রয়োজন হয় না। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির চাকরির সার্টিফিকেটই জামানত বলে গণ্য হয়। তাই এসএমই ঋণেও ব্যক্তির প্রশিক্ষণ দক্ষতাকে জামানত হিসেবে নেয়ার পরামর্শ দেন গবর্নর। কৃষির মতো এসএমই ঋণ বিতরণেও ব্যাংকগুলোকে টার্গেট করে দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে বলেও জানান ফজলে কবির। সুশাসন নিয়ে গবর্নর বলেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যে কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর কর্পোরেট সুশাসনের বিষয়টি ব্যাংকিং খাতের জন্য বেশি প্রযোজ্য। এটা নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোতে ইন্টারন্যাল কন্ট্রোল এ্যান্ড কমপ্লায়েন্স পরিপালন জরুরী। সব ব্যাংকেই এই পলিসি রয়েছে। এটা পরিপালন করতে হবে। অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ইউনুসুর রহমান বলেন, ডিপোজিট, এ্যাডভান্স, এডি রেশিও সবকয়টি জায়গায় বেসরকারী ব্যাংকের চেয়ে সরকারী ব্যাংকগুলোর অবস্থা দুর্বল। তিনি বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এডি রেশিও মাত্র ৫০ শতাংশ। এদের আমানত সংগ্রহের খরচ ৫ থেকে ৬ শতাংশ। কস্ট অব ফান্ড রয়েছে ৫ শতাংশ। তাহলে তারা ৮ থেকে ৯ শতাংশে বিনিয়োগ করলে উল্টো ক্ষতি হয় ১ টাকা। তারওপর ১০০ টাকার মধ্যে ৫০ টাকা বিনিয়োগে আসছে। বাকি ৫০ টাকা অলস পড়ে থাকছে। এদের শ্রেণীকৃত ঋণের অবস্থাও অত্যন্ত খারাপ। বেসরকারী ব্যাংকের যেখানে ৫ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে সেখানে এগুলোর ২০ শতাংশের ওপরে। তাই বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে কিভাবে বেঁচে থাকবে এ বিষয়গুলো গভীরভাবে বিবেচনা করার সময় এসেছে। তিনি বলেন, অনেকেই বলেন মানুষের মৌলিক শিক্ষা পাওয়া যেমন অধিকার, তেমনি ঋণ পাওয়াটাও অধিকার। অথচ আমরা গ্রামের অসহায় কোটি কোটি মানুষকে ক্ষুদ্রঋণের আওতায় রেখেছি। যাদের ঋণ পেতে ক্ষুদ্রঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানকে ২৫ শতাংশ সুদ গুণতে হয়। তাছাড়া সেখানে ১০০ টাকা চাহিদার বিপরীতে ৪০ টাকার ঋণের যোগান মিলছে। ৬০ টাকা দিতে পারছে না তারা। ফলে গ্রামের মানুষ ঋণ চেয়েও পাচ্ছে না। তাহলে কি ওই মানুষগুলোর ঋণ পাওয়ার অধিকার নেই। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে অলস অর্থ পড়ে থাকার পরও ঋণ দিচ্ছে না। এটা একধরনের বৈষম্য। তাই সময় এসেছে নতুন নতুন পথ বের করার। জামানত ছাড়া ঋণ দেয়ার। এনজিওরা জামানত ছাড়া ঋণ দিয়ে ৯৮ শতাংশ আদায় করতে পারলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো কেন পারবে না এমন প্রশ্নও রাখেন তিনি। বেসরকারী ব্যাংকের চেয়ে সরকারী ব্যাংকগুলো পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে কর্মকর্তাদের কালচারাল গ্যাপকে দায়ী করেন ইউনুসুর রহমান। তিনি বলেন, বেসরকারী ব্যাংকের কর্মকর্তারা চাকরি বাঁচাতেই কাস্টমারদের ওয়েলকাম করে। কিন্তু সরকারী চাকরিজীবীরা মনে করেন কাজ করি বা না করি, ঋণ দেই বা না দেই, লাভ করি বা না করি মাস শেষে বেতন পাব। আমি অতটা না করলেও চাকরিও যাবে না। কিন্তু মনে রাখা দরকার আপনিও বাণিজ্যিক অর্গানাইজেশন চালান। এখানে আপনার কমপিটিটর আছে। তাই এ ধরনের মানসিকতা থাকলে তার পরিবর্তন আনা জরুরী। ব্যাংকের চেয়ারম্যান মনজুর হোসেন বলেন, নিজেদের একগুঁয়েমির কারণে হোক বা অন্য কোন উদ্দেশে ব্যাংকের কর্মীরা ভুল করেছেন। নিজেদেরই তা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। তারা চাইলে সব সমস্যার সমাধান করতে পারেন। তিনি বলেন, বড় ঋণ খেলাপী যতই প্রভাবশালী হোক তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যা করণীয় করতে হবে। আগে রূপালী ব্যাংকের অফিসে অন্য অফিসের লোকজন লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। ইউনিয়নের নামে ঋণ বিতরণ, কর্মী নিয়োগ, পদোন্নতি বদলি ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলতো। এগুলো অনেকাংশে বন্ধ করা গেছে। ব্যাংকের এমডি আতাউর রহমান প্রধান বলেন, রূপালী ব্যাংকে আগে খেলাপী ঋণকে নিয়মিত দেখিয়ে ও খেলাপী ঋণের বিপরীতে প্রভিশনিং না করে মুনাফা দেখানো হয়েছে। গত ২০১৫ সালে মুনাফা হয়েছে বলে মিথ্যা রিপোর্ট সরকারকে দিয়ে তার বিপরীত কর পরিশোধ করে ব্যাংকটির ক্ষতি করা হয়েছে। আমি দায়িত্ব নিয়ে সবার আগে সঠিক হিসাব করেছি। এর ফলে গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির প্রকৃত লোকসান ২৪৪ কোটিতে দাঁড়ায়। তবে ডিসেম্বরে তা ৫২ কোটিতে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। এ সময়ে লোকসানি শাখা নেমে এসেছে ৮০টিতে। এছাড়া ব্যাংকের ডিএমডি আবু নাসের চৌধুরী, মহাব্যবস্থাপকবৃন্দ, উপ-মহাব্যবস্থাপকবৃন্দ ও ৫৬২টি শাখার ব্যবস্থাপকসহ ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
×